বাংলাদেশে গত একযুগে উল্লেখযোগ্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। বড় বড় উন্নয়নের মেগা প্রকল্পে দুর্নীতিও হয়েছে ব্যাপকভাবে। সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করলেও সে ঘোষণা কাগজেই আবদ্ধ রয়েছে। আর্থিক খাতের লুটপাটকারী, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, স্বাধীনতাযুদ্ধে সহায়তাকারী বিদেশি নাগরিকদের সম্মাননা ক্রেস্ট থেকে সোনা চুরি, মিথ্যা তথ্য দিয়ে মুজিবনগর সরকারের চাকুরে হিসাবে সুবিধা গ্রহণকারী, পর্দাকাণ্ড, বালিশকাণ্ড, ক্যাসিনোকাণ্ড, বিদেশে টাকা পাচারকারী, বিভিন্ন নির্বাচনে দুর্নীতিকারী, প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পে দুর্নীতিকারী, টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজ, সিন্ডিকেটবাজ, হলমার্ক, ডেসটিনি, বিসমিল্লাহ গ্রুপসহ আরও বড় বড় দুর্নীতিকারীদের কাউকেই দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেওয়া হয়নি। অনেক প্রমাণিত দুর্নীতি তদন্ত কমিটি করে চাপা দেওয়া হয়েছে। প্রমাণিত দুর্নীতিবাজদের ধরা পড়ার পর শাস্তি না দিয়ে বদলি করে পরোক্ষভাবে দুর্নীতি চর্চায় উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। সবকিছু মিলে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দুর্নীতির চর্চা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্বৃত্তায়িত হয়ে পড়েছে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। বর্ধিত সন্ত্রাস, সংঘর্ষ, অপরাধপ্রবণতা, অন্যায়, মিথ্যাচার, সুশাসনের ঘাটতি, পারস্পারিক অবিশ্বাস, সহনশীলতার অভাব এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসা সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে কালিমালিপ্ত করেছে।
দেশে যতই অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হোক না কেন, রাজনৈতিক সংস্কৃতি সংঘাতময় হলে উন্নয়ন টেকসই হয় না। আমরা কেবল দুর্নীতির মধ্য দিয়ে রাস্তাঘাট, সেতু, যোগাযোগের উন্নয়ন করতে পেরেছি। কিন্তু আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, গণতন্ত্রের চর্চা, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত উন্নয়ন করতে পারিনি। উন্নয়ন ঘটাতে পারিনি সামাজিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার। সমাজে অব্যাহতভাবে অপরাধ, খুন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তবে র্যাবের কতিপয় কর্মকর্তার ওপর আমেরিকার স্যাংশন আরোপের পর উল্লেখযোগ্যভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুম কমেছে। কিন্তু ক্ষমতা রদবদলের প্রক্রিয়া বিষয়ে কেমন সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন হবে সে বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যমত্য না হওয়ায় প্রতিহিংসা ও সামাজিক অস্থিরতা বেড়েছে।
রাজনৈতিক ক্ষমতা রদবদলের প্রক্রিয়াকে মসৃণ করার লক্ষে ১৯৯০ সালে সামরিক সরকারের পদত্যাগের পর এ দেশের রাজনীতিকরাই সর্বসম্মতভাবে অস্থায়ী এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার উদ্ভাবন করেছিলেন। তিনটি নির্বাচন এমন সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্যভাবেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই নির্বাচনগুলোতে বিজয়ী দল সরকার গঠন করে ক্ষমতার মেয়াদ পূরণ করতে পেরেছিল। কিন্তু তারপর রাজনৈতিক সংঘর্ষকে অজুহাত করে একটি অবৈধ ও অসাংবিধানিক সরকার ক্ষমতা দখল করে দুই বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকে।
এ সরকার ছিল একটি ষড়যন্ত্রের ফসল। এ সরকারে সিভিলিয়ান স্বরূপে ফখরুদ্দিন আহমেদ সামনে থাকলেও পেছনে মূল ক্ষমতার লাটাই ছিল জেনারেল মইনুদ্দিনের হাতে। এরা সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজদের তালিকা করে বিরাজনীতিকরণের লক্ষে পাইকারি হারে রাজনীতিবিদদের গ্রেফতার করেছিল। দুই বড় দলের প্রধানকে গ্রেফতার করে সাবজেলে রেখেছিল। তাদের বিরুদ্ধে মামলার পর মামলা রুজু করেছিল। এদের উদ্দেশ্য ছিল জাতিকে নতুন গণতন্ত্র শিখিয়ে ক্রমান্বয়ে রাজনীতিতে টিকে থাকা। এ লক্ষে এরা রাজনীতিতে ‘মাইনাস টু থিওরি’ কার্যকরী করতে বড় দলগুলোর মধ্যে পরিকল্পিতভাবে ভাঙন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। তবে সাধারণ মানুষ তাদের এ পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি। ‘মাইনাস টু থিওরি’ কার্যকরী করতে ব্যর্থ হয়ে এরা কোনো রকমে জোড়াতালির ‘ম্যানেজ টু’ কার্যকরী করে নবম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে বিদেশে পাড়ি জমান। তারপর এক যুগেরও বেশি সময় পার হলেও ড. ফকরুদ্দিন বা জেনারেল মইনুদ্দিন আর বাংলাদেশমুখী হননি।
এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ষড়যন্ত্র একটি বহুল চর্চিত বিষয়। একবার একটি দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে সে দল আর ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে এমনটি নেই। দলগুলো ভুলে যায় যে, জনগণই রাষ্ট্রের মালিক। তারাই ভোট প্রদানের মাধ্যমে কারা দেশ পরিচালনায় থাকবেন তা নির্ধারণ করবেন। জনগণ নির্বাচনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের ভোট প্রদান করে থাকেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এ নির্বাচনি প্রক্রিয়া আজ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। জনগণ প্রায় এক যুগ হলো তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারছেন না। দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। মানুষ ভোটদান প্রক্রিয়ায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।
দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে অধিকতর বিষাক্ত করেছে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী। এ সংশোধনীর মাধ্যমে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এককভাবে দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছে। এ ব্যবস্থায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিরোধীদলের পক্ষে নির্বাচন জেতা সম্ভব হবে না। বিষয়টি গত দুটি নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে। গত দশম সংসদ নির্বাচনে অর্ধেকেরও বেশি ভোটার ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার সুযোগ পাননি। কারণ, নির্বাচন হওয়ার আগেই সরকারদলীয় প্রার্থীরা ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়ে আগেই নির্ধারিত করে দিয়েছেন কোনো দল সরকার গঠন করবে। এমনটা হলে সে নির্বাচনে বাকিদের কোনো আগ্রহ থাকে না। পরবর্তীতে একাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রশাসন ও পোশাকধারী বাহিনী ব্যবহার করে সরকারি দল ভোটের দিনের আগের রাতেই ‘নৈশ ভোট’ করে বিজয় সুনিশ্চিত করেছে। এর ফলে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়েছে। দলীয় সরকারাধীনে নির্বাচন করলে এ অসুস্থ ধারা থেকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও নির্বাচনি ব্যবস্থাকে সুস্থ করা সম্ভব হবে না। এর জন্য প্রয়োজন আবারও নির্দলীয় ব্যবস্থাধীনে সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। সে জন্য সাংবিধানিক সংশোধনীসহ যা যা করা দরকার তা করতে পারলে ভালো হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, তথা গণতন্ত্রের স্বার্থে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।
গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিরোধী দলগুলোকে স্বাধীনভাবে রাজনীতি করতে দেওয়া উচিত। বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বাকস্বাধীনতা, সভা-সমাবেশ করার স্বাধীনতা থাকা জরুরি। তাদের সরকারের যৌক্তিক সমালোচনা করতে দেওয়া উচিত। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দলগুলোর মধ্যে এমন সহনশীলতার ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। ক্ষমতাসীনরা বিরোধীদলীয় কণ্ঠ স্তব্ধ করে দিতে তাদের ওপর নির্যাতন নিপীড়ন চালায়। তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাদের গ্রেফতার করে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট পাস করে বর্তমান সরকার এ আইনকে সরকার বিরোধিতা দমনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ব্যাপক সমালোচনা হলেও এ আইন বাতিল করা হয়নি। এ আইনের মাধ্যমে সাংবাদিক ও লেখকদের কলমের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের সমালোচনা করায় অনেক ছাত্র-যুবককে গ্রেফতার পর্যন্ত করা হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, স্বাধীন মতামত প্রকাশের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ রাজনৈতিক সংস্কৃতির গণতান্ত্রিক ধারাকে ব্যাহত করে।
মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা-এর মতো নির্বাচনি সংস্কৃতিকে অধিকতর বিতর্কিত করে তুলেছে নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)-এর ব্যবহারের উদ্যোগ গ্রহণ। স্বল্পশিক্ষিত ও প্রযুক্তি-অসচেতন ভোটারের দেশে ইভিএমে ভোটগ্রহণ করাকে সরকার ও ইসির দুরভিসন্ধিমূলক কাজ বলে অভিহিত করা যায়। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে গত ৫২ বছরে বহু রাজনৈতিক দলের বহু মিটিং, আলোচনা ও সংলাপ হয়েছে। ২০১০ সাল পর্যন্ত এসব আলোচনার কোনোটিতেই কোনো রাজনৈতিক দল কখনো নির্বাচন কমিশনের কাছে মেশিনে ভোট দাবি করেনি। অথচ ড. এটিএম শামসুল হুদা কমিশন পদাসীন হওয়ার অনেক পরে হঠাৎ করে ইভিএমে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ওই কমিশন বা তৎপরবর্তী কাজী রকিব কমিশন ইভিএমে সংসদ নির্বাচন করেনি। কিন্তু সাবেক কেএম নুরুল হুদা কমিশন একাদশ সংসদ নির্বাচনে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে ৬টি নির্বাচনি এলাকায় ইভিএমে ভোট করে। উল্লেখ্য, এ কমিশন ক্ষমতায় এসে আড়াই মাস পরেই ঘোষণা দেয় যে, কমিশন সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করবে না। এরপর কমিশন ঘোষিত সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপেও তারা প্রতিশ্রুতি দেয় যে সংসদ নির্বাচনে কমিশন ইভিএম ব্যবহার করবে না। কিন্তু তারপর হঠাৎ এসব প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে অধিকাংশ দল ও সুশীল সমাজের মতামত উপেক্ষা করে এ কমিশন কার অঘোষিত নির্দেশনায় ৬টি নির্বাচনি এলাকায় ইভিএমে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে তা বুঝতে ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন হয় না।
বর্তমান কমিশন আবার অনধিক ১৫০ আসনে ইভিএমে সংসদ নির্বাচন করতে চাইছে। এর পেছনে সরকারদলীয় রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি আছে বলে প্রতীয়মান হয়। ইভিএম নিষ্পাপ যন্ত্র। এ যন্ত্রকে যে নির্দেশনা দেওয়া হবে যন্ত্র সে নির্দেশ পালন করবে। বর্তমান কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন ক্ষমতায় এসে বলেছিল, অধিকাংশ দল যদি না চায় তাহলে তারা ইভিএমে সংসদ নির্বাচন করবে না। কিন্তু ইসি বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে যে সংলাপ করে, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে সংলাপ করে, তাতে দেখা যায় যে অধিকাংশ দলই সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করেছে। এসব দল মনে করে, ইভিএম একটি ‘ভোট চুরির মেশিন’। এ মেশিনে কাগজের ব্যবহার নেই। ভোট পুনঃগণনার ব্যবস্থা নেই। কায়িক পরিশ্রমকারী ভোটাররা ভোট প্রদান করতে গেলে তাদের আঙুলের ছাপ মেলে না। প্রযুক্তি অসচেতন, বয়স্ক এবং নারী ভোটাররা মেশিনে ভোট দিতে অস্বস্তিবোধ করেন। এরপরও ইসি ইভিএম-এ কী মধু খুঁজে পেয়েছে যে তাদের এ যন্ত্রে ভোট করতে এত আগ্রহ!
বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচনে বিদেশি শক্তিগুলো পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। নির্বাচন কাছে এলে বিদেশিদের এ ভূমিকা অধিকতর স্পষ্টভাবে অনুধাবন করা যায়। ভারত, আমেরিকা, ইইউসহ অনেক দেশই তখন বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে তাদের মনোভাব প্রকাশ করে। কিন্তু সম্প্রতি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে পরাশক্তিধর বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর ভূমিকা অধিকতর নগ্নভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। তারা বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে খোলামেলাভাবে কথা বলছেন। সরকারি ও বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে ক্লোজডোর আলোচনা করছেন। একের পর এক মার্কিন রাজনীতিক ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বাংলাদেশ ভিজিট করছেন। এসব সফরের আলোচনার বিষয়বস্তুতে নির্বাচনের ইস্যুও স্থান পাচ্ছে। জাপান ও কোরিয়ার মতো দেশগুলো আগে বাংলাদেশের স্থানীয় রাজনীতি নিয়ে মুখ খুলতো না। এবার এরাও বাংলাদেশি নির্বাচন নিয়ে সরব হয়ে উঠেছে। কূটনীতিকদের কার্যকলাপে প্রতীয়মান হচ্ছে যে তারা বাংলাদেশের অবাধ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে ঐক্যবদ্ধ।
বিশ্বায়িত পৃথিবীতে বসবাস করে সরকার পরাশক্তিধর বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোকে উপেক্ষা করতে পারছে না। ফলে সরকার বিরোধীদলীয় নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বানের দাবি মানবে না বলে যে কথা অব্যাহতভাবে বলে আসছে, তা কতদিন বলতে পারবে সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। বিরোধীদলগুলো এ দাবিতে এবার অনড় মনে হচ্ছে। বিএনপি এ দাবির ওপর অটল থেকে নির্বাচন কমিশন আহুত কোনো সংলাপ, বা সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কোনো উপনির্বাচন বা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। দলটি বলছে, রাজপথে অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমেই তারা তাদের ‘যৌক্তিক’ দাবি আদায় করবেন। এ কারণে দলটি এর ১০ দফার ২ নম্বরে এবং ২৭ দফার ৩ নম্বরে নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবি সন্নিবেশিত করেছে। সাধারণ জনগণ এমন দাবিকে অযৌক্তিক মনে করছেন না। কারণ, তারা জানেন, এমন দাবিতে আন্দোলন করে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের কাছ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবি আদায় করেছিল। ওই সময়ের বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার দেখানো পথেই বিএনপি এবং অন্য রাজনৈতিক দলগুলো হাঁটছে বলে মনে করা যায়।
সরকারদলীয় নেতাদের শুভবুদ্ধির উদয় হলে এবং বিরোধী আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেওয়ার আগেই সরকার যদি জাতীয় সংসদে নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের বিল পাস করে নির্বাচন দেয়, তাহলে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। আর সব স্টেকহোল্ডারদের পরামর্শ উপেক্ষা করে যদি নিজেরা ক্ষমতায় থেকে, জাতীয় সংসদ না ভেঙে, একগুয়েমি করে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে ইভিএমে নির্বাচন করে, তাহলে জাতিকে রাজপথে শক্তির মোকাবিলায় অনিবার্য রক্তপাত প্রত্যক্ষ করতে হতে পারে। সে ক্ষেত্রে অধিকতর সংঘাতময় হয়ে উঠবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। দেশবাসী রক্তপাত চান না। তারা শান্তি চান। তারা চান, সরকারি ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে একটি সমঝোতার মাধ্যমে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। এ কারণে বর্তমান ইসির দূরদর্শী সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল ক্ষমতায় এসে শপথ গ্রহণের পর প্রদত্ত প্রেস ব্রিফিংয়ে রাজনৈতিক সমঝোতার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছিলেন। কিন্তু সিইসির ওই পরামর্শ উপেক্ষা করে সরকারদলীয় নেতা ও মন্ত্রীরা তাদের সাজানো সংবিধান থেকে নড়বেন না বলে অব্যাহতভাবে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। সংবিধান তো মানুষের জন্য। জনগণের কল্যাণের জন্য যদি ১৭ বার সংবিধান পরিবর্তন করা সম্ভব হয়, তাহলে গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে আরেকবার সংবিধান সংশোধন করতে অসুবিধা হবে কেন? জনগণ চান, নির্দলীয় সরকারাধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভোটারদের রায়ে জয়ী দল দেশ পরিচালনা করুক। সামাজিক শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন সুনিশ্চিত হোক। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শান্তির সুবাতাস প্রবাহিত হোক। ভুলে গেলে হবে না, সংঘাতময় রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে একটি দেশ উন্নয়নের পথে এগোতে পারে না।
লেখক : অধ্যাপক (এলপিআর), রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন