এ দেশের সাধারণ মানুষ গণমাধ্যমে প্রায় প্রতিদিনই সরকার ও বিরোধী উভয় রাজনৈতিক দলের মুখপাত্রদের বক্তব্য, পালটা বক্তব্য শুনে থাকে। যেহেতু গণমাধ্যম হিসাবে পরিচিত ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় এসব বক্তব্য প্রচারিত হয়, তাই সব কথা দলীয় গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকে না। সবার জন্য উন্মুক্ত বিষয় হিসাবেই প্রচারিত হয়। তাই বক্তব্যগুলোকে ‘রাজনৈতিক বক্তব্য’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দুই পক্ষের নেতাদের বক্তব্য সাধারণ দেশবাসীর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হওয়া উচিত। কারণ, কার্যত রাষ্ট্রক্ষমতা এ দুই দলের মধ্যেই পালাবদল হওয়ার কথা।
অতীতে তৃতীয় শক্তি হিসাবে জাতীয় পার্টি অনেক বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলেও এখন দলীয় শক্তির বিচারে সে সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। বিএনপি যদিও অতীতের মতো সবল অবস্থানে নেই, তবুও নেতৃত্ব সুনির্দিষ্ট ও দৃঢ় হলে একটি বড় দল হিসাবে বিএনপি ঘুরে দাঁড়াতেও পারে। তাই সাধারণ মানুষের কাছে সম্মানিত নেতা-আপনারা গুরুত্বপূর্ণ। আপনাদের যে দলের বক্তব্য যখন শুনি, তখন তা এতটাই যুক্তিপূর্ণ থাকে যে, তাৎক্ষণিকভাবে মনে হয় সেটিই যথার্থ। পরক্ষণে দ্বিতীয় পক্ষের বক্তব্যও ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে সত্য অনুসন্ধানে সাধারণ মানুষকে গোলকধাঁধায় পড়তে হয়। আপনারা এক পক্ষ বলেন, ‘জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সরকার পতন ঘটাবেন’, পরক্ষণে অন্যপক্ষ বলেন, ‘জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনের নামে অরাজকতা প্রতিহত করবেন’।
এসব শুনে সাধারণ জনগণ নিশ্চয়ই ভাবেন বিএনপির ‘জনগণ’ ও আওয়ামী লীগের ‘জনগণে’র বাইরে আমজনতা আরেক ধরনের ‘জনগণ’। প্রায়ই আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপি নেতাদের ষড়যন্ত্রকারী, দুর্নীতিপরায়ণ, লুটেরা ও চোর বলে থাকেন। আবার একই অভিধা আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপরও অর্পণ করেন বিএনপি নেতারা। এভাবে আমাদের ভাগ্যনিয়ন্তা দুই রাজনৈতিক দলের নেতারা পরস্পরের চরিত্র উন্মোচন করেন। তাই হতাশ হতে হয় সাধারণ মানুষকে। তারা ঘোর অন্ধকার দেখতে পান রাজনীতির আকাশে।
আমাদের এ দুই ধারার গুরুত্বপূর্ণ নেতারা যখন কথা বলেন, তখন গণতন্ত্রের এ অতন্দ্র প্রহরী মান্যবরদের জিজ্ঞেস করার মতো মনে অনেক প্রশ্নের উদয় হয়। যেহেতু জননেতারা প্রকৃত জনগণের কাছ থেকে অনেকটা দূরে বসে কথা বলে যান, তাই মানুষের মনে প্রশ্ন জাগ্রত হলেও তারা এসবের উত্তর জানতে পারেন না। আমি সাধারণ মানুষের একজন নগণ্য সদস্য হিসাবে এসব অব্যক্ত প্রশ্ন করে মনের মেঘ কাটাতে চাই। উত্তর পাব না জেনেও প্রশ্নগুলো উত্থাপন করা জরুরি মনে করছি। অবশ্য প্রশ্নের মিছিল তৈরি হচ্ছে প্রতিদিন। এর থেকে দু-একটি প্রশ্নই উত্থাপন করব এখানে।
প্রথমে আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে বিনীত প্রশ্ন, ১. মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। জে. এরশাদের ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ বহাল রেখে ও সাম্প্রতিক সময়ের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনি ধারা প্রতিষ্ঠা করে কি আপনারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে পারছেন? ২. রাজনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য আপনারা কি উচ্চশিক্ষার স্বাভাবিক ধারাকে ধ্বংস করছেন না? দলীয় ছাত্রদের শিক্ষার্থীবান্ধব না করে ক্যাম্পাসে তাদের উন্মত্ত আচরণকে কি আপনারা পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছেন না? নষ্ট ধারার তাঁবেদার ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতিকে বেড়ে উঠতে দিয়ে আপনারা কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক অগ্রগতিকে সংকটাপন্ন করে তুলছেন না? একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা, গবেষণার ক্ষেত্র কতটা ঔজ্জ্বল্য ছড়াবে, তা অনেক ক্ষেত্রেই নির্ভর করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ওপর। কিন্তু আপনারা রাজনৈতিক বিবেচনায় উপাচার্য নিয়োগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ব্যবস্থা আরোপ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দলীয় দাপটের আখড়াতে পরিণত করছেন না? বঙ্গবন্ধুর উচ্চশিক্ষা ভাবনাকে কি আপনারা ধারণ করতে পারছেন? অবশ্য এ ধারার অভিযোগ অতীতের বিএনপি সরকারের কাছেও করা যায়; ৩. রাজনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য আপনারা আমলাতন্ত্র, রাজনৈতিক অঞ্চলের মানুষ ও ব্যবসায়ী নেতাদের অনেককে কি দুর্নীতিপরায়ণ করে তুলছেন না?
বিএনপি অনেকদিন থেকে রাজনৈতিক দুর্যোগে দিন কাটাচ্ছে। এর একটি কারণ রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কিছুটা পিছিয়ে পড়ার খেসারত আর অনেকটা নেতৃত্বহীনতা ও আদর্শিক পরিচয়ের প্রশ্নে জনগণের সামনে নিজেদের অস্পষ্ট অথবা জটিল অবস্থানের স্বাভাবিক পরিণতি। এজন্য বিএনপির মুখপাত্রদের মিডিয়ার সামনে প্রতিদিনের বক্তব্যের পিঠে সাধারণ জনগণের নানা প্রশ্নের অবকাশ থেকে যাচ্ছে। সরকার ও সরকারি দল সম্পর্কে বিএনপি নেতারা প্রতিদিন নানা অভিযোগ করে যাচ্ছেন। এর মধ্যে সত্যতা যে নেই, তা নয়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, অভিযোগকারী নেতৃত্ব আর সংগঠন হচ্ছে বিএনপি। দলটি দীর্ঘদিন রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। বিএনপি নেতারা ক্ষমতায় থেকে একই কাজ করেছেন। অনেকটা কার্বন কপি যেন। দুই দল ক্ষমতায় থেকে যেসব অপকীর্তি করেছে-গণতন্ত্রকে সংকটে ফেলেছে, দুর্নীতির দরজা খুলে দিয়েছে, দলীয় নেতাকর্মীদের সন্ত্রাসী বানিয়েছে, ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতির নেতিবাচক ধারাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে শিক্ষার পরিবেশকে সংকটে ফেলেছে, দলীয়করণের দাপটে জনজীবনের স্বাভাবিক চলার ছন্দ বিপন্ন করেছে।
এখন যদি দুই দলের কীর্তি-অপকীর্তিকে কাটাকাটি করি, তবে বিএনপির ভান্ডারে বলার মতো বড় কিছু থাকে না। কিন্তু হাজারটা প্রশ্ন রাখার পরও আওয়ামী লীগের ভান্ডারে অবশিষ্ট হিসাবে মূল্যবান কিছু মণি-কাঞ্চন পাওয়া যাবে। সাধারণ মানুষ হয়তো গভীরভাবে সব কিছুর তাৎপর্য খুঁজবে না। তবে দেখবে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তাদের জীবনমান বেড়েছে। অর্থনৈতিকভাবে অপেক্ষাকৃত স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে সংসারে। দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন দৃশ্যমান হয়েছে। তাই বলতেই হবে, রাজনীতির রেসে বিএনপি অনেকটা পিছিয়েই আছে। এমন বাস্তবতায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামসহ অন্য নেতারা প্রতিদিন মিডিয়ার সামনে যেসব বক্তব্য উত্থাপন করেন, তাতে দুই দলের নিত্যকার রাজনৈতিক ঝগড়া ও অভিযোগ-পালটা অভিযোগ মানুষের গা সওয়া হয়ে গেছে। নেতারা ক্লান্ত না হলেও সাধারণ মানুষ ক্লান্ত হয়ে গেছে। আমার তো মনে হয়, যার যার দলের কর্মী-সমর্থকরাও ক্লান্ত। রাজনৈতিক বক্তব্যেরও একটি স্মার্টনেস থাকে, তা আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এরপরও যে প্রশ্নগুলো মানুষ করতে চায়, তা তো উত্থাপন করতেই হবে।
১. বিএনপিকে দেশপ্রেমিক দল হিসাবে ভাবতে হলে আগে স্পষ্ট করতে হবে দলটি পাকিস্তানের প্রতি অনুগত নয়। এ সূত্রে প্রথম বলতে হবে দলটির নেতা জিয়াউর রহমান বিএনপি সরকার গঠন করে পাকিস্তানপন্থি স্বাধীনতাবিরোধী শাহ আজিজুর রহমানকে কেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন? ২. জিয়াউর রহমান-উত্তর বেগম খালেদা জিয়ার আমলে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের পক্ষ নিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত চিহ্নিত জামায়াতে ইসলামী দলের নেতাদের-যারা গণহত্যা, নারী নির্যাতন, বুদ্ধিজীবী হত্যায় সরাসরি যুক্ত ছিল ও নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদের কেন মন্ত্রী বানিয়েছেন এবং এদের অপবিত্র হাতে বাংলাদেশের পবিত্র পতাকা তুলে দিয়েছিলেন? ৩. মুক্তিযুদ্ধ একটি দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের শেষ পরিণতি। ভাষা আন্দোলন থেকেই পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সোচ্চার হয়েছিল বাঙালি। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারণা তীব্র হতে থাকে। ধীরে ধীরে বাঙালি স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সোচ্চার হয়। এ গতিধারাতে মুক্তি সংগ্রামের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে বাঙালি। আর এসব আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে জেল-জুলুম সহ্য করে সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৭০-এর নির্বাচনে বিপুল বিজয় অর্জন করে। নিরঙ্কুশ বিজয়ী হলেও বাঙালির হাতে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা ছেড়ে না দিয়ে পাকিস্তানি শাসকচক্র ষড়যন্ত্র শুরু করে। বাঙালি তখন পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার দাবি তুলে।
বঙ্গবন্ধু সুকৌশলে স্বাধীনতার ডাক দেন ৭ মার্চে। ইঙ্গিত বুঝতে অসুবিধা হয়নি বাঙালির। ২৫ মার্চে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে ৭ মার্চের গ্রিন সিগন্যালে বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। চট্টগ্রাম সেনানিবাসে রাজনীতির ধারাবাহিকতায় একজন অচেনা মেজর নিজেই পরবর্তী সময়ে তার লেখায় এ গ্রিন সিগন্যালের কথা বলেছিলেন। গণহত্যা শুরু হলে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার আগে অফিসিয়াল স্বাধীনতার ঘোষণাও দিয়েছিলেন। ২৭ মার্চ এ ঘোষণাটি পাঠ করলেন সেনাবাহিনীর একজন মেজর; যিনি জিয়াউর রহমান। যে সত্যটি রাষ্ট্রপতি জিয়া বেঁচে থাকতে অস্বীকার করেননি। তাহলে বিএনপি নেতাদের কাছে সবিনয়ে প্রশ্ন করি, হঠাৎ আপনারা জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে প্রচারণা শুরু করলেন কেন? আপনারা কেমন করে প্রজন্মকে বিশ্বাস করাবেন। বাংলাদেশের দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামে যার কোনো সংস্পর্শ ছিল না, হঠাৎ কোনো অচেনা মেজর কালুরঘাট বেতারের (সাধারণ শ্রোতার কম ব্যবহৃত) ১০ কিলোওয়াটের দুর্বল তরঙ্গে (দুর্বলভাবে বড়জোর ৬০ মাইল দূরত্ব পর্যন্ত শোনা সম্ভব) স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন আর সারা দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এতে কি আপনাদের ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার বিশেষ জন্মদিন পালনের মতো বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হবে না? বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমান সভ্য দেশের সংজ্ঞা থেকে কী কারণে বেরিয়ে এসে খুনিদের রক্ষা করতে ইনডেমনিটি জারি করলেন? শুধু তাই নয়, শাস্তির বদলে খুনিদের পুরস্কৃত করলেন? আমি জানি না, এর কোনো উত্তর আছে কিনা বিএনপি নেতাদের কাছে।
প্রশ্ন করার আরও অনেক কিছু ছিল। আপাতত এটুকুর উত্তর পেলেই যথেষ্ট। আমি জানি না, তখততাউসে বসে আমাদের জাতীয় নেতারা সাধারণ মানুষের বুকের ভেতরের এসব প্রশ্নের আওয়াজ শুনতে পান কিনা! নাকি মানুষ যাই বলুক, আদিষ্ট হয়ে কানে তুলো আর চোখে ঠুলি পরে দুই পক্ষ প্রতিদিন বিরোধী দল বিরোধী এবং সরকারবিরোধী শব্দবাণ ছুড়তেই থাকবেন! আপনারা একবারও পরখ করেন না, এসব বাণের ধার অনেক আগেই ভোঁতা হয়ে গেছে। আপনাদের রাজনৈতিক ঝগড়া হাস্যকৌতুকের বিষয়ে পরিণত হোক, এটি কেউ চাইবে না। সত্য সামনে রেখে তর্ক-বিতর্ক করলে রাজনীতির মাঠে প্রতিপক্ষ পিছিয়ে পড়বেন-একথা কেন মনে হয় আপনাদের! আমাদের জাতীয় নেতারা সব মানুষের চোখে সম্মানিত থাকুন, এমনটিই প্রত্যাশা থাকবে এ দেশের জনগণের।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন