সর্বোচ্চ অগ্নিঝুঁকিতে থাকা রাজধানীর অপ্রশস্ত গলির মুখে একটিও ‘হাইড্রেন্ট পয়েন্ট’ (অগ্নিকা-ের কাছাকাছি পানির মজুদ ব্যবস্থা) নেই। অথচ যে কোনো মেগাসিটিতে এ ব্যবস্থা থাকা জরুরি। এদিকে নিমতলী দুর্ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে অগ্নিকা- প্রতিরোধে শহরের প্রতিটি সরু গলির মুখে হাইড্রেন্ট পয়েন্ট স্থাপনের বিষয়টিতে জোর দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। কোনো সুপারিশই পূর্ণতা পায়নি। ফায়ার সার্ভিসের
মিরপুর স্টেশন কর্মকর্তা বাবুল জানান, অগ্নিকা-ের সময় পানি সংকটের কথা শুনতে দেশবাসী অভ্যস্ত। ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে খুব বেশি পানি মজুদের ক্ষমতা থাকে না। এক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় ফায়ার হাইড্রেন্ট। এটি মূলত পানির সংরক্ষণাগারের সঙ্গে সংযুক্ত আগুন নেভাতে পানির ব্যবস্থা। এখানে উচ্চচাপে পানি সংরক্ষণ করা হয়। কাছাকাছি কোথাও আগুন লাগলে এ পয়েন্টে পাইপ লাগিয়ে পানির মাধ্যমে আগুন নেভানো যায়। এ নিয়ে সরকারের কাছে আমাদের একাধিক সুপারিশ আছে।
নগর বিশেষজ্ঞ স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, বিশ্বের সব মেগাসিটিতে হাইড্রেন্ট পয়েণ্টের ব্যবস্থা আছে। অথচ জাতির দুর্ভাগ্য, আমরা এ সেবা থেকে বঞ্চিত। অগ্নিদুর্ঘটনার ঘটনা গুণিতকহারে বাড়লেও সরকার ও আমরা কেউই সচেতন হচ্ছি না। একটি ঘটনার পর আলোচনা করি; ক’দিন পর তা ভুলে যাই।
তিনি আরও বলেন, আমাদের বড় স্থাপনা ও শপিংমলগুলোয় হাইড্রেন্টের ব্যবস্থা থাকতে হবে। আগুন নেভাতে শপিং সেন্টারগুলোয় স্বয়ংসম্পূর্ণ অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। আগুন লাগলে মাসে করণীয় কী হবে- সে বিষয়ে অন্তত মাসে একবার মার্কেটের ব্যবসায়ী-কর্মচারীদের রিহার্সালের কথা থাকলেও তা পালন করা হয় না।
মোবাশ্বের বলেন, চকবাজারে আগুন লেগেছে। এখন মিডিয়াও সোচ্চার থাকবে কয়েকদিন। আমি বরাবরের মতো বলব, মিডিয়া যেন এই অগ্নিদূর্ঘটনা নিয়ে সারাবছর সোচ্চার থাকে। শুধু কেমিক্যালই নয়, ভূমিকম্প ঝুঁকিতে থাকা রাজধানীর তলদেশে গ্যাস পাইপলাইন যা আছে, যদি কখনো ভূমিকম্প মাঝারি মানের আঘাতও হানে তবে ঢাকা হবে জ্বলন্ত অগ্নিকু-।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এক সময় সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আমরা বসে পরামর্শ দিয়েছিলাম শিল্প বা আবাসিক গ্যাস সংযোগে ‘অটো সেন্সর’ বসাতে। কারণ, গ্যাসলাইন কেন্দ্রীয়ভাবে বন্ধ করার সুযোগ রাখা উচিত। কিন্ত আজও তা করা হয়নি। বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরে অগ্নিকু-ে পরিণত হবে।
জাপানের কোবে নগরীর ভূমিকম্পের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ওই নগরী বাণিজ্যিক নগরীতে শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাস জ্বলেছিল প্রায় ৭ দিন। মানুষ আহত হলে আগে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। অথচ তাও নিরাপদ নেই। কয়েকদিন আগেই আমরা হাসপাতাল জ্বলতে দেখেছি। নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটি ১৭ দফা সুপারিশ করলেও তার একটিও বাস্তবায়িত হয়নি।
বিশেষঞ্জরা বলছেন, এবারও হয়তো একই সুপারিশ আসবে। প্রথা মতো হয়তো তাও চলে যাবে হিমাগারে। জানা গেছে, সুপারিশমালায় ছিল, দ্রুত অগ্নিনির্বাপণে স্থানীয়ভাবে পৃথক পানির লাইনসহ সব গলির মুখে (যেখানে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যেতে পারবে না) হাইড্রেন্ট পয়েণ্ট স্থাপন, জরুরি ভিত্তিতে আবাসিক এলাকা থেকে গুদাম বা কারখানা সরিয়ে নেওয়া, অনুমোদনহীন কারখানার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া, রাসায়নিক দ্রব্যের মজুদ, বাজারজাতকরণ এবং বিক্রির জন্য লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রক্রিয়া জোরদার করা, অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন ২০০৩ ও ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করা, আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক বা বিস্ফোরক দ্রব্যের মজুদ বা বিপণনের বিরুদ্ধে জনমত গঠন, আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক দ্রব্য বা বিস্ফোরক জাতীয় পদার্থ মজুদকরণ বা বিপণন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা, ঘরবাড়িতে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক তারের গুণগতমান নিশ্চিত করা, রাস্তায় স্থাপিত খোলা তারের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন, সম্ভাব্য দুর্ঘটনা পরিহার করতে প্রতিমাসে অন্তত একবার বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার সরেজমিনে পরীক্ষা করা, দুর্ঘটনা মোকাবিলায় জাতীয় পর্যায়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে জাতীয় ট্রাস্কফোর্স গঠন, রাসায়নিক ও রাসায়ানিক জাতীয় দাহ্য বস্তুর আলাদা দপ্তরের পরিবর্তে সব দপ্তরের মধ্যে সমন্বয় সাধন, সময়ের চাহিদা অনুযায়ী ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের অবকাঠামো, জনবল, প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জামের আধুনিকায়ন, জনসচেতনতা বাড়ানো, অগ্নিকা-ের সময় যেন উৎসুক জনতা উদ্ধার কাজে বিঘœ ঘটাতে না পারে সে জন্য আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো, পাঠ্যসূচিতে অগ্নিকা-, উদ্ধার ও প্রাথমিক চিকিৎসার বিষয়গুলো বাধ্যতামূলক করা, ৬২ হাজার কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবক তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা, কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার আওতায় আনা এবং বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানসমূহে ডেকোরেটরের উপকরণের সঙ্গে প্রয়োজনীয় সংখ্যক অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রাখা প্রভৃতি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন