ঢাকার পলাশী মোড়ের ফুটপাত। নিজেদের মতো করে সেখানে বসে গাঁজা সেবন করছিল পাঁচ পথশিশু। বয়স বড়জোর ১০ থেকে ১৭-এর মধ্যে। পাশ দিয়ে যে যার মতো হেঁটে যাচ্ছে, কড়া চাহনি কিন্তু ভ্রুক্ষেপ নেই তাদের। হঠাৎ সাদা গেঞ্জি ও জ্যাকেট পরিহিত কিছু লোক তাদের খপ করে এসে ধরে ফেলল। তারা আর কেউ নন, মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সদস্য।
শিশুদের চেহারা কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। দেখে মনে হবে, নিয়মিত নেশা করে তারা। চারজনকে ধরে ঠিকঠাক মতো পুলিশের গাড়িতে তোলা হলো। পঞ্চমজনকে ধরতেই দেখা দিল বিপত্তি। হাত ধরে গাড়িতে তুলতে চাইলে সে ওঠে না। জোর করা হয়, এরপরও সে ওঠে না। ফুটপাতের গ্রিল আঁকড়ে ধরে আছে। মুখ দিয়েও কিছু বলে না। একপর্যায়ে ডিবির এক সদস্য তাকে সজোরে টান দেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছেলেটি পকেটে রাখা ব্লেড বের করে নিজের গলায় পোচ দেয়। বয়স বেশি নয়, ১৩ কিংবা ১৪ বছরের শিশু। সঙ্গে সঙ্গে তাকে হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। বাকিদের নেয়া হয় ডিবি কার্যালয়ে।
ঘটনাটি চলতি বছরের ১৭ মে’র। রমজান মাস, চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা এমনিতেই বেশি হয় এ সময়। অপরাধীদের তৎপরতা বন্ধে বিভিন্ন স্থানে হানা দিচ্ছে ডিবিসহ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট। রমজান মাসের শুরু থেকে ১৭ মে পর্যন্ত অর্ধশতাধিক ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করে তারা। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন মাদক চোরাকারবারিও রয়েছে। রয়েছে ছিনতাই চক্রের ৩৮ সদস্যও। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে শিশু অপরাধী চক্রের সন্ধান পান ডিবি সদস্যরা। তাদের যোগসাজশে রাজধানীতে বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে- এমন পাঁচ-ছয় পথশিশুর নামও তদন্তে বেরিয়ে আসে। যাদের বয়স ১২ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে।
সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে পলাশীতে অভিযান পরিচালনা করেন ডিবি সদস্যরা। ঘটনাস্থল থেকে চার শিশুকে তুলে আনা হয়। রাতে তাদের রাখা হয় মিন্টো রোড ডিবি কার্যালয়ে।
তাদের মধ্যে দুই শিশুকে একসঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদ করে ডিবি। একজনের বাড়ি কিশোরগঞ্জ, আরেকজনের রংপুর। তোমরা কী কর? এক শিশুকে প্রশ্ন করা হয়। উত্তর সে জানায়, মালিকের কাজ করি। কী কাজ কর? ‘কখনো চুরি করি, মাল সাপ্লাই দেই’- বলে সে। কী মাল? ‘ইয়াবা, গাঁঞ্জা।’
এর বদলে তোমরা কী পাও? শিশুটির উত্তর, ‘খাইতে দেয়, নেশা করতে দেয়, আবার কিছু টাকাও দেয়।’
জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে চারজনকে একসঙ্গে করা হয়। ডিবি কর্মকর্তাদের প্রশ্ন, তোমরা কি এ কাজের জন্য অনুতপ্ত? সবাই বললো, ‘জ্বী স্যার।’ আর কখনও করবে এমন কাজ? দুজন বললো, ‘না স্যার’। বাকি দুজন কিছুই বললো না। তাদের একজন অস্বাভাবিক আচরণ করতে লাগলো।
হঠাৎ করেই কাস্টডিতে ডিবি কর্মকর্তাদের কাছে গাঁজা চাইলো সে। কর্মকর্তা তার এমন আবদার হেসে উড়িয়ে দিলেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আক্রমণাত্মক হয়ে পড়ে শিশুটি। আত্মহত্যা করবে বলে হুমকি দেয়।
শিশুটির জীবন বাঁচাতে একপর্যায়ে তাকে বেঁধে ফেলা হয়। সারারাত জেগে শিশুটিকে পাহারা দেন ডিবি সদস্যরা। পরদিন তাদের তোলা হয় আদালতে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, রাস্তায় এমন অনেক মাদকাসক্ত পথশিশুকে আমরা দেখি কিন্তু গ্রেফতার করি না। তাদের সংশোধনের উদ্যোগ নেই। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি আলাদা। তারা ভয়াবহ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এ কারণে ইচ্ছা থাকলেও তাদের আর ছাড় দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ভবিষ্যতে পথশিশুদের ওপর নজরদারি আরও বাড়ানো হবে- জানান তিনি।
ডিবির হাতে আটক ওই চার শিশুই নয়, ঢাকায় অধিকাংশ পথশিশুকে নিয়ে চলছে ভয়ঙ্কর ও অমানবিক নানা ‘খেলা’। শুধু শিশু নয়, মানুষরূপী কিছু পশুশিশুর পাশাপাশি পঙ্গু-প্রতিবন্ধীদের দিয়েও চুরি, ছিনতাই, মাদক কেনা-বেচাসহ নানা ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।
ওই চক্রের ৩৮ সদস্যকে গ্রেফতারের পর তাদের বিরুদ্ধে নিউমার্কেট থানায় একটি মামলা করে ডিবি। তদন্তে জানা যায়, ওই চক্রের মূলহোতা মূলত এলাকাভিত্তিক পথশিশুদের টার্গেট করে। পথশিশুদের চাহিদা অনুযায়ী কাউকে টাকা, কাউকে ড্যান্ডি (একধরনের মাদক), কাউকে গাঁজা অথবা সিগারেট কিনে দিয়ে নিজের দলে ভেড়ায়। নিয়মিত তাদের কাছে মাদক সরবরাহ করা হয়। সপ্তাহ বা মাসখানেক পর যখন তারা আসক্ত হয়ে পড়ে তখন মাদকের বিনিময়ে তাদের দিয়ে চুরি, ছিনতাই, মাদক পরিবহনসহ নানা অপরাধমূলক কাজে লাগানো হয়।
আসামিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পথশিশু নিয়োগে তাদের প্রধান টার্গেট সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল। সেখানে প্রতিনিয়ত লঞ্চে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে শিশুরা আসে।
সরেজমিন সদরঘাটে গিয়ে এমন শতাধিক পথশিশু চোখে পড়ে। তাদের কেউ পলিথিন, কেউ পানির বোতল টোকাচ্ছে। কেউ সিগারেট খাচ্ছে, কেউ অন্যের কাছে হাত বাড়িয়ে ভিক্ষা চাইছে।
ছয় মাস ধরে সদরঘাটে আছে এমন চার-পাঁচ শিশুর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের একজন মালিক আছে। নাম রহিম মিয়া। রহিম টার্মিনালের জেটির পাশেই কুঁড়েঘরে থাকে। ২০-২৫ শিশু রহিমকে বোতলসহ নানা জিনিসপত্র সংগ্রহ করে দেয়। রহিম সেগুলো বিক্রি করে তাদের ভাত খেতে দেয়। এছাড়া ঢাকায় আসা মানুষের কাছ থেকে ভিক্ষা করে কিছু টাকা জমিয়ে মাঝে মাঝে ড্যান্ডি, সিগারেট বা অন্যান্য মাদক সেবন করে তারা।
শিশুদের সঙ্গে কথা বলার একপর্যায়ে জানা গেল, ছয় মাস হলো তাদের সঙ্গে থাকা আশিক ও ফয়সাল নামে দুই শিশুর খোঁজ মিলছে না। তারা কোথায় জানতে চাইলে শিশুরা বলে, ওরা এখানে থাকে না, মাঝে মাঝে এসে আমাদের সঙ্গে খায় (মাদক সেবন)। ওরা নাকি এক স্যারের সঙ্গে কাজ করে, খুব আরামে থাকে। খাওয়াও নাকি ভালো পায়। নুরা নামে আরেক শিশুও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। এখন তারও খোঁজ মিলছে না।
গ্রেফতার ৩৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ জানতে পারে, ওই চক্রের মূলহোতা আব্দুস সালাম। কে এই আব্দুস সালাম? তাকে ঘিরে এখন নানা প্রশ্ন!
নিউমার্কেট থানার একটি নথি ঘেঁটে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেখতে পায়, আব্দুস সালাম পেশায় একজন ছিনতাইকারী। বাড়ি বরিশালের কাজিরহাট উপজেলার আজিমপুর মিয়া বাড়ি এলাকায়। একসময় অস্ত্র দেখিয়ে ছিনতাই করলেও ধীরে ধীরে নিজের ‘অপকর্মের ব্যবসা বড় করেছে সে। নিজেই এখন ‘বস’ সেজে শিশু আর প্রতিবন্ধীদের দিয়ে অপরাধ করাচ্ছে। কয়েক বছর ধরে সে এই কাজে সম্পৃক্ত। তার নামে রাজধানীর কয়েকটি থানায় মামলাও রয়েছে।
চুরি, ছিনতাই আর মাদক চোরাকারবারিতে যুক্ত থাকায় একাধিকবার কারাগারে যায় আব্দুস সালাম। কিন্তু প্রতিবারই আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে জামিন বের হয়ে আসে সে। বরিশালসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে ছোটখাটো অপরাধী আর মাদকসেবীদের সংগঠিত করে ৫০ জনের একটি শক্তিশালী চক্র তৈরি করেছে সালাম। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন পথশিশুও রয়েছে। এখন সে তাদের ‘বস’। ইতোমধ্যে ওই চক্রের ৩৮ জনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বাকিদের খুঁজতে চলছে অভিযান।
আটক ওই শিশুদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, তারা কেউই বসকে (আব্দুস সালাম) চোখে দেখেনি। তারা ইকবাল নামে একজনের কথায় কাজ করে। ইকবাল সালামের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। তারা মাদক আনা-নেয়ার কাজ করলেও অনেক শিশুকে দিয়ে ভিক্ষাও করায়।
গ্রেফতার ৩৮ আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদে ডিবি জানতে পারে, প্রথমদিকে অল্পসংখ্যক শিশুকে দিয়ে মাদক সরবরাহের কাজ করালেও বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ এড়াতে শুধু প্রতিবন্ধী ও পঙ্গুদের এ কাজে নিয়োগ দিচ্ছে আব্দুস সালাম।
ডিবির ওই অভিযানে ইকবাল হোসেন নামে ২৮ বছরের এক পঙ্গু (বাম পা নেই) যুবককে গ্রেফতার করা হয়। স্ট্রেচারে ভর দিয়ে হাঁটে সে। তাকে গ্রেফতারের সময় মায়া হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। অনেকে তাকে ছেড়ে দেয়ার অনুরোধও জানায়। তার হাঁটার ধরন দেখলে যে কারও মায়া লাগবে। তবে তার আঙুলের ছাপ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রিমিনাল ডাটাবেজে দেয়া হলে বেরিয়ে আসে ভয়ঙ্কর এক সন্ত্রাসীর চরিত্র।
কয়েক বছর আগে ছিনতাইয়ের সময় র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয় ইকবাল হোসেন। গুলি তার বাম পায়ে লাগে। প্রাণে বেঁচে গেলেও তার ওই পা কেটে ফেলতে হয়। কয়েক মাস কারাগারে থাকার পর বের হয়ে আবারও ছিনতাইয়ের কাজে জড়িয়ে পড়ে সে।
গ্রেফতার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে ডিবি জানতে পারে, ভয়ঙ্কর এ চক্রের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ইকবাল হোসেন। লোকচক্ষুর আড়ালে থাকলেও মাঠে থেকে কর্মীদের সব নির্দেশনা দেয় সে। পঙ্গুত্বের কারণে তাকে কেউ সন্দেহ করবে না, তাই সালাম এত বড় পদ দিয়েছে তাকে।
চক্রটি সম্পর্কে ডিএমপির সিরিয়াস ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের অর্গানাইজড ক্রাইম প্রিভেনশন টিমের এসি নাজমুল হক বলেন, ‘চক্রটি এমন শ্রেণির লোকজনকে নিয়োগ দেয় যাদের কেউ অপরাধী বলে বিশ্বাস করতে চাইবে না। চক্রের ৩৮ সদস্যকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠানোর আগ পর্যন্ত আমাদের প্রচুর বেগ পেতে হয়েছে। আসা করছি, বাকি সদস্যদের ধরে চক্রটি নির্মূল করতে পারব।’
ওই ঘটনায় নিউমার্কেট থানায় দায়ের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা একই বিভাগের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোসলেহ উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, চক্রটি নিষ্পাপ শিশুদের ব্যবহার করে অত্যন্ত জঘন্য কাজ করছে। চক্রের ৩৮ সদস্যকে গ্রেফতারে সক্ষম হয়েছি। এখনও বেশ কয়েকজন সদস্য পলাতক। আশা করি শিগগিরই তাদের ধরতে পারব। তাদের ধরতে পারলে মামলাটি সফলতার সঙ্গে শেষ করতে পারব।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন