ঋণ বিতরণ থেকে শুরু করে আদায় পর্যন্ত সুশৃঙ্খল একটি পদ্ধতি রয়েছে। এসব পদ্ধতি অনুসরণ করার কথা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর; নতুবা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ছাড়া ঋণ বিতরণে অপরাধ কিংবা জালিয়াতি করলে শাস্তি দেওয়ার কথা আদালতের। কিন্তু কোনো পর্যায় থেকেই ঋণখেলাপিদের ধরা হয়নি। উল্টো খেলাপিদের পুরস্কৃত করা হচ্ছে।
আইনের জালে সাধারণ মানুষ আটকে গেলেও চেষ্টা-তদবিরে পার পেয়ে যাচ্ছেন প্রভাবশালীরা। সংশ্লিষ্টরা জানান, ঋণ বিতরণ ও আদায়ের পুরো দায়িত্ব বাণিজ্যিক ব্যাংকের। ঋণের জন্য আবেদনকারীর ব্যক্তিগত জীবন, ব্যবসায়িক জীবন, ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতা, ঋণ ফেরত প্রদানে নিশ্চয়তা, ব্যবসার ধরন ইত্যাদি বিষয়ের বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রদত্ত নীতিমালা অনুসারে নির্ধারিত যাচাই-বাছাইয়ের পরই ঋণ দেওয়ার নিয়ম।
কিন্তু এই ঋণশৃঙ্খলা প্রভাবশালীদের ক্ষেত্রে মানা হয়নি। ফলে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বেসিক ব্যাংক থেকে ঋণের কথা বলে নামে-বেনামে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ডাকাতি করা হয়েছে। ওই সময় আবেদন ছাড়াই এবং অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠান ও অন্যের নামে ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে। জাতীয় সংসদে প্রকাশিত শীর্ষ ৩০০ খেলাপির তালিকায় বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছে, যেগুলো কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা লুট করে নিয়েছে।
এর মধ্যে সৈয়দ মাহবুবুল গনি ও সৈয়দ হাসিবুল গনি গালিবের মালিকানাধীন চারটি প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছে শীর্ষ খেলাপির তালিকায়। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এমারেল্ড অয়েলের ১২১ কোটি, এমারেল্ড অটো ব্রিকসের ৮৫ কোটি, এমারেল্ড স্পেশালাইজড কোল্ডস্টোরেজের ৮৩ কোটি ও সৈয়দ ট্রেডার্সের ৬৯ কোটি টাকা ঋণ খেলাপ রয়েছে। বেসিক ব্যাংকের গ্রাহক ওয়াহিদুর রহমানের তিনটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে ঘোষিত ঋণখেলাপির তালিকায়। অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান মা টেক্সের ১১১ কোটি, নিউ অটো ডিফাইনের ১০২ কোটি ও ফিয়াজ এন্টারপ্রাইজের ৯৪ কোটি টাকা খেলাপি রয়েছে। নানা অনিয়মের কারণে ফারমার্স ব্যাংকের পরিচালক পদ হারানো বাবুল চিশতীর ভাই মাজেদুল হক চিশতীর মালিকানাধীন দি অয়েল টেক্সের খেলাপি ১২৯ কোটি টাকা।
জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহীমের মালিকানাধীন ক্রিস্টাল স্টিলস অ্যান্ড শিপ ব্রেকিংয়ের খেলাপি ঋণ ১০৫ কোটি টাকা। এছাড়া বেসিক ব্যাংকে অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত ডেল্টা সিস্টেমস, ম্যাপ পেপার বোর্ড মিলস, প্রোফিউশনস টেক্সটাইলস, কনফিডেন্স সুজ, এআরএস এন্টারপ্রাইজ, আরকে ফুড, টেকনো ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে তালিকায়। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংকগুলো টাকা আদায়ের চেষ্টা করে। কিন্তু চেষ্টা করেও আদায়ে ব্যর্থ হয়ে অনেক সময় নিজেদের অবস্থা ভালো রাখার স্বার্থে পরিশোধের সময়সূচি বাড়িয়ে দেয়।
অনেক ক্ষেত্রে সুবিধা নিয়েও টাকা ফেরত দেন না গ্রাহক। এ জন্য ব্যাংকের কিছু করার থাকে না। দু-একটি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে কাগজে-কলমে আরও বেশি বেশি প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে এবং ভুয়া আমদানি-রপ্তানির ডকুমেন্ট দেখিয়ে সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্ক গ্রুপ হাতিয়ে নেয় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। বিসমিল্লাহ গ্রুপ জনতাসহ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নিয়েছে ১২শ কোটি টাকা। জনতা ব্যাংক থেকে বেশকিছু ভুয়া প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে অ্যাননটেক্স গ্রুপ ৬ হাজার কোটি টাকা এবং ক্রিসেন্ট গ্রুপ ৫ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দিলেও আদৌ ওই নামে কোনো প্রতিষ্ঠান আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করেনি ব্যাংক। অভিযোগ রয়েছে, গ্রাহকের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাংকাররা এসব ঋণ তুলে দিয়েছেন। বিষয়গুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দৃষ্টিগোচর হলেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, নিয়ামাচার না মেনে ঋণ দিলে আদায় হবে না- এটাই স্বাভাবিক। নিয়ামাচারের ব্যত্যয় হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে যদি তা ধরা পড়ে, তবে ওই ঋণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। নিয়ম মেনে ঋণ দেওয়ার কথা থাকলেও ব্যাংকগুলো নিয়ম লঙ্ঘন করে একই গ্রাহককে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ তুলে দিয়েছে। আমদানি-রপ্তানির বিপরীতে দেওয়া সেসব ঋণের বিপরীতে কোনো জামানত পর্যন্ত নেই। জামানত ছাড়াই ৩০-৩৫টি ব্যাংক চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ও ঢাকার ইমামগঞ্জের ব্যবসায়ীদের হাতে ঋণের টাকা তুলে দিয়েছে। শুধু খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদেরই দেওয়া হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। এর পর ঋণের বিপরীতে কোনো টাকা আদায় না করে প্রথমে পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
এর পর ফোর্সড লোন তৈরি করা হয়েছে। এরও পর মেয়াদি লোন করা হয়েছে। এর পর আদায় করতে না পেরে ওই ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। সব পর্যায়ে গ্রাহককে সুবিধা দিতে আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাতে অনুমোদনও দিয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এসব ঋণ আদায় করা সম্ভব হয়নি। শীর্ষ ৩০০ খেলাপির এক নম্বরে রয়েছে সামান্নাজ অয়েলের নাম। এই কোম্পানির মূল প্রতিষ্ঠান এসএ গ্রুপ। শীর্ষ খেলাপির তালিকায় শাহাবুদ্দিন আলমের এ গ্রুপের আরও ৬টি কোম্পানির নাম রয়েছে। সব মিলিয়ে পাওনা প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। চট্টগ্রামের আরেক প্রতিষ্ঠান মোস্তফা গ্রুপের কাছে পাওনা দেড় হাজার কোটি টাকা, ইলিয়াস ব্রাদার্সের কাছে পাওনা প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। ঋণ বিতরণের কোনো পর্যায়েই তাদের বাধা দেওয়া হয়নি। হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে দেওয়া হয়েছে তাদের হাতে। আদায় করতে ব্যর্থ হওয়ার পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে; বরং দেওয়া হয়েছে একের পর এক সুবিধা। ঋণ ফেরত দিতে কেউ ব্যর্থ হলে তার জন্য ব্যাংক কোম্পানি আইনে সুযোগ রাখা হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঋণ ফেরত দিতে না পারলে সর্বোচ্চ তিনবার সময় বাড়ানো যাবে। এ জন্য প্রথমবার পুনঃতফসিল করতে বকেয়া কিস্তির ১৫ শতাংশ বা মোট পাওনা ১০ শতাংশের মধ্যে যেটি কম সেই পরিমাণ নগদ অর্থ জমা দিতে হয়।
দ্বিতীয়বার করতে হলে বকেয়া কিস্তির ৩০ শতাংশ বা মোট পাওনার ২০ শতাংশের মধ্যে যেটি কম; তৃতীয়বার পুনঃতফসিলের জন্য বকেয়া কিস্তির ৫০ শতাংশ বা মোট পাওনার ৩০ শতাংশের মধ্যে যেটি কম সেই পরিমাণ নগদ অর্থ জমা দিতে হয়। এই আইন শুধু কাগজে-কলমেই আছে। কয়েক বছর ধরে মাত্র ১ ও ২ শতাংশ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডাউনপেমেন্ট ছাড়াই পুনঃতফসিল করা হচ্ছে। ৫০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ খেলাপি যারা, তাদের ১ ও ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট পুনঃতফসিলের সুবিধা দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন নীতিমালা জারি করে। আবার এখন ১ ও ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্টে পুনঃতফসিল করতে প্রয়োজন হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন। প্রভাবশালী ঋণখেলাপিরা অর্থমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর, মন্ত্রী বা ক্ষমতার শীর্ষপর্যায়ে থাকা ব্যক্তিদের সুপারিশে এসব সুবিধা বাগিয়ে নিচ্ছেন। প্রতিবছর বিপুল পরিমাষ ঋণ পুনঃতফসিল হচ্ছে, কিন্তু ঋণ আদায় হচ্ছে না। অথচ ব্যাংকই তদবির করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে যাচ্ছে না।
কিন্তু যারা নীতিনির্ধারকের কাছ পর্যন্ত যেতে পারছেন না, তারা আটকে পড়ছেন আইনে; পড়ছেন বিপাকে। জাল-জালিয়াতি করে ঋণ নিলে শাস্তি হওয়ার কথা। অগ্রণী ব্যাংক থেকে প্রায় হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে মুন গ্রুপ, যার বিপরীতে ভুয়া জামানত দেওয়া হয়েছে। এটি ধরা পড়ার পরও গ্রুপটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো আদালতের রিটের মাধ্যমে গ্রুপটি তাদের নেওয়া ঋণ ১২ বছরের জন্য পুনঃতফসিল করে নিয়েছে। এ গ্রুপের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। ঋণখেলাপি হয়েও শাস্তির বদলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে ব্যবসা করছে অরনেট সার্ভিসেস। সিকিউরিটি-বিষয়ক এই কোম্পানিটি শীর্ষ ৩০০ খেলাপির তালিকার ১০৮ নম্বরে। প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৩৭ কোটি টাকা।
মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ব্যাংক তার গ্রাহকদের পক্ষে আবেদন করে বিশেষ ছাড়ে পুনঃতফসিল করে নিচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কারও অনুরোধে নয়; বরং গ্রাহকের প্রকৃত অবস্থা বিবেচনা করে অনুমোদন দিচ্ছে। এ ছাড়া সম্প্রতি খেলাপিদের শাস্তির পরিবর্তে পুরস্কারের ডালি হাজির করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাদের আগের সুদ মওকুফ করে ৯ শতাংশ সুদে ১০ বছরে ঋণ পরিশোধের সুযোগ দিতে বিশেষ পুনঃতফসিল নীতিমালা জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অবশ্য আদালত আগামী ২৪ আগস্ট পর্যন্ত ওই নীতিমালা স্থগিত করেছে। এ ছাড়া খেলাপি হওয়ার নীতিমালাও সহজ করা হয়েছে। ঋণের সুদ কমাতে ব্যর্থ হয়েছে, অথচ নজিরবিহীনভাবে ঋণখেলাপিদের একের পর এক সুবিধা দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বড় বড় গ্রুপ নিয়ম মানার ধারেকাছে যাচ্ছে না; উল্টো বাড়তি সুবিধা নিচ্ছে। অন্যদিকে ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান আইন মানতে বাধ্য হচ্ছে। এ বৈষম্য থাকা উচিত নয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন