আরিফুল হক
মওলানা সৈয়দ নিসার আলি ১৭৮২ খৃষ্টাব্দে ২৭ জানুয়ারী ২৪ পরগনা জেলার চাঁদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মীর হাসান আলি, ও মাতার নাম আবেদা রোকাইয়া খাতুন। মীর নিসার আলি কোরআনে হাফেজ ছিলেন। তিনি ধর্মবিমুখ মুসলমানদের নিজ ধর্ম ইসলামের ঔজ্জ্বল্য সম্পর্কে শিক্ষা দিতেন।
এই মর্দে মুমিন কে ইতিহাসে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য, ইংরেজ এবং তাদের উচ্ছিষ্ট ভোজী বাবু শ্রেণীর জমিদাররা তাঁর উৎকৃষ্ট নাম মীর নিসার আলির পরিবর্তে তাকে ‘তিতু মীর’ বা ‘তিতা মীর' নামে প্রচার করত। দুঃখের বিষয় পরবর্তীকালে মুসলমান ইতিহাসবিদরাও অনেকে সেই নিকৃষ্ট নামটি বহাল রেখেছে।
পলাশীর বিপর্যয় বাংলার মুসলমানদের স্বাধীনতা হরণ করেই ক্ষান্ত হয়নি। তাদের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধকেও পঙ্গু করে দিয়েছিল।
একদিকে নব্য ইংরেজ প্রভুদের নিপীড়ন, অবহেলা, ঔদাসীন্য। অপরদিকে তাদের অনুগ্রহপুষ্ঠ হিন্দু জমিদার শ্রেণীর সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, অর্থনৈতিক নিপীড়ন, ধর্মীয়,সাংস্কৃতিক আচার অনুষ্ঠান পালনে বাধা দান, যা তৎকালীন মুসলমানদের দিশেহারা করে ফেলেছিল। এই দিশেহারা অবস্থার সুযোগে, হিন্দু আধিপত্যবাদীরা, হিন্দুত্ব এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদ মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দেবার ব্যবস্থা করে। প্রথমেই তারা আরবী ফার্সি সমৃদ্ধ জনসাধারণের কথ্য ভাষাকে অবোধ্য সংস্কৃতি-বহুল পণ্ডিতি ভাষায় রূপান্তরিত করে। পাঠ্যপুস্তক সংস্কার করে মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসের পরিপন্থী, মহিমাস্তব, চৈতন্য চরিতামৃত, শ্রীকৃষ্ণ রসমঞ্জরী, আনন্দ মঙ্গল প্রভৃতি দেবদেবীর স্তব স্তুতিমূলক রচনা পাঠ্য পুস্তকে সংযোজিত করে।
মুসলমানদের নিজস্ব ধর্মাচরণ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে বলপূর্বক দুর্গাপূজা, কালীপূজা, দশহরা, লক্ষ্মীপূজা, গণেশপূজা প্রভৃতি আচার অনুষ্ঠানে মুসলমানদের অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করে।
মুসলমানদের স্বতন্ত্র পরিচয় মুছে ফেলার জন্য, হিন্দু বাবু শ্রেণীটি, নিরক্ষর মুসলমানদের বোঝাতেন- তোরা মুসলমান হলেও বাংলার মুসলমান। সুতরাং আরব দেশের মত রহমান, খালেক, মরিয়ম, রাবেয়া এসব আরবী ফার্সি নাম রাখার দরকারটা কী। তার চেয়ে কালু, ফালু, দুদু, পরী, ন্যেড়ী প্রভৃতি বাংলানামই ভাল, ডাকতেও সুবিধা, বাঙ্গালীয়ানাও বজায় থাকে। সেকালে, তহবন (লুঙ্গী) পরলে বাড়ীর আঙ্গিনায় ঢুকতে দেয়া হতনা। দাঁড়ি রাখলে ‘নেড়ে’ বলে উপহাস করা হত।
মুসলমানদের এমনি এক সামাজিক সাংস্কৃতিক দুর্দিনে সৈয়দ নিসার আলির আবির্ভাব ঘটে। যিনি মৃত মুসলমানের বুকে প্রাণের স্পন্দন জাগালেন । যিনি বললেন, ইসলাম একটা পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। ইসলামই একমাত্র জাগতিক ও পারলৌকিক শান্তির নিশ্চয়তা দিতে পারে, অতএব তোমরা প্রকৃত মুসলমান হও। তিনি আরও বললেন, নামাজ, রোজা, হজ যাকাত দাড়ি রাখা মুসলমানদের জন্য অবশ্য পালনীয় কাজ। যারা এসব পরিত্যাগ করবে আল্লাহ তাদের কঠিন শাস্তি দেবেন। মুসলিম পরিচয়ের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার জন্য তিনি ছেলে-মেয়েদের নাম আরবি-ফার্সিতে রাখার জন্য মুসলমানদের প্রতি অনুরোধ করলেন। তিনি মসজিদগুলো সংস্কার করালেন, সকলকে জামাতে নামাজ পড়ার অনুরোধ জানালেন, এবং কোরবানী দিতেও উৎসাহিত করলেন। সৈয়দ নিসার আলির বাকবিন্যাসে বহু অমুসলমান তাহার মত ও পথকে অভ্রান্ত ভেবে তাঁর অনুগামী হতে লাগলো।
এতে ক্ষিপ্ত হয়ে, ইংরেজ বলে বলীয়ান তারাগুনিয়ার জমিদার রামরানায়ন, পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়, নগরপুরের জমিদার গৌরপ্রসাদ চৌধুরী প্রমুখ মিলিত ভাবে নিসার সাহেবের আন্দোলন কে খতম করবার জন্য নানান সুযোগ খুঁজতে লাগলেন।
বাংলার ধান পাটের সাথে যেমন আগাছা জন্মায়, তেমনি দেশপ্রেমিক মুজাহিদের পাশাপাশি বেঈমানও কম জন্মায়নি। নিসার আলির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার মত বেঈমান খুঁজে পেতে বাবুদের দেরি হলনা। জমিদারদের কথামত মতিউল্লাহ নামধারী এক মুসলমান, তার চাচা গোপাল, তাঁদের জ্ঞাতিভাই নেপাল ও গোবর্ধন, নিসার আলি কে অত্যাচারী সাব্যস্ত করে জমিদার কাছারিতে দরখাস্ত পেশ করলো। জমিদার বাবুরা নিসার আলি সাহেবকে সায়েস্তা করার জন্য এমনি একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ এলাকায় ৫টি আদেশ জারী করলেন।
১) যারা দাড়ি রাখিবে গোঁফ ছাঁটিবে, তাদের ফি-দাঁড়ির জন্য আড়াই টাকা ও ফি-গোঁফের জন্য পাঁচ সিকা খাজনা দিতে হইবে।
২) মসজিদ প্রস্তুত করিলে, প্রত্যেক কাঁচা মসজিদের জন্য পাঁচশত টাকা ,ও পাকা মসজিদের জন্য এক সহস্র টাকা জমিদার সরকারে নজর দিতে হইবে।
৩) আরবি নাম রাখিলে প্রত্যেক নামের জন্য খারিজানা ফি, জমিদার সরকারে জমা দিতে হইবে।
৪) গো-হত্যা করিলে হত্যাকারীর দক্ষিণহস্ত কাটিয়া দেয়া হইবে। যেন সে ব্যক্তি আর গো-হত্যা করিতে না পারে।
৫) যে ব্যক্তি তিতুমীর (নিসার আলি) কে বাড়ীতে স্থান দিবে তাহাকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হইবে (গফুর সিদ্দিকী: শহীদ তিতুমীর)।
পুড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের এহেন সাম্প্রদায়িক আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে নিসার আলি সাহেব অন্তত মার্জিত ভাষায় এক প্রতিবাদ পত্র লিখে, সেই পত্র তাঁর শিষ্য আমিনউল্লাহ মারফত জমিদার কাচারিতে প্রেরণ করেন। নিষ্ঠুর জমিদার অমানবিক নির্যাতন করে পত্রবাহক আমিনউল্লাহ কে হত্যা করে। এই সংবাদ নিসার আলির কাছে পৌঁছানোর পর তিনি অশ্রু সংবরণ করতে পারেন নি , ব্যথিত হৃদয়ে বলেছিলেন ‘আমার আজাদী আন্দোলনের প্রথম শহীদ আমিনউল্লাহ’। সৈয়দ নিসার আলি রক্তপাত চাননি। কিন্তু এই ঘটনার পর তিনি পুঁড়া আক্রমণ করতে বাধ্য হন। তাঁর আক্রমনে গোবিন্দপুর যুদ্ধে, জমিদার দেবনাথ রায় নিহত হয়।
ওদিকে কলকাতার লাটু বাবুর বাসভবনে বড়বড় জমিদার, নীলকর সাহেব, পুলিশ অফিসারদের এক গোপন মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় যে, ইংরেজ নীলকর, ইংরেজ পাদ্রী, এবং সকল জমিদারগণ জমিদার কৃষ্ণদেব রায়কে সকল প্রকার প্রত্যক্ষ সাহায্য সহযোগিতা দান করবেন।
জমিদাররা উপরতলার ঘাঁটি মজবুত করে মুসলমানদের উপর অত্যাচারের স্টিমরোলার চালাতে শুরু করলো।তারা মুসলমানদের বসতবাটি পুড়ালো, মসজিদ পুড়ালো, বহু মুসলমান আহত নিহত হল। ঐতিহাসিক অমলেন্দু দে’র মতে ‘এক সৈন্যবাহিনী সহ সরফরাজপুর গ্রাম আক্রমণ করা হয়’। সৈয়দ নিসার আলি, নরহত্যা, মসজিদ পোড়ানো, গ্রামকে শ্মশানে পরিণত করার বিচারের আর্জি জানিয়ে বারাসত কোর্টে কেস করলেন। কোর্ট কেস ডিসমিস করে দিল। আপীল করেও সুবিচার পাওয়া গেলনা । সৈয়দ নিসার আলি বুঝতে পারলেন এখানে সুবিচার চাইলে অবিচারই প্রাপ্য’ (এ আর মল্লিক)।
অতঃপর সৈয়দ নিসার আলি শঠেশঠাং পদ্ধতিই মেনে নিলেন। বারাসতের কাছে নারকেলবাড়ীয়া গ্রামে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী বাঁশ এবং কাদামাটির প্রলেপ মিশিয়ে গড়ে তুললেন দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট এক বাঁশের কেল্লা। তারপর তাঁর দুই সেনাধ্যক্ষ মাসুম আলি, ও মিসকিন শেখ সহ সমস্ত সৈন্যবাহিনীকে গোপনে একত্রিত করে সৈয়দ নিসার আলি বললেন, আমার এমন পাঁচজন লোক চাই যারা আজাদীর লড়াইয়ে প্রাণ দিতে প্রস্তুত। নারায়ে তাকবীর, আল্লাহুআকবর ধ্বনিতে হাজারো হাত জীবন মরণের সংগ্রামে তাদের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করলো। মীর সাহেব আদেশ দিলেন, কৃষ্ণদেব রায়ের পুঁড়া গ্রাম আক্রমণ করে আমিনউল্লাহ হত্যার, এবং গ্রাম পোড়ানো, মসজিদ পোড়ানোর বদলা নিতে হবে। যেমন আদেশ, তেমনি কাজ। সেনাধ্যক্ষ মাসুম আলির নেতৃত্বে বিপ্লবী যোদ্ধারা ঘিরে ফেলল পুড়া গ্রাম। জমিদারের বাহিনী, নীলকরদের বাহিনী, পাদ্রীদের লোকজনের সাথে যুদ্ধ হল। পরাজিত হল জমিদারদের সম্মিলিত বাহিনী। এরপর জমিদারদের রক্ষা করার জন্য ইংরেজ সরকার তাদের ভাষায় তিতুমীর কে শায়েস্তা করার জন্য একদল অশ্বারোহী সৈন্য পাঠালেন, তারাও বিপ্লবী বাহিনীর কাছে পরাজিত হল, অনেকের মৃত্যু হল।
এখবর কলকাতায় পৌঁছানোর পর ইংরেজরা প্রমাদ গুনলেন। এবার তারা সুদক্ষ সেনাপতির অধীনে একহাজার সৈন্য, উচ্চশ্রেণীর কয়েকটি কামান ও এক হাজার বন্দুক পাঠালেন।
ইংরেজদের কামানকে ভয় নাকরে বিপ্লবীরা ঢাল, বর্শা, তির ধনুক নিয়ে রুখে দাঁড়ালেন। তাদের তিরের আঘাতে জর্জরিত হয়ে ইংরেজ সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হওয়ার উপক্রম হল। এমন সময় গর্জে উঠল কামান। কামানের গোলার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে ছিটকে পড়ল বহু বিপ্লবী সেনা। কেল্লা ধবংস হল। মাসুম আলি কামান দখলে নিতে গিয়ে বন্দী হলেন। পরে তাঁর ফাঁসী হয়। সৈন্যদের মধ্যে যারা ধরা পড়লো তাদের আন্দামান জেলে পাঠানো হল। যারা আহত অবস্থায় ধরা পড়লো তাদের হাসপাতালে নেয়ার নামকরে পানিতে নিক্ষেপ করে মেরে ফেলা হল। আড়াই ঘন্টা যুদ্ধ চলার পর স্বাধীনতা যোদ্ধা সৈয়দ নিসার আলি যুদ্ধ চলা অবস্থায় গোলার আঘাতে ঢলে পড়লেন। দিনটি ছিল ১৯নভেম্বর ১৮৩১ খৃঃ।
সুধী পাঠক! আঠারো শতকের সেই ইতিহাসের সাথে আজকের বাংলাদেশের কি কোন মিল খুঁজে পান? স্বাধীনতা যুদ্ধের এই বীররে স্মরণ না করলেও বাংলাদেশের মানুষ একজনকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি বলে চিৎকার করেন। আপস করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়াই ছিল তার লক্ষ্য। সৈয়দ নিসার আলীদের ভুলে গিয়ে আপসকামী রাজনীতিককে নিয়ে চলে চিৎকার আর চেঁচামেচি।
লেখক: বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বহু গ্রন্থের লেখক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন