জাতীয় নির্বাচনোত্তর রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে বোঝা যাবে না জামায়াতে ইসলামী আসলে কী করছে? বছর সাতেক ধরে রাজনীতিতে একেবারেই কোণঠাসা জামায়াত নেতাকর্মীরা এখন একেবারেই চুপ। কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়। তাদের ঘিরে জাতীয় রাজনীতির সেই আলোচনাও হয় না।
জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অনেকেই বলছেন, জামায়াত প্রকাশ্যে নেই-এটা বাস্তব। তবে ভেতরে ভেতরে সাংগঠনিক কাজ ঠিকই করছে। ঘরোয়া রাজনীতিতে তারা বেশ পটু। নিষিদ্ধ সংগঠনের মতো আড়ালে-আবডালে তারা সক্রিয় থাকে। তাই দলটি যে হারিয়ে যাচ্ছে, তা বলা যাবে না।
জাতীয় রাজনীতিকে কেন্দ্র করে দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম নেই জামায়াতে ইসলামীর। সাংগঠনিকভাবে অনেকটা ছন্নছাড়ার মতো। কর্মিভিত্তিক দল হলেও যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী কবে নাগাদ রাজধানীতে প্রকাশ্যে মিছিল অথবা সভা-সমাবেশ করেছে, তা দলটির নেতারাও মনে করতে পারছেন না। মানবতাবিরোধী অপরাধের সাজায় দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের ফাঁসি কার্যকরের পরও দলটিকে প্রকাশ্যে কোনো কর্মসূচি করতে দেখা যায়নি।
হরতালসহ নানা কর্মসূচি দিলেও তাতে প্রকাশ্যে কোনো নেতাকর্মীকে দেখা যায়নি। কিন্তু কর্মসূচির আগের দিন কিছু গাড়িতে আগুনসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও ঝটিকা মিছিলই ছিল তাদের শেষ ভরসা। যদিও দলটির নায়েবে আমির মিয়া মোহাম্মদ গোলাম পরওয়ার আমাদের সময়কে বলেন, ‘রাজপথে তাদের সরকার কোনো কর্মকা- করতে দেয় না। তবে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সঙ্গে তাদের নেতাকর্মী কখনো সম্পৃক্ত ছিল না।’ যদিও জামায়াত নেতার এ বক্তব্য সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না।
২০১৩ সালের ১ আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। ৫ বছর পর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গত বছরের ২৯ অক্টোবর নির্বাচন কমিশন জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে।
ওই সময় ইসি সচিবালয়ের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এত দিন ইসির হাতে পূর্ণাঙ্গ রায়ের কোনো কপি ছিল না। তা ছাড়া বিষয়টি আপিল বিভাগে বিচারাধীন। এখন আমরা রায়ের কপি পেয়েছি। একই সঙ্গে আমরা জেনেছি, আপিল বিভাগে বিচারাধীন থাকলেও হাইকোর্টের রায়ের ওপর আপিল বিভাগ কোনো স্থগিতাদেশ দেননি। সে জন্য ইসি জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের বিষয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে।’
এ অবস্থায় জামায়াত জোটবদ্ধ হয়ে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিলেও ঝটিকা ছাড়া প্রকাশ্য প্রচার-প্রচারণায় দেখা যায়নি। এই নির্বাচনে দলটির চরম ভরাডুবি হয়েছে। যদিও জামায়াত এ নির্বাচন নিয়ে অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলের মতো প্রশ্ন তুলেছে। সংগঠনটির নেতারা বলেছেন, নির্বাচনী প্রচারে যেমন তাদের বাধা দেওয়া হয়েছে, তেমনি নির্বাচন গত ৩০ ডিসেম্বর হওয়ার কথা থাকলেও তা আগের রাতেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই নির্বাচন জামায়াতসহ ২০-দলীয় জোট, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বাম জোট প্রত্যাখ্যান করে।
এই জাতীয় নির্বাচনের পরই সংগঠনটির কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা জামায়াতের সব রাজনৈতিক কর্মসূচি স্থগিত করে সামাজিক কর্মসূচিতে মনোনিবেশ করে বলে জামায়াতের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়। মজলিসে শূরার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নিবন্ধনহীন জামায়াত আর কোনো স্থানীয় অথবা জাতীয় কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। সে ক্ষেত্রে দলটির দাওয়াতি কার্যক্রম, প্রচার-প্রচারণা, কর্মী সংগ্রহ, কর্মীর মান উন্নয়ন ইত্যাদি কার্যক্রম শিক্ষা ও বনভোজনের নামে গ্রুপভিত্তিক হয়।
এ প্রসঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর এক ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষক শাহ আব্দুল হান্নান বিবিসি বাংলাকে বলছেন, বিশ্বব্যাপী একটা নতুন চিন্তা এসেছে যে, রাজনীতি আর দাওয়াত বা রাজনীতি এবং প্রচারকে আলাদা করা-যেমন তিউনিশিয়া, মিসর এবং তুরস্ক করেছে। এটা নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল তাদের মধ্যে। শাহ আব্দুল হান্নান বলছেন, জামায়াতে ইসলামী নামটি বহাল রেখে সেটিকে সামাজিক সংগঠন হিসেবে পরিচালনা করা হতে পারে। আর নতুন নামে নতুন দল রাজনীতি করবে। এমন প্রস্তাব দলটি এখন সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে বলে তার ধারণা।
সামাজিক মানে রাজনীতি ছাড়া যেমন ধরেন, জামায়াতে ইসলামীর বই প্রকাশ করা, বই লেখা, প্রকাশনা চালানো, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা এবং ক্লিনিক হাসপাতাল-এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। মানে জামায়াত সমাজসেবামূলক কাজ করবে। তারা ব্যাপকভাবে এমন কাজ করবে। তারা শুধু জাতীয় রাজনীতির কাজ থেকে সরে আসবে।
এ প্রসঙ্গে জামায়াতের নায়েবে আমির মিয়া মোহাম্মদ গোলাম পরওয়ার আমাদের সময়কে বলেন, রাজপথের মিছিল-মিটিংই তো শুধু কর্মসূচি নয়, এর বাইরেও আরও কাজ রয়েছে-তা আমরা করছি। বিশেষ করে, দাওয়াতি কার্যক্রম, সমাজসেবামূলক কার্যক্রম ইত্যাদি। তিনি বলেন, সরকার তো দেশে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি করতে দেয় না। তা হলে করব কীভাবে?
দলের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, জামায়াত রাজনৈতিক কর্মসূচি স্থগিত করলেও মাঠের মুক্তিযোদ্ধা লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সভাপতি কর্নেল (অব) অলি আহমদ বীরপ্রতীককে সামনে রেখে নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখার কাজ করছে দলটি। এরই মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ ১৮ দফা দাবিতে ‘জাতীয় মুক্তি মঞ্চ’ নামে নতুন একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠনের ঘোষণা দিয়ে মাঠে নেমেছে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে ও সিলেটে কর্মসূচিও করেছে। এসব কর্মসূচিতে জামায়াতের নেতাকর্মীদেরই বেশি দেখা গেছে। জামায়াতের এক নেতা বলেন, এতে তারা দুটি লাভ দেখছেন- একটা হচ্ছে জামায়াতের নেতাকর্মীরা মুক্ত বাতাসে আসতে পারছেন; অপরটি হচ্ছে অবহেলা করা জামায়াত-বিএনপিকে কিছুটা চাপেও রাখতে পারবে।
শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির দণ্ড কার্যকরসহ নানা কারণে জামায়াত অর্থনৈতিক বেশ চাপে পড়েছে। দলটির নেতারা বলেন, আগের মতো ফান্ড সংগ্রহ হচ্ছে না। অর্থ সংকটের কারণে অনেক কর্মকা-ই ঠিকমতো তারা করতে পারছেন না। আবার জামায়াতের যে ফান্ড আসে, তা-ও বর্তমান নেতৃত্বের দুর্নীতির কারণে সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয় না। সংগঠনের প্রয়াত নেতা আতাউর রহমান এ নিয়ে বর্তমান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অভিযোগও তুলেছিলেন এক বৈঠকে। যদিও জামায়াত ওই অভিযোগ স্বীকার করে; কিন্তু ওই নেতাকে ভিন্ন অভিযোগে ওই সময় বহিষ্কারও করা হয়েছিল।
শুধু অর্থনৈতিক সংকট নয়, জামায়াতের ভাঙন ঠেকানো নিয়েও চিন্তিত দলটির শীর্ষ নেতা। জামায়াতের সংস্কারপন্থি নেতা সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের পদত্যাগের পরই বহিষ্কার করা হয় সংস্কারপন্থি আরেক নেতা মুজিবুর রহমান মঞ্জুকে। যুক্তরাজ্য থেকেই তিনি পদত্যাগপত্রটি পাঠান। পদত্যাগপত্রের কারণ হিসেবে আবদুর রাজ্জাক লিখেন, জামায়াত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করার জন্য জনগণের কাছে ক্ষমা চায়নি।
একবিংশ শতাব্দীর বাস্তবতার আলোকে ও অন্যান্য মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনকে বিবেচনায় এনে দলটি নিজেদের সংস্কার করতে পারেনি। পদত্যাগ করা আব্দুর রাজ্জাক কোনো রাজনৈতিক কর্মকা-ে সম্পৃক্ত না হলেও বহিষ্কৃত সংস্কারপন্থি নেতা মঞ্জু এরই মধ্যে পৃথক প্ল্যাটফর্ম গঠনের ঘোষণা দিয়ে এখন কাজ করছেন। এ অবস্থায় চাপে থাকা জামায়াত সারাদেশে রেড অ্যালার্ট জারি করেছে। সংগঠনের প্রতিটি ইউনিটের বিশ্বস্ত নেতাদের মাধ্যমে সন্দেহজনক নেতাদের প্রতি দৃষ্টি রাখা হচ্ছে।
আব্দুর রাজ্জাকের পদত্যাগের পর পরিস্থিতি সামাল দিতে সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কথা ছিল ওই কমিটি জামায়াতে সংস্কারসহ দলটির নামও পরিবর্তনে কাজ করবে। কিন্তু কমিটি গঠনের পর আর কোনো বৈঠকই হয়নি। জানা গেছে, সংগঠনের বয়স্ক নেতারা জামায়াতকে বিলুপ্ত করতে চান না। তবে তরুণ নেতারা চান, ‘টিকে থাকতে হলে ’৭১-এর ঘটনায় জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে, প্রয়োজনে নতুন নামে দল গঠন করতে হবে।
একই সঙ্গে ’৭১-এর আগের প্রজন্মকে জামায়াতের শীর্ষ পদে বসানো যাবে না। এ অবস্থায় আগামী ডিসেম্বরে কাউন্সিলের চিন্তা করছে জামায়াত। সেখানেও ’৭১-এর আগে এবং পরের প্রজন্ম নিয়ে নতুন দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। আগামী অক্টোবর-নভেম্বরে কাউন্সিলের সার্বিক প্রস্তুতি নেওয়া হবে। এই কাউন্সিলের মাধ্যমে আমির নির্বাচন করবে জামায়াত। আগে রোকনদের ভোটে আমির নির্বাচনের নিয়ম থাকলেও এবার সেখানে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এবার কাউন্সিলররা ভোট দেবেন।
দলটির এক নেতা জানান, প্রতিটি ইউনিট থেকে আনুপাতিক হারে কাউন্সিলর নির্বাচিত করা হবে। সে ক্ষেত্রে ৭ জন রোকন থেকে ১ জন কাউন্সিলর নির্বাচিত হবেন।
আগামী বছরের ১ জানুয়ারি নতুন নেতৃত্ব দায়িত্ব গ্রহণ করবে। মকবুল আহমাদ নেতৃত্বাধীন জামায়াতের বর্তমান কমিটির মেয়াদ ডিসেম্বরে শেষ হবে। জামায়াতের দায়িত্বশীল সূত্রে আরও জানা যায়, আমির পদে নির্বাচনের জন্য একটি প্যানেল হবে। এই প্যানেলে বর্তমান আমির মকবুল আহমাদ, নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানের নাম থাকার সম্ভাবনাই বেশি।
কাউন্সিলরদের ভোটে যিনি আমির হবেন, তিনিই কার্যনির্বাহী পরিষদের সঙ্গে আলোচনা করে সেক্রেটারি জেনারেল নিয়োগ দেবেন। সে ক্ষেত্রে আমিরের পছন্দে সেক্রেটারি জেনারেল নিয়োগ হবে। মকমুল আহমাদ আমির নির্বাচিত হলে সেক্রেটারি হিসেবে ডা. শফিকই থাকছেন। কিন্তু মকবুল না হয়ে মুজিবুর রহমান আমির হলে তার ঘনিষ্ঠ সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খানই সেক্রেটারি জেনারেল পদে নিয়োগ পাবেন। জামায়াতের কাউন্সিল বিষয়ে গোলাম পরওয়ার আমাদের সময়কে আরও বলেন, সময় হলেই কাউন্সিল হবে। তবে সরকার কি কাউন্সিল করতে দেবে?
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন