মঙ্গলবারের নির্বাচনের অফিশিয়াল ফল এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায় কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫টি আসনের বিপরীতে রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। বিজয়ী হওয়ার জন্য ২১৮টি আসনে জয়লাভ জরুরি হলেও রিপাবলিকানরা ২২০-২২২টি আসন পাবে বলে ধরা হচ্ছে। অন্যদিকে সিনেটের ১০০টি আসনের মধ্যে উভয়ে ৫০-৫০ আসনে জয়লাভ করবে বলে মনে হচ্ছে।
সিনেটের চূড়ান্ত ফলাফল পেতে ডিসেম্বরের ৬ তারিখে জর্জিয়ার রান অফ ইলেকশন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
এই ফলাফলে ক্ষমতাসীন বাইডেনের দল ডেমোক্র্যাটরা কংগ্রেসে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাবে। এর ফলে হয়তো কংগ্রেসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির স্থলাভিষিক্ত হবেন রিপাবলিকানদের নেতা কেভিন ম্যাকারথি। স্পিকার পরিবর্তনের পরপরই সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বর্তমানে চলমান তদন্ত বন্ধ হয়ে উল্টো জো বাইডেনের ছেলের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হতে পারে। অবশ্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলে দিয়েছেন, তিনি এসবে ভ্রুক্ষেপ করেন না।
আমেরিকার এবারের মিডটার্ম ইলেকশনে সবার ধারণা ছিল ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটদের বড় ধরনের পরাজয় হবে। চারদিকে রিপাবলিকানদের জয়জয়কার হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং নিউ ইয়র্কসহ বিভিন্ন স্টেটে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির কারণে ডেমোক্র্যাটরাও ধরে নিয়েছিল তাদের বড় ধরনের পরাজয় হবে। কিন্তু বাস্তবে তা না হওয়ায় ডেমোক্র্যাটরা খুশি। অন্যদিকে হাউসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রিপাবলিকানরা খুশি। এ অবস্থায় উভয় দলই উইন-উইন মুডে রয়েছে। কোনো পক্ষেই খুব একটা হতাশা নেই। সবাই অনেকটা খোশ মেজাজে। যার যার ত্রুটি-বিচ্যুতি বিশ্লেষণে উভয় পক্ষ ব্যস্ত, যাতে ২০২৪-এর প্রেসিডেন্ট ইলেকশনে ভালো করা যায়। কোন ইস্যুতে জনগণ কতটা প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে এ বার্তা উভয় দল পেয়ে গেছে। এখন জনগণের দেওয়া সিগন্যাল অনুযায়ী কাজ করতে পারলেই দুই বছর পর হোয়াইট হাউসের দখল নেওয়া যাবে—এ বিশ্বাস নিয়েই কাজ করছে দুই দল।
এবারের নির্বাচনে ভোটারদের মনোজগতে কাজ করেছে প্রধানত দুটি ইস্যু। একটি হচ্ছে আমেরিকায় গত ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি। জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বাড়ছে। ভোটারদের দৈনন্দিন ব্যয় বেড়ে গেছে। ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বাড়িয়েও ইনফ্লেশন মোকাবেলা করতে পারছে না। মর্টগেজ রেইটও গত ২০ বছরের মধ্যে এখন সবচেয়ে বেশি। সামনে কী হচ্ছে, কিভাবে এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে তা-ও ভোটারদের কাছে পরিষ্কার নয়। ভোটাররা এই পরিস্থিতির জন্য ডেমোক্র্যাটদের দোষারোপ করছেন। যদিও এ পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার কোনো প্ল্যান রিপাবলিকানরাও দিতে পারছে না। তাই প্রতিদিন নিজের পকেট থেকে বাড়তি ডলার হারানোর কষ্ট ভোটারদের বাইডেন প্রশাসনের নীতির বিপক্ষে ভোট দিতে উৎসাহিত করেছে। অনেক ডেমোক্র্যাট সমর্থকও ইনফ্লেশনের কারণে রিপাবলিকানদের ভোট দিয়েছেন। সাধারণ ভোটারদের মধ্যে একটি ধারণা কাজ করতে শুরু করে যে ডেমোক্র্যাটরা দেশের অর্থনীতি সঠিকভাবে চালাতে পারে না।
অন্যদিকে কিছুদিন আগে গর্ভপাত নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ের ফলে জনগণ নড়েচড়ে ওঠে। রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে গর্ভপাত একটি অমীমাংসিত ইস্যু। রিপাবলিকানরা চায় গর্ভপাত নিষিদ্ধ হোক। গর্ভপাতকে তারা শিশুহত্যা হিসেবে প্রচার করে। কোনো অবস্থায়ই তারা গর্ভপাতের অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে চায় না। আবার ডেমোক্র্যাটরা এ বিষয়ে খুবই উদার। তাদের কথা হচ্ছে শরীর যাঁর, সিদ্ধান্ত তাঁর। একজন মহিলা গর্ভধারণ করবেন নাকি গর্ভপাত করবেন—এটা একান্তই তাঁর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। কোনোভাবেই আইন এখানে ব্যক্তিগত অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কারণ একজন মহিলার কাজের পরিবেশ, স্বাস্থ্যগত অবস্থা, মানসিক অবস্থা ইত্যাদি অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে তাঁর সন্তান নেওয়ার ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়টি। তাই একজন মহিলাকে কোনোভাবেই গর্ভপাত নিষিদ্ধ করে সন্তান নিতে বাধ্য করা উচিত নয় বলেই ডেমোক্র্যাটরা মনে করে। রিপাবলিকান প্রভাবিত আদালত যখন গর্ভপাত নিষিদ্ধের বিষয়টি নীতিগতভাবে সমর্থন করেন তখন মহিলা ভোটাররা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। আদালত অবশ্য বলে দিয়েছিলেন কোনো স্টেট চাইলে গর্ভপাতের অধিকার রাখতে পারে। তাই এই সুযোগ নেওয়ার জন্য ভোটাররা অনেক স্টেটে ভোট দিতে যান।
বুথফেরত ভোটারদের মধ্যে একটি জরিপে দেখা যায়, প্রায় ৩২ শতাংশ ভোটার ইনফ্লেশনকে প্রধান ইস্যু মনে করেন। অন্যদিকে প্রায় ২৭ শতাংশ ভোটার গর্ভপাতের অধিকারকে প্রধান ইস্যু মনে করেন। অবশ্য পেনসিলভানিয়া এবং মিশিগানের ভোটারদের কাছে ইনফ্লেশনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে উঠে আসে গর্ভপাতের বিষয়টি। নির্বাচনের ফলে এ দুটি স্টেটে এর প্রতিফলনও দেখা যায়। পেনসিলভানিয়ায় রিপাবলিকানরা তাদের একটি সিনেট আসন ডেমোক্র্যাটদের কাছে হারায়। মিশিগানেও গভর্নর আবার নির্বাচিত হন, একই সঙ্গে স্টেট হাউস এবং সিনেটের দখলও ডেমোক্র্যাটরা নিয়ে নেয়। মূল্যস্ফীতির কারণে যে বড় পরাজয় হওয়ার কথা ছিল ডেমোক্র্যাটদের, তা আটকে দেয় গর্ভপাতের ইস্যুটি। আমেরিকানদের কাছে এবারের নির্বাচনটি ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকানদের মধ্যে না হয়ে যেন হয়ে ওঠে ইনফ্লেশন বনাম অ্যাবরশনের নির্বাচন।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি চার বছর পর পর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হলেও কংগ্রেস নির্বাচন হয় প্রতি দুই বছর পর পর। সিনেটররা নির্বাচিত হন ছয় বছরের জন্য। এ জন্য ১০০ আসনের সিনেটের এক-তৃতীয়াংশে ভোট হয় প্রতি দুই বছর পর পর। আবার কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ অর্থাৎ প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যরা নির্বাচিত হন দুই বছরের জন্য। তাই কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫টি আসনে ভোট হয় প্রতি দুই বছর পর পর। একজন প্রেসিডেন্টের মেয়াদের ঠিক মধ্যভাগে কংগ্রেসের এই নির্বাচনকে তারা মিডটার্ম ইলেকশন বলে। মজার বিষয় হচ্ছে, ১৯৩৮ সাল থেকে দুটি ব্যতিক্রম ছাড়া মিডটার্ম ইলেকশনে সব সময়ই ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের দল আসন হারায়। ১৯৩৮ সালে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ৭৭টি আসন হারান মিডটার্ম ইলেকশনে। ২০১৮ সালের মিডটার্ম ইলেকশনে সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সিনেটে দুটি আসন পেলেও হাউসে ৪১টি আসন হারান। এ ছাড়া বারাক ওবামা ২০১০ সালে উভয় কক্ষে হারান ৬৯টি আসন এবং ২০১৪ সালে হারান ২১টি আসন। এই বিবেচনায় প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মিডটার্ম ইলেকশনে হারানো আসনের বিপরীতে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অনেক কম আসন হারাচ্ছেন।
অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময়ে যে দুটি মিডটার্ম ইলেকশনে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের আসনসংখ্যা বেড়েছিল, তার একটি ছিল ২০০২ সালের মিডটার্ম ইলেকশন। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াকার বুশের সময়ে এই নির্বাচন হয়। নাইন-ইলেভেনের টুইন টাওয়ার হামলার পরপরই এই নির্বাচন হয়। বিশ্লেষকদের ধারণা, আমেরিকার জনগণ তখন দেশপ্রেমে উজ্জীবিত ঐক্যবদ্ধ ছিল। তাই প্রেসিডেন্টের হাতকে শক্তিশালী করে শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ম্যান্ডেট দেন।
কিন্তু কোনো বিশ্লেষণ কাজ করেনি প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের বেলায়। বিল ক্লিনটন ১৯৯৪ সালে তাঁর প্রথম মিডটার্ম ইলেকশনে ৬০টি আসন হারালেও দ্বিতীয় মেয়াদে যখন মনিকা লিউনস্কি স্ক্যান্ডালে নাজেহাল, তখন ১৯৯৮ সালের মিডটার্ম ইলেকশনে পাঁচটি বেশি আসনে বিজয়ী হন। মনিকার সঙ্গে হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসের দিনগুলোতে প্রেম ও যৌনতাকে এককথায় মনিকা-ক্লিনটন স্ক্যান্ডাল হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। মনিকা লিউনস্কি হোয়াইট হাউসে একজন শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করেন ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত। ওই সময়ে তিনি প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সান্নিধ্যে আসেন এবং জন্ম নেয় স্ক্যান্ডালের। প্রথম দিকে প্রেসিডেন্ট অস্বীকার করলেও বিভিন্ন প্রমাণ তাঁকে বাধ্য করে সম্পর্কটি স্বীকার করতে। শেষ পর্যন্ত মনিকার সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে প্রেসিডেন্ট মুখ খুলতে বাধ্য হন এবং তাঁর স্ত্রী হিলারি ক্লিনটনও জাতির কাছে এ জন্য ক্ষমা চান। হিলারি এবং আমেরিকানরা তাঁর স্বীকারোক্তি ও ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি মেনে নেয়। এ জন্য মিডটার্ম এবং ইমপিচমেন্টের হাত থেকে বেঁচে যান। এই স্ক্যান্ডাল নিয়ে মনিকা লিউনস্কিও লাভবান হন। ১৯৯৯ সালে অ্যান্ড্রু মরটন মনিকার জীবন ও এই স্ক্যান্ডাল নিয়ে বই লেখেন ‘মনিকাস স্টোরি’। মনিকার ব্যক্তিগত ক্যারিয়ার ও অর্থবিত্তের মালিক হতেও কাজ করেছে এই স্ক্যান্ডাল। এই অসম প্রেমের জোয়ারে হিলারি ক্লিনটন ছাড়া প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন এবং মনিকা লিউনস্কি কেউই ক্ষতিগ্রস্ত হননি।
এবারের ৮ নভেম্বরের মিডটার্ম ইলেকশনের ফল আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বড় ধরনের কোনো প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না। বৈদেশিক নীতিতে ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকানদের মধ্যে কেউ একটু বেশি সরব, কেউ তুলনামূলক কম সরব থাকে। নীতি অনেকটা একই রকম থাকে। ইলেকশনের পর স্যাংশন বিষয়ে কোনো পরিবর্তন আসে কি না দেখার জন্য বাংলাদেশের যাঁরা অপেক্ষা করছেন—তাঁরাও কোনো পরিবর্তন দেখবেন বলে মনে হয় না। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষায় বাংলাদেশের অবস্থান এবং অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতিই এ অবস্থার পরিবর্তন করতে পারে। বর্তমান স্যাংশনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আমলে ২০১৮ সালের পর থেকে। তাই যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট পরিবর্তন কিংবা হাউসে হারা-জেতায় বাংলাদেশের ব্যাপারে বড় কোনো পরিবর্তন হবে না, যদি না বৈশ্বিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে বাধ্য হয় ভিন্ন কোনো কারণে।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিকরা এখন ধীরে ধীরে কাজ শুরু করবেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট ইলেকশন নিয়ে। সাধারণ মানুষ দুই দিন আগে ভোট দিয়েছেন এটা মিডিয়া ছাড়া আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমনকি ভোটের দিনও মানুষ কাজের ফাঁকে ফাঁকে ভোট দিয়েছেন। যাঁরা কাজের জন্য ভোট দিতে পারবেন না তাঁরা অগ্রিম ডাকযোগে বা সশরীরে গিয়ে ভোট দিয়েছেন। রাজনীতি, ভোট কোনো কিছুই যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের কাছে কাজের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয়। রাজনীতি যখন জীবিকা এবং ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রে ভোটাররা ভোটের মাধ্যমে পরিবর্তনের অপেক্ষায় থাকে।
লেখক : রিয়েলটর ও মর্টগেজ ব্যাংকার
মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্র
[email protected]
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন