বুলেটের চিহ্ন আর নেই। নেই ছোপ ছোপ রক্তের দাগও। কংক্রিটের মেরামতে সেরে উঠেছে দেহের ক্ষত। রঙের প্রলেপে সব এখন চকচকে। ঢেকে গেছে শোক। ধুয়ে-মুছে সব ঝকঝকে।
হ্যাঁ, দেহের ক্ষত সারিয়ে প্রস্তুত মসজিদ আল-নূর। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের এই মসজিদে আগামীকাল শুক্রবার হবে জুমার নামায। এর মধ্যদিয়ে এক সপ্তাহ পর মসজিদটি খুলে দেয়া হচ্ছে।
গত সপ্তাহেই (১৫ মার্চ) এখানে ঘটে নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসের ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ। জুমার নামায আদায়ের সময় বন্দুকধারী ব্রেনটন টারান্ট স্বয়ংক্রিয় বন্দুক দিয়ে নির্বিচারে গুলি চালালে পাঁচ বাংলাদেশিসহ ৫০ জন নিহত হন। গুলিবিদ্ধ হয়ে এখনও হাসপাতালে মৃত্যুর প্রহর গুণছেন ৪৮ জন।
হামলার পরপরই ক্রাইস্টচার্চের আল-নূর ও লিনউড মসজিদ বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর মেরামত শেষে আগামীকাল জুমার নামায দিয়ে মসিজদ দুটি আবার চালু হচ্ছে।
ইতোমধ্যে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডার্ন মুসলিমদের এখানে জুমার নামায আদায়ের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি এই নামায সরাসরি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সম্প্রচারের ঘোষণা দিয়েছেন। সেখানে দুই মিনিট নীরবে দাঁড়িয়ে নিহতদের স্মরণ করার কথাও বলেছেন সর্বকনিষ্ঠ এই প্রধানমন্ত্রী।
ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশের মুসলিমরা নিউজিল্যান্ডে গেছেন। অনেকেই পথে রয়েছেন জুমার নামাযে শরিক হতে। বলা চলে জুমার নামায পড়তে ক্রাইস্টচার্চে বিভিন্ন দেশের মুসলিমদের ঢল নেমেছে।
ক্রাইস্টচার্চের আল-নূর মসজিদের চারপাশে পুলিশ সশস্ত্র অবস্থান নিয়েছে। বৃহস্পতিবার পুলিশের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, শুক্রবার যারা প্রার্থনায় আসবেন, তাদের আশস্ত করছি— আমাদের সর্বোচ্চ সতর্ক উপস্থিতি থাকবে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, নৃশংসতার পর পুলিশ যত ধরনের সম্ভব, আলামত সংগ্রহ করেছে। মুসল্লিরা যাতে দ্রুত মসজিদে আগের মতো আসতে পারেন, সেজন্য নিরলসভাবে কাজ করা হয়েছে।
আল-নূরের সঙ্গে এদিন লিনউড মসজিদও খুলে দেয়া হচ্ছে। জুমার নামাযে হাজারো মুসল্লির উপস্থিতি কামনা করা হচ্ছে, যাদের আপনজন ১৫ মার্চের হামলায় নিহত ও আহত হয়েছেন।
হতাহতদের বেশিরভাগই বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, সোমালিয়া ও আফগানিস্তানের অভিবাসী এবং শরণার্থী ছিলেন।
ব্রিটিশ দ্য গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়েছে, শুক্রবার জুমার নামাযে অংশ নিতে বিভিন্ন দেশ থেকে বহু মুসলিম নিউজিল্যান্ডে এসেছেন।
আল-নূর মসজিদের ইমাম জামাল ফাওদা জানিয়েছেন, জুমার নামাযে তিন থেকে চার হাজার মুসল্লি অংশ নেবেন। এদের অনেকেই বিভিন্ন দেশ থেকে নিউজিল্যান্ডে এসেছেন।
মসজিদ বরাবর হ্যাগলি পার্কে এদিন জুমার নামায হবে বলেও জানান তিনি।
ইমাম জামাল ফাওদা আরও বলেন, ‘মসজিদের কর্মীরা দিনরাত কাজ করে মসজিদের ক্ষত মেরামত করেছেন। নতুন কার্পেট বসানো হয়েছে। রক্তাক্ত কার্পেটগুলোকে কবরের সঙ্গে দেয়া হচ্ছে।’
বৃহস্পতিবার পুলিশ জানিয়েছে, নিহত সবার পরিচয় সনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে অনেকের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
পুলিশ কমিশনার মাইক বুশ বলেন, ‘নিহত সবাইকে সনাক্ত করা হয়েছে। এরপর দাফনের বিষয়ে তাদের স্বজনদের বলা হয়েছে।’
বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডার্ন দেশটিতে আধা-স্বয়ংক্রিয় ও অ্যাসল্ট রাইফেল নিষিদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন।
তিনি বলেন, আগামী ১১ এপ্রিল অস্ত্র নিষিদ্ধ সংক্রান্ত নতুন আইন উপস্থাপন করা হবে। সেইসঙ্গে নিষিদ্ধ করা যেসব অস্ত্র সাধারণ মানুষের কাছে আছে তা কিনে নেয়ার জন্য সরকার একটি প্রকল্পও হাতে নেবে বলে জানান জেসিন্ডা।
ওই হামলার ঘটনায় ২৯ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এদের মধ্যে এখনও ৮ জন আইসিইউতে।
নিহতদের স্মরণ অব্যাহত
বৃহস্পতিবার, সকাল। লাউডস্পিকারে শোকার্ত সুরে ‘আল্লাহু আকবরে’ শুরু। এরপর দু’জনের মরদেহ স্বজনদের কাছে দেয়া হলো। তারা খাটিয়ায় করে কাঁধে বয়ে কবরস্থানে নিয়ে যান মরদেহগুলো।
সেখানে শতাধিক মানুষ জড়ো হয়েছেন। এদের মধ্যে অমুসলিমও রয়েছেন। আছে স্কুলের শিশুরাও, যারা ১৪ বছর বয়সী সা’য়াদ মিলান ও ২৪ বছর বয়সী তারিক ওমরের মরদেহকে বিদায় জানাতে গিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছেন।
সা’য়াদের বাবা জন মিলান জানান, আল-নূর মসজিদে নামাযে গিয়ে গুলিতে তার ছেলে মারা যায়।
এ সময় তিনি ছেলের বর্ণনা তুলে ধরেন, ‘এক বিউটিফুল ছেলে এবং আমার অত্যন্ত স্পেশাল একজন। সে নর্দার্ন ইংল্যান্ডের ফুটবল ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে খেলার স্বপ্ন দেখতো।’
সা’য়াদের স্কুল ক্যাসিমেরা হাইস্কুলের ছেলেমেয়েরাও এদিন তাকে স্মরণে কবরস্থানে জড়ো হয়েছিল। তারাও কান্নাভেজা বিদায় জানায় সহপাঠীকে।
নিহত তারিক ওমর দেশটির জুনিয়র ফুটবল দলের কোচ ছিলেন। তাকে স্মরণ করে ক্রাইস্টচার্চ ইউনাইটেড একাডেমির পরিচালক কলিন উইলিয়ামসন বলেন, ‘অনন্য মানবিক হৃদয়ের অধিকারী, অসাধারণ সাহস, যে কোচিং করাতে খুবই ভালবাসত।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন