দেশের রাজনীতিতে শিগগিরই কিছু পট পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং রাজনীতির মাঠে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচিত বিএনপির শীর্ষপর্যায়ে এক ধরনের সমঝোতার আভাস দেখা যাচ্ছে। ইস্যু দুর্নীতির মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারামুক্তি।
এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের আলোচনা চলছে। যদি সমঝোতা হয়, তবে প্যারোলে কিংবা জামিনে মুক্তি পেতে পারেন খালেদা জিয়া। এক্ষেত্রে প্রধান অনুঘটক হতে পারে একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির হয়ে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ করার বিষয়টি। কিছুদিনের মধ্যেই তাই বেশকিছু নাটকীয় ঘটনা ঘটতে পারে।
যদিও এ সমঝোতা নিয়ে আলোচনার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মুখ খুলছেন না আওয়ামী লীগ বা বিএনপির দায়িত্বশীল কোনো নেতাই। তারা বরং বলছেন, খালেদা জিয়ার কারামুক্তির সঙ্গে বিএনপির নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহনের কোনো সম্পর্কই নেই। জানা গেছে, প্যারোলে খালেদা জিয়ার মুক্তির পক্ষে আওয়ামী লীগ। আর বিএনপি চায় তাদের শীর্ষনেত্রী জামিনে মুক্ত হোক। বিষয়টি কোনদিকে গড়াচ্ছে অল্প সময়ের মধ্যেই তা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
কারণ, ২৯ এপ্রিলের মধ্যে শপথ নিতে হবে ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী সাংসদদের অথবা শপথ নেওয়ার জন্য আরও সময় চেয়ে আবেদন করতে হবে। নয়তো তাদের সংসদ সদস্যপদ শূণ্য ঘোষণা করতে হবে। আওয়ামী লীগের শীর্ষপর্যায়ের সূত্রের খবর, সমঝোতা হলে খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠানো হবে। এর অন্যথা হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসার পর তাকে কাশিমপুর কারাগারে স্থানান্তর করা হবে। নাজিমউদ্দীন রোডের অস্থায়ী কারাগারে খালেদা জিয়ার ফেরার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। ২৯ এপ্রিলের আগেই তাই তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কি করবেন? দেশের বাইরে যাবেন, না কাশিমপুর কারাগারে? নাজিমউদ্দীন রোডের অস্থায়ী কারাগারে সরকার অন্য স্থাপনা তৈরির পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। সেখানে আর ফেরা হচ্ছে না তার, এটা মোটামুটি নিশ্চিত।
এদিকে একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে জয়ী ৬ জনের মধ্যে একজন গতকাল বৃহস্পতিবার শপথ নিয়েছেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়া অন্যরা শপথ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত, বলছে সরকারের একাধিক সূত্র। খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই তার মুক্তি দাবি করে আসছে বিএনপি। কিন্তু দলটির চেয়ারপারসনকে জামিনে মুক্তি দিতে নারাজ সরকার।
সরকারের নীতি নির্ধারনী পর্যায়ের নেতারা মনে করেন, খালেদা জিয়া যদি দোষ স্বীকার করে প্যারোলের আবেদন করেন, সেক্ষেত্রে বিষয়টি ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করতে পারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব চায় নিঃশর্তে খালেদা জিয়ার জামিন। তারা বলছেন, খালেদা জিয়াকে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া হলে তাদের দলীয় এমপিরা শপথ নেবেন।
যদিও খোদ খালেদা জিয়াই প্যারোল ও শপথ এ দুটো বিষয়ই নাকচ করে দিয়েছেন বাংলা নববর্ষে তার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া বিএনপি নেতাদের সঙ্গে আলোচনার সময়। গত মঙ্গলবার বিএনপি স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, খালেদা জিয়ার প্যারোল চাওয়া হবে না, শপথও নেবেন না তাদের এমপিরা। এর পরও গতকাল জাতীয় সংসদে গিয়ে স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরীর কাছে শপথ নিয়েছেন ঠাকুরগাও-৩ আসন থেকে বিএনপির হয়ে নির্বাচিত সংসদ সদস্য জাহিদুর রহমান।
এরও আগে, একাদশ নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন নির্বাচনী জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দুই সংসদ সদস্যও শপথ নিয়েছেন। তারা ঐক্যজোটের শরীক দল গণফোরামের সদস্য। গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে আটজন সাংসদ নির্বাচিত হন। এর মধ্যে বিএনপির ছয়জন, গণফোরামের দুজন। বিএনপির এমপিদের শপথ নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় আমাদের সময়কে বলেন, দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে শপথ নেওয়া হলে দল সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে।
জাহিদুর রহমানের শপথ নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি জানান, বিষয়টি দল দেখবে। পৃথক এক প্রশ্নে তিনি খালেদা জিয়ার কারামুক্তি ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে বিএনপির সমঝোতার বিষয়টি অস্বীকার করেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক সূত্রের খবর, একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই খালেদা জিয়ার কারামুক্তির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টার সঙ্গে এ ইস্যুতে দরকষাকষি করছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য আমাদের সময়কে বলেন, বিএনপির নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের উচিত শপথ নিয়ে সংসদে যোগ দেওয়া। তারা না এলে তা হবে ভোটারদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা। খালেদা জিয়ার কারামুক্তি নিয়ে দুই দলের সমঝোতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমন খবর আমিও শুনেছি। তবে সঠিক কী না, বলতে পারব না।
আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেন, বিএনপির যে সংসদ সদস্য আজ শপথ নিয়েছেন তাকে আমরা ধন্যবাদ জানাই। আমরা আশা করছি কিছুদিনের মধ্যে বিএনপির বাকি সদস্যরাও শপথ নেবেন। তবে এ শপথের সঙ্গে খালেদা জিয়ার কারামুক্তির কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানান তিনি।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান আমাদের সময়ের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, বিএনপির এমপিদের শপথ নেওয়ার সঙ্গে খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির কোনো সর্ম্পক নেই। শর্ত জুড়ে দিলে সেটা রাজনৈতিক প্যারোল হয়ে যাবে। রাজনৈতিক প্যারোল নয়, স্বাস্থ্যগত কারণে খালেদা জিয়া কোনো আবেদন করলে সরকার সেটা নৈতিকভাবেই বিবেচনা করবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এক নেতা এবং সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য আমাদের সময়কে বলেন, বিএনপির ৬ এমপির মধ্যে ৫ জনই শপথ নিয়ে সংসদে যোগ দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শপথ নেবেন কী না-সেটার নির্ভর করবে বিএনপির রাজনীতিতে তার ভবিষ্যত গন্তব্যের উপর।
তিনি আরও বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। বিএনপি চায় জামিন, আমরা চাই প্যারোল। দুএকদিনের মধ্যে এর সুরাহা হতে পারে। তিনি যোগ করেন, এমনও হতে পারে যে, চিকিৎসকদের পরামর্শে খালেদা জিয়া লন্ডন যাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে প্যারোলের বিষয়টি গোপন রাখা হতে পারে। কারণ বিএনপি চায় তাদের নেত্রীর ‘আপোসহীন’ ভাবমূর্তি ধরে রাখতে। অন্য এক সূত্রের খবর, খালেদা জিয়ার লন্ডন যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবে তিনি সৌদি আরবও যেতে পারেন। এটা নির্ভর করবে কোথায় তিনি স্বাচ্ছন্দবোধ করেন, এর ওপর।
প্রসঙ্গত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দায়ের করা জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়ে খালেদা জিয়া এখন কারাগারে। তাকে ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বিএনপি, শুরুতে এটা বললেও শেষ পর্যন্ত একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় দলটি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন