ইয়াবা সিন্ডিকেটে যুক্ত পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে এখন নিজের জীবন নিয়েই শঙ্কায় আছেন পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) বশির আহাম্মেদ। ওই সিন্ডিকেটের অদৃশ্য ইশারায় গত এক বছরে তাকে চার দফা বদলি করা হয়েছে। যে কোনো সময় প্রাণে মেরে ফেলা হতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন তিনি।
তাই স্ত্রী-সন্তানসহ নিজের প্রাণ বাঁচাতে ঊর্ধ্বতনদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন এ পুলিশ কর্মকর্তা। কক্সবাজারে ইয়াবা উদ্ধারের পর ডিবির এসআই বশির আহম্মাদ মুঠোফোনে এবং পুলিশ পরিদর্শক সুকেন্দ্র চন্দ্র সরকার নিজে এসপি একেএম ইকবাল হোসেনের সঙ্গে দেখা করে জানান, অভিযানে ৭ লাখ ৩০ হাজার ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করা হয়েছে।
কিন্তু ডিবির এসআই জাবেদ আলম বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় যে মামলা করেন, তাতে ১০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার দেখানো হয়। এ ঘটনায় গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আমাদের সময়ে ‘৭ লাখ ইয়াবা ৮ কোটিতে বিক্রি’ শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এর পর বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয় পুলিশ প্রশাসন ও কক্সবাজারের স্থানীয়দের মধ্যে।
প্রতিবেদনের সূত্র ধরে পুলিশ সদরদপ্তর ও কক্সবাজার জেলা পুলিশ পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। দীর্ঘ চার মাস ধরে চলা তদন্তে পুলিশের ইয়াবা কারবারের আদ্যাপান্ত উঠে আসে। কমিটি জানতে পারে, ওই সময় আসলে ১০ লাখ ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছিল। আর জব্দ তালিকায় মাত্র ১০ হাজার পিস দেখিয়ে বাকি ৯ লাখ ৯০ হাজার ইয়াবা আত্মসাৎ করা হয়।
পরে তা একজন মাদক ব্যবসায়ীর মাধ্যমে বিক্রি করে দেওয়া হয়। আর এ ঘটনার সঙ্গে কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) ড. একেএম ইকবাল হোসেনসহ জেলা পুলিশের শীর্ষ ৯ কর্মকর্তার সম্পৃক্ততার প্রমাণ মেলে। এর পর যথাক্রমে গত ৯ এপ্রিল ‘সবই জানতেন এসপি ইকবাল’ এবং ৫ জুলাই ‘কাঠগড়ায় ৯ পুলিশকর্তা’ শিরোনামে পৃথক দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় আমাদের সময়ে।
ইয়াবা বিক্রির টাকা ভাগাভাগি করে নেওয়া অভিযুক্ত ওই ৯ কর্মকর্তাসহ ১২ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বর্তমানে তিনটি বিভাগীয় মামলা চলমান। সেই সঙ্গে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় তাদের সবাইকে। অভিযুক্তরা হলেন কক্সবাজারের তৎকালীন পুলিশ সুপার (এসপি) ড. একেএম ইকবাল হোসেন, উখিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার চাইলাউ মারমা, সদরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আফরুজুল হক টুটুল, জেলা ডিবির তৎকালীন ওসি মো. মনিরুল ইসলাম, পরিদর্শক সুকেন্দ্র চন্দ্র সরকার, এসআই মো. কামাল হোসেন, এসআই মো. মাসুদ রানা, এসআই মো. জাবেদ আলম, এএসআই মো. মাসুম মিয়া তিতাস, কনস্টেবল মো. মোবারক হোসেইন, মো. রুবেল হোসেন ও মো. কেফায়েত উল্লাহ।
এ ঘটনায় গত বছরের ৬ আগস্ট কক্সবাজারের পুলিশ সুপার ইকবাল হোসেনসহ চার পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কেন দ্রুত বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ১০ লাখ পিস ইয়াবা বেচা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, রুলে তা-ও জানতে চান আদালত। পুলিশ সদর দপ্তরে এ ঘটনায় প্রথম অভিযোগ করেছিলেন কক্সবাজার জেলা ডিবির তৎকালীন এসআই বশির আহম্মেদ।
তাই ইয়াবা কেলেঙ্কারির ঘটনায় পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ অনেকে ফেঁসে গেলে এসআই বশিরের ওপর চড়াও হন তাদের কেউ কেউ। ওই ঘটনার পর থেকে এক বছরের মধ্যে তাকে ফেনী জেলা, নোয়াখালী পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার ও রাঙামাটি জেলায় চার দফায় বদলি করা হয়। সেই সঙ্গে কক্সবাজারের তৎকালীন এসপি ইকবাল হোসেন সদ্য প্রত্যাহার হওয়া ফেনীর এসপি জাহাঙ্গীর আলম সরকারকে চিঠি দিয়ে বশির আহাম্মেদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেন।
ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বশির আহাম্মেদের বিরুদ্ধে ইয়াবা সম্পৃক্ততার ‘জনশ্রুতি’ রয়েছে। তাই নিজের নিরাপত্তাহীনতার কথা জানিয়ে প্রথমে কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপারের কাছে অভিযোগ করেছিলেন বশির আহাম্মেদ। কিন্তু গত এক বছরেও বিষয়টির কোনো সুরাহা করেনি কক্সবাজার জেলা পুলিশ। সর্বশেষ গত ৯ মে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আইজিপি বরাবর নিজের নিরাপত্তা চেয়ে একটি অভিযোগ জমা দিয়েছেন তিনি।
নিজের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে যাদের কথা বলছেন, তাদের মধ্যে পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তাদের নামও রয়েছে। অভিযোগপত্রে এ পুলিশ কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, তাকেও ফেনীর কলেজছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির মতো আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হতে পারে। বশির আহাম্মেদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘স্ত্রী-সন্তানসহ নিজের প্রাণনাশের আশঙ্কা নিয়ে আতঙ্কে দিন পার করছি।
জেলা ও রেঞ্জের সিনিয়র স্যারদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনো সাহায্য পাচ্ছি না। শেষমেশ আইজিপি স্যার ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের হস্তক্ষেপে আমরা রক্ষা পাওয়ার আকুতি জানাই।’ তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক আমাদের সময়কে বলেন, ‘ইয়াবা কেলেঙ্কারির ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চলমান। আর বশির যে ভয়ে আছেন, এমন কোনো বিষয় আমাদের জানাননি।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন