২০১৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। ২২ বছর বয়সী রাসেল মায়ের কাছে থেকে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে চাকরির সন্ধানে ঢাকায় আসে। কৃষকের ছেলে রাসেল নিজেও তার গ্রামের বাড়িতে কৃষিকাজ করত। তবে ঢাকায় আসার মাস খানেক পরে তার মা ফোনে জানতে পারেন যে, রাসেলকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে। তবে কে বা কারা করেছে, সেটা কেউই জানাতে পারেনি।
ওই সময় বলা হয়েছিল, তাকে ছিনতাইকারী চাকু মেরেছে। ঘটনার পরে মা রাশিলা বেগম (৪০) নিজেই বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেছিল কদমতলী থানায়।মামলা নং-১৯ তারিখ-১৩/১০/২০১৫।
কিন্তু উক্ত মামলায় কদমতলী থানা পুলিশ তদন্ত শেষে ২০১৭ সালের ১৬ সেপ্টম্বর আদালতে রিপোর্ট দেয় যে, ঘটনাটি পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারার অপরাধ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হলেও কে বা কারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত তা উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে নিহত রাসেলের মা চুড়ান্ত রিপোর্টের বিরুদ্ধে আদালতে না-রাজির আবেদন করেন। এরপর আদালতের আদেশে মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে পিবিআইয়ের ঢাকা মেট্রো (উত্তর) এর এসআই মো. আল-আমিন শেখ।
পিবিআই মামলার তদন্ত শুরু করার পরেই বেরিয়ে আসে হত্যার রহস্য। একই সঙ্গে হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে পিবিআই। পরবর্তীতে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত পাঁচজনকে সাম্প্রতিক সময়ে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত সর্বশেষ আসামি মো. জুয়েল ওরফে পিচ্চি জুয়েল ওরফে কালুকে গত ২০ মে গ্রেপ্তার করেছে পিবিআই ঢাকা মেট্রোর (উত্তর)এসআই মো. আল-আমিন শেখ। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এ ছাড়াও মামলার নথীপত্র ও পিবিআই ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) পরিদর্শক জুয়েল রানার দেওয়া তথ্যমতে এসব বিষয় জানা গেছে। তিনি জানান, এই মামলায় গ্রেপ্তার অন্য আসামিরা হলেন, সজল ওরফে পিচ্চি সজল, মো. হোসেন বাবু ওরফে হুন্ডা বাবু, সজল পিংকি ও তার স্বামী জহিরুল হক ওরফে সানু।
যেভাবে মৃতপুরীতে পৌঁছেছিল রাসেল
মামলার এজাহার ও পিবিআই সূত্রে জানা যায়, শুধু মাত্র একটি চাকরির খোঁজে গ্রামের কৃষিকাজ ছেড়ে ঢাকায় এসেছিল রাসেল।আর ঢাকায় আসার পরে কদমতলী এলাকার পারভেজ, সজলদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল। প্রায়ই সে তাদের সঙ্গে আড্ডা দিত। তাই স্বাভাবিকভাবেই ঘটনার দিন রাতে তারা রাসেলকে বলেছিল, চল এক জায়গা থেকে ঘুরে আসি। তখন আগে পিছে না ভেবে রাসেল তার সঙ্গে এক বাসায় যায় । আর সেই বাসাতেই হামলার শিকার হয়ে নির্মমভাবে মারা যায় সে।
বেঁচে যায় টার্গেট-প্রাণ হারায় নিরীহ
পিবিআই সূত্রে জানা যায়, কদমতলী এলাকার পিংকি নামের এক মাদক সম্রাজ্ঞী ও পারভেজ নামক এক মাদক ব্যবসায়ীর মধ্যে প্রভাব বিস্তার নিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ বিরোধ চলে আসছিল। এর জেরেই মাদক সম্রাজ্ঞী পিংকি পারভেজকে খুন করার জন্য গ্রেপ্তার আসামি বাবু ওরফে হুন্ডা বাবু ও পিচ্ছি সজলদের ভাড়া করেছিল। তাদের মূল টার্গেট ছিল পারভেজকে হত্যা করা। কিন্তু ঘটনাক্রমে ওইদিন সে ঘরে উপস্থিত ছিল রাসেল। তাই পারভেজের পাশাপাশি রাসেলকেও চাকু দিয়ে আঘাত করেছিল হত্যাকারীরা।
পিবিআইয়ের পরিদর্শক জুয়েল রানা বলেন, ‘হত্যাকারীদের মূল টার্গেট ছিল পারভেজকে হত্যা করা। সে অনুযায়ী তারা পারভেজের ওপরে এলোপাতাড়ি চাকু দিয়ে আঘাত করে। তবে গায়ে ৭০ টি চাকুর আঘাত খেয়েও প্রাণে বেঁচে যায় পারভেজ। আর প্রাণ হারায় রাসেল।
ইয়াবা সেবনের পর হত্যার মিশন
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আল-আমিন ও গ্রেপ্তার আসামিদের আদালতে দেওয়া জবানবন্দি সূত্রে জানা যায়, মাদক সম্রাজ্ঞী পিংকি নিজেই পিচ্ছি সজল ও হুন্ডা বাবুদের ভাড়া করে পারভেজকে হত্যা করতে। সে অনুযায়ী তারা পারভেজকে খুন করতে পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এরপর পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ঘটনার দিন রাতে অর্থাৎ গত ২০১৫ সালের ১০ অক্টোবর রাত ১১টার সময় ঘটনাস্থলে আসামি পিচ্ছি সজল, হুন্ডা বাবু, জুয়েল, আল-আমিনসহ পিংকি এবং তার স্বামী জহিরুল হক উপস্থিত হয়।তখন কৌশলে পারভেজ ও ভিকটিম রাসেলকেও সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর পিচ্চি সজল ও হুন্ডা বাবু অন্যান্যদের নিয়ে একসঙ্গে ইয়াবা সেবন শুরু করে।
তাদের পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী, ইয়াবা সেবন শেষে আসামি পিচ্চি সজল, হোন্ডা বাবুরা তাদের কোমড়ে থাকা চাকু দ্বারা এলোপাতাড়িভাবে পারভেজ ও রাসেলকে ছুরিকাঘাত করা শুরু করে। এ সময় সেই ঘরটি ছিল অন্ধকার।তারা দুজনকে চাকু দিয়ে আঘাত করে ঘটনাস্থল থেকে সবাই পালিয়ে যায়।
মোবাইলে ছেলের মৃতুর খবর পায় মা
ঘটনার বর্ণনা থেকে জানা যায়, ঘটনার রাতে গুরুতর রক্তাক্ত পারভেজ ও রাসেলের ডাক চিৎকার শুনে স্থানীয় লোকজন এসে তাদের উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসারত অবস্থায় রাসেল মারা যায়। পরের দিন রাসেলের মা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সংবাদ পান যে, রাসেল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুরিকাঘাতে আহত হয়ে মারা গেছে। তখন রাসেলের মা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে গিয়ে ডান পাজরে পিঠের দিকে ব্যান্ডেজ অবস্থায় তার ছেলের লাশ শনাক্ত করেন।
যেভাবে গ্রেপ্তার হলো আসামিরা
পিবিআই সূত্রে জানা যায়, পিবিআই ঢাকা মেট্রোর(উত্তর) এর এসআই মো. আল-আমিন শেখ মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করেন। এরপর ক্লু-লেস রাসেল হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনের জন্য ভিকটিমের গ্রামের বাড়ি খুলনা কদমতলী এলাকায় তদন্ত শুরু করেন তিনি।
প্রাথমিক তদন্তের পরে, হত্যাকান্ডের ঘটনায় জড়িত আসামি পিচ্চি সজল, হুন্ডা বাবু ও সজলকে গ্রেপ্তার করেন তিনি। পরে গ্রেপ্তার তিন আসামি ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে। ওই জবানবন্দিতে তারা বলে, হত্যাকান্ডের ঘটনায় পিংকি ও তার স্বামী জহিরুল হক জড়িত আছে। আর হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত তিনটি চাকু পিংকি নিজেই সরবরাহ করেছিল বলে জানায় তারা।
আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির পরে পিবিআই ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদারের তত্ত্বাবধানে ও দিক-নির্দেশনায় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আল-আমিন শেখ ১১ মে আসামি পিংকি আক্তার (২৫) ও তার স্বামী জহিরুল হককে সিএমপি চট্টগ্রাম এর ইপিজেড থানা এলাকা হতে গ্রেপ্তার করে।
হত্যা ও মাদকের একাধিক মামলা ছিল পিংকি-জহির দম্পতির
আটককৃত আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে পিবিআই জানায়, এই পিংকি-জহিরুল হক দম্পতি মূলত শ্যামপুর এলাকার বাসিন্দা। তবে তারা ঘন ঘন ঠিকানা পরিবর্তন করে। আসামি পিংকি পূর্বে দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ, তারপর কদমতলী ও বর্তমানে শ্যামপুর এলাকায় বসবাস করছে। কদমতলী, শ্যামপুর ও দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ থানা এলাকার মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায়ী। পিংকি আক্তার ও তার স্বামী জহিরুল হকের বিরুদ্ধে খুন, হত্যাচেষ্টা ও মাদকসহ একাধিক মামলা রয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন