আমিনুল ইসলাম
পরীক্ষার ‘গোঁজামিল’ প্রশ্ন: মেধাবীরা কেন শিক্ষকতায় নেই
কিছুদিন আগে এইচএসসি পর্যায়ে বোর্ডের পরীক্ষার প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। কিছু পরীক্ষার প্রশ্ন দেখে পরিষ্কার বোঝা গেছে প্রশ্নগুলোতে ব্যক্তি-আক্রমণ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে বিদ্বেষমূলক প্রশ্নও লক্ষ্য করা গেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এমন প্রশ্ন করেছেন কারা? যতটুকু বুঝতে পারি, বোর্ডের পরীক্ষায় যাঁরা প্রশ্ন করেন কিংবা প্রশ্ন করার সুযোগ পান, তাঁরা যথেষ্ট সিনিয়র শিক্ষক। যাঁদের অভিজ্ঞতা অনেক। ধরে নেওয়া হয় তাঁরা নিজ নিজ বিষয়ে যথেষ্ট পারদর্শী। সেই ক্ষেত্রে প্রশ্ন আসতেই পারে, কারা আমাদের স্কুল-কলেজগুলোতে শিক্ষক হচ্ছেন? এই প্রশ্ন করার আরেকটা কারণ হচ্ছে, শুধু যে যাঁরা প্রশ্ন করেছেন, তাঁরাই এমন করেছেন, তা তো নয়। যাঁরা মডারেট করেছেন, তাঁরাও মনে করেছেন, এমন প্রশ্ন বোর্ডের পরীক্ষায় করাই যায়!
বোর্ডের পরীক্ষার প্রশ্নের যদি এই হাল হয়, তাহলে নির্দ্বিধায় প্রশ্ন করাই যায়, দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা স্কুল-কলেজগুলো যখন নিজেরা নিজেদের ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষা নেয়, তখন না জানি কেমন প্রশ্ন করা হচ্ছে! শুধু প্রশ্নের কথা বলছি না। এমন শিক্ষকেরা আসলে ছাত্রছাত্রীদের কী পড়াচ্ছেন? আর ছাত্রছাত্রীরাই বা কী শিখছে তাদের কাছ থেকে? ঢালাওভাবে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা শিক্ষকদের অবশ্যই দায়ী করা যাবে না। তবে এবারকার ঘটনার পর এই প্রশ্ন তো করাই যায়, এই শিক্ষকেরা শিক্ষক হচ্ছেন কোন যোগ্যতায়? যেই শিক্ষকেরা বরং শেখাবেন কীভাবে সহনশীল হওয়া যায়। কীভাবে অন্যকে ব্যক্তি আক্রমণ না করে সহিষ্ণুতার চর্চা করা যায়। সেই শিক্ষকেরাই কিনা উল্টো এই সব চর্চা করে বেড়াচ্ছেন! তাহলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কী শিখবে তাঁদের কাছ থেকে? এখন প্রশ্ন হচ্ছে—তাঁরা আসলে শিক্ষক হচ্ছেন কী করে?
কেন এই তরুণ মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসতে পারছেন না? কেন অন্য উপায়ে যোগ্যতাহীন, নীতিবিবর্জিত মানুষগুলোকে আমরা শিক্ষকতা পেশায় আসতে দিচ্ছি কিংবা উৎসাহ দিচ্ছি। এই তো কিছুদিন আগে আরেকটি বোর্ড পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার পর সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে একজন হতাশ হয়ে বলেছিলেন, ‘ছোট থেকে বড় পর্যায়ে সবাই এই কাজের সঙ্গে জড়িত থাকলে কীভাবে সম্ভব ফাঁস রোধ করা।’ কেন আমরা এই অবস্থায় এসে পৌঁছেছি? কারণ, আমরা সৎ-মেধাবী তরুণদের সুযোগ দিতে পারিনি।
দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বছরের পর বছর ধরে দুর্নীতি, ঘুষ, স্বজনপ্রীতি চলছে। প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত একই অবস্থা! এই সব খবর প্রায়ই পত্রপত্রিকায় আসে। সাধারণ মানুষের মাঝেও এমন একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে টাকা দিয়ে কিংবা ঘুষ-স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে স্কুল-কলেজগুলোতে শিক্ষক হওয়া যায়! বাংলাদেশে লাখ লাখ তরুণ মেধাবী রয়েছেন। যাঁরা চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছেন। এই মেধাবী তরুণদের অনেকেই কিন্তু নিজ যোগ্যতায় চাকরি পাচ্ছেন না। দিন শেষে তাঁদের বেকার থাকতে হচ্ছে। কারণ, ঘুষ-স্বজনপ্রীতি এই সব করার মতো অবস্থা তাঁদের নেই।
কেন এই তরুণ মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসতে পারছেন না? কেন অন্য উপায়ে যোগ্যতাহীন, নীতিবিবর্জিত মানুষগুলোকে আমরা শিক্ষকতা পেশায় আসতে দিচ্ছি কিংবা উৎসাহ দিচ্ছি। এই তো কিছুদিন আগে আরেকটি বোর্ড পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার পর সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে একজন হতাশ হয়ে বলেছিলেন, ‘ছোট থেকে বড় পর্যায়ে সবাই এই কাজের সঙ্গে জড়িত থাকলে কীভাবে সম্ভব ফাঁস রোধ করা।’ কেন আমরা এই অবস্থায় এসে পৌঁছেছি? কারণ, আমরা সৎ-মেধাবী তরুণদের সুযোগ দিতে পারিনি।
শুনেছি দক্ষিণ গোলার্ধের কোনো এক দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে একটা বাণী লেখা আছে। সেখান বলা আছে—একটা দেশকে ধ্বংস করার জন্য পারমাণবিক বোমা কিংবা মিসাইলের দরকার হয় না। এর জন্য দরকার স্রেফ শিক্ষাব্যবস্থার মান নিচে নামিয়ে দেওয়া। যার মাধ্যমে পরীক্ষায় শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীরা দুর্নীতির মাধ্যমে পাস করে বের হওয়ার সুযোগ পায়। শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাওয়া মানে একটা জাতি এবং দেশ ধ্বংস হয়ে যাওয়া। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি নিজ হাতে নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনছি নাকি এর মধ্যেই ধ্বংস করে বসে আছি?
ড. আমিনুল ইসলাম সিনিয়র লেকচারার, ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড ইনোভেশন বিভাগ, এস্তনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন