ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন ঘিরে ক্যাম্পাস এখন সরগরম। প্রার্থী বাছাই, ভোটের কৌশল নির্ধারণ নিয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাদের দম ফেলার ফুরসত নেই। প্রায় আড়াই দশক পর হচ্ছে এ নির্বাচন। বিষয়টি নির্বাচনে ভিন্নমাত্রা ও চ্যালেঞ্জ যোগ করেছে। প্রার্থী হতে আগ্রহীর সংখ্যাও কম নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনের বাইরে শিক্ষার্থীদের নিয়ে গড়ে ওঠা প্ল্যাটফরমও সক্রিয় রয়েছে। এ অবস্থায় ডাকসুর নেতৃত্বে কারা আসছেন তা নিয়ে কৌতূহল রয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে। আগামী ১১ মার্চ হতে যাচ্ছে বহুল প্রতীক্ষিত এ নির্বাচন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ এবং বিএনপির সহযোগী সংগঠন ছাত্রদলের সাবেক নেতারা দফায় দফায় বৈঠক করছেন নির্বাচনের কৌশল নিয়ে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে তুলনামূলক জনপ্রিয় ও অঞ্চলভিত্তিক বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে প্যানেল নির্ধারণে কাজ করছেন তারা। ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের নেতারাও নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করতে ছুটে যাচ্ছেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে। দীর্ঘদন ধরেই ঢাবি ক্যাম্পাসে একচ্ছত্র আধিপত্য সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে সংগঠনটি নিজেদের জনপ্রিয়তা প্রমাণে ডাকসু নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়েছে। এমনকি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বেশ কয়েকবার বলছেন ডাকসু নির্বাচনকে তারা সিরিয়াসলি নিচ্ছেন। চার কেন্দ্রীয় নেতাকে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের কর্মকা- সমন্বয়ের দায়িত্ব দিয়েছে দলটি। নির্বাচনে করণীয় সম্পর্কে কয়েকবার বৈঠকও করেছেন তারা। সর্বশেষ গত শুক্রবার ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। এ বৈঠকে ছাত্রলীগের প্যানেল নির্ধারণ ও জয়ের কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়। ডাকসুর ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ছাত্রলীগ থেকে একবারই ডাকসুতে সহসভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হয়েছিল। তবে পূর্ণ প্যানেলে জয় পায়নি সংগঠনটি। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্যানেল থেকে ভিপি পদে জয়ী হয়েছিলেন ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ। পরিষদের ওই প্যানেলে জাসদ ছাত্রলীগ থেকে মুশতাক আহমেদ সাধারণ সম্পাদক (জিএস) এবং ছাত্র ইউনিয়ন থেকে নাসির-উদ-দৌজা সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) নির্বাচিত হয়েছিলেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নামের জোটটি এখনো ক্রিয়াশীল থাকলেও সেই জোটে নেই ছাত্র ইউনিয়ন। বামপন্থি সংগঠনটি এখন প্রগতিশীল ছাত্রজোট নামে ৫টি সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছে। ক্যাম্পাসে জাসদ ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিই নেই। ওই জোটভুক্ত ৬ সংগঠনের আর কারও বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি পর্যন্ত নেই। এ অবস্থায় ছাত্রলীগ অনেকটা একা হয়ে পড়েছে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দুই শীর্ষনেতা ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার দুই শীর্ষনেতার ছাত্রত্ব রয়েছে। তাদের বয়সও ত্রিশের কোটায় রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে তারা প্রত্যেকেই প্রার্থী হতে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে তুলনামূলক গ্রহণযোগ্য ছাত্রনেতারাও প্রার্থী হতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এ নিয়ে প্যানেল নির্বাচনে গলদঘর্ম ছাত্রলীগের সাবেক ও আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, ছাত্রলীগের প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত বুধবার ডাকসু নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। গণভবনে প্রায় দেড় ঘণ্টার ওই বৈঠকে দলীয় প্রার্থী বাছাইসহ বেশকিছু বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। ডাকসু নির্বাচনে অঞ্চলভিত্তিক প্রার্থিতা জয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। ঢাবিতে খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলের শিক্ষার্থী তুলনামূলক বেশি। এর পরই রয়েছে ময়মনসিংহ ও ফরিদপুর অঞ্চল। এ ছাড়া উত্তরবঙ্গও অঞ্চলভিত্তিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ। এবার ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখায় উত্তরবঙ্গ, ময়মনসিংহ ও ফরিদপুর অঞ্চল থেকে শীর্ষনেতা রয়েছেন। সে ক্ষেত্রে খুলনা ও বরিশাল অঞ্চল থেকে ডাকসু নির্বাচনে প্রার্থী করা হতে পারে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন, সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী, ঢাবি শাখার সভাপতি সনজিৎ চন্দ্র দাস, সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইন প্রার্থী হতে আগ্রহী। ছাত্রলীগের ঢাবি শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন প্রিন্স, সাবেক সহসভাপতি আদিত্য নন্দীও প্রার্থী হতে চান। অন্য আগ্রহীদের মধ্যে আলোচনায় রয়েছেন ঢাবি শাখার সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মামুন বিন সাত্তার, চারুকলা অনুষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কবির রিক্ত, সাবেক কেন্দ্রীয় উপসম্পাদক শেখ নকিবুল ইসলাম সুমন, জসীম উদ্দীন হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহেদ খান, মুহসীন হল শাখার সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান সানী, বঙ্গবন্ধু হল শাখার সভাপতি বরিকুল ইসলাম বাঁধন ও সাধারণ সম্পাদক আল আমিন রহমান। ঢাবি ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মাজহারুল কবির শয়নও প্রার্থী হতে পারেন। ডাকসুর শীর্ষ কোনো পদে ছাত্রলীগ এবার নারী প্রার্থী দিতে পারে বলে আলোচনা রয়েছে। সম্ভাব্য নারী নেত্রীদের মধ্যে আলোচনায় রয়েছেন কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক উপঅর্থ সম্পাদক তিলোত্তমা শিকদার, রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণী দিশা, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল শাখার সাধারণ সম্পাদক রওনক জাহান রাইন। প্রার্থী বাছাই বিষয়ে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইন বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে ভরসার নাম ছাত্রলীগ, যা অন্য সংগঠনের ঈর্ষার কারণ। তিনি বলেন, পূর্ণ প্যানেলে জয়লাভের লক্ষ্য নিয়েই প্যানেল তৈরির কাজ চলছে। তবে প্রার্থী খুঁজতে কিছুটা বেকায়দায় রয়েছে ছাত্রদল। সংগঠনটির শীর্ষনেতাদের প্রায় সবার বয়স ডাকসুর গঠনতন্ত্র নির্ধারিত ৩০ বছরের বেশি। এমফিলের যোগ্যতা দিয়েও তাদের কেউ প্রার্থী হতে পারছেন না। বিকল্প হিসেবে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে সর্বদলীয় প্যানেলের চিন্তাভাবনা করছে ছাত্রদলসহ অন্যান্য সংগঠন। সংশ্লিষ্ট ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে এমন আভাস পাওয়া গেছে। ছাত্রদল সূত্র জানায়, ভিপি পদে তাদের সংগঠন থেকে প্রার্থী দিয়ে জিএস ও এজিএস পদের প্রার্থী অন্য সংগঠন থেকে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে ছাত্রদলের সাবেক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে এ ব্যাপারে সমন্বয়ের চেষ্টা করা হচ্ছে। সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা বলছেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিচিতি আছে, নেতিবাচক কর্মকা-ের রেকর্ড নেই, ফল ভালো এবং সাংগঠনিক প্রজ্ঞার অধিকারীÑ এমন শিক্ষার্থীদেরই ভিপি-জিএস-এজিএস পদে ভাবা হচ্ছে। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান বলেন, আমরা ডাকসুতে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। তবে প্রশাসনের কাছে যে দাবি জানিয়েছি, তা বাস্তবায়নের পরই ডাকসুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। বামধারার প্রগতিশীল ছাত্রজোট চাইছে, কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সমন্বয় করে প্যানেল দিতে। তবে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ছাত্রত্ব থাকায় তারা দলীয়ভাবে প্যানেল চূড়ান্ত করে রেখেছে। এ ছাড়া সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে তৈরি হওয়া সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক কমিটির ৩৬ জন সক্রিয় রয়েছেন। তাদের মধ্যে ১৮ জনের ঢাবির ছাত্রত্ব রয়েছে। ডাকসুর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন বাদ পড়তে পারেন। তবে প্রার্থী হতে পারবেন পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক নূর, রাশেদ খান, ফারুক হাসান। এ তিনজনের নেতৃত্বে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতারা নির্বাচনে অংশ নেবেন বলে জানা গেছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন