রেজানুর রহমান
রিকশাচালক, সবজি বিক্রেতা, কাজের বুয়া, বাসার দারোয়ান, বাড়িওয়ালাসহ আরও অনেকে যেন মওকা পেয়ে গেছেন। কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ করেই যেন সবাই যার যার অবস্থানে দাঁড়িয়ে ভাড়া, বেতন অথবা দাম বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত।
পরিচিত এক রিকশাওয়ালা প্রায়শই আমাকে এখানে সেখানে নিয়ে যায়। ২০ টাকার ভাড়া হাঁকল ৩০ টাকা। জিজ্ঞেস করলাম, চাচা মিয়া হঠাৎ যে ভাড়া বাড়ালেন? আপনার রিকশা কি তেলে চলে? রিকশাওয়ালার তাৎক্ষণিক জবাব, স্যার আপনি ঠিকই বলছেন। আমার রিকশা তেলে চলে না। কিন্তু জীবনডা তো তেলের উপরই নির্ভর করে চলে। সরকার তেলের দাম বাড়াইল, সাথে সাথে সব জিনিসপত্রের দাম অটোমেটিক বাইড়্যা গেল। আগে যে আলু কিনতাম ২০ টাকায় এখন সেই আলু ৩০ টাকা। তাও পুরান আলু। নতুন আলুর যে দাম তাতে ধইর্যা দেখারও সাহস করতে পারি না...
রিকশাওয়ালা ভাড়া বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি দিয়েই চলছে। কোনো যুক্তিই ফেলে দেওয়ার মতো নয়। তাই বলে ২০ টাকার ভাড়া ৩০ টাকা হবে? ২০ টাকায় যদি ১০ টাকা বাড়ে তাহলে ১০০ টাকা কত টাকা বাড়বে? অংকের হিসেবে ৫০ টাকা। কয়েকদিন আগের ১০০ টাকার খরচ গিয়ে দাঁড়াবে ১৫০ টাকা।
পরিচিত এক সবজিওয়ালা প্রায়ই বাসায় সবজি দিয়ে যায়। দেখলাম সে প্রতিটি শাক-সবজির দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম ঘটনা কী? শীতকালে তো এমনিতেই শাক-সবজির দাম কমে। আপনি বাড়িয়ে দিলেন যে?
সবজিওয়ালারও ওই একই উত্তর। স্যার তেলের দাম বাইড়্যা গেছে। সে জন্য ক্যারিং কস্টও বাড়ছে... সবজিওয়ালাকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কি বাড়ছে বললে তুমি?
সবজিওয়ালা একটু যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল- ক্যারিং কস্ট। বেশ শুদ্ধ উচ্চারণ।
ক্যারিং কস্ট মানে বোঝ তুমি?
জ্বি স্যার বুঝি। মাল আনা নেওয়ার ভাড়া...
ক্যারিং কস্ট কে বাড়ালো?
বাসওয়ালারা...
ও সে জন্য তোমরাও দাম বাড়িয়েছ?
জ্বি স্যার। এইটা তো স্যার নিয়মের কথা। কান টানলে মাথা আসবেই। তেলের দাম বাড়লে জিনিসপত্রের দাম বাড়বেই...
কয়েকদিন ধরে কাজের বুয়ার মেজাজ খারাপ। প্রতিদিন সকালে বাসায় আসে। তিন ধরনের কাজ করে। ঘর ঝাড়ু– দেওয়া ও ফ্লোর মোছা একটি কাজ, কাপড় ধুয়ে দেওয়া আরেকটি কাজ। মসলা বাটা অন্য একটি কাজ। তিন কাজে প্যাকেজের আওতায় সে বেতন পায়। সে ধান্ধা শুরু করেছে বেতন বাড়ানোর। তাই বাসায় কাজ করতে এলেই মন খারাপ করে থাকে। গম্ভীর হয়ে কথা বলে। ভাবটা দেখায় সে চরম বিরক্ত। তার বিরক্তির কারণ বোঝা গেল। তেলের দাম বাড়ায় জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। তাই তারও বেতন বাড়াতে হবে। তিন কাজের প্যাকেজ নিয়ে কথা বলতে চায় সে।
কথা বলতে চায় বাড়িওয়ালাও। তেলের দাম বেড়েছে। কাজেই বাড়িভাড়া বাড়বে এটাই নাকি স্বাভাবিক নিয়ম। বাড়িওয়ালার সাথে সাথে বাড়ির দারোয়ানও তার ভাব ভঙ্গি বদলে ফেলেছে। ২০ টাকার বকশিশে সে খুশি না। মুখের উপরই বলে দিল স্যার এইটা কি দিলেন? ২০ টাকা কি কোনো টাকার মধ্যে পড়ে? অথচ দারোয়ান বাড়িওয়ালার নিকট থেকে মাসিক বেতন পায়। বাড়ির দেখাশোনা করার পাশাপাশি ভাড়াটেদের ফাইফরমায়েশ খাটা তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। অথচ বকশিশ না পেলে সে হাসি মুখে ভাড়াটের ফাইফরমায়েশ খাটে না। বরং চরম বিরক্ত হয়। বকশিশ যেন একটা অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বকশিশ না দিলে সরকারি অফিসের ফাইল নড়ে না। হোটেল রেস্তোরায় খেতে বসেছেন, খাওয়া শেষ করে নির্ধারিত বিলও দিয়ে ফেলেছেন। এখন আপনার যাবার পালা। কিন্তু বয়, বেয়ারাকে বকশিশ না দিলে আপনার মান সম্মান থাকবে না। আজকাল তো আবার জনপ্রিয় চিকিৎসকের সিরিয়াল পেতে গেলে দেড় থেকে দুই মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। তবে ঠিক জায়গায়, ঠিকমত বকশিশ দিতে পারলেই পরের দিনই সিরিয়াল পাবেন এটা নিশ্চিত। আবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বয় বেয়ারাকে বকশিশ দেননি তাহলে কপালে দুঃখ আছে আপনার। দুঃখটা কেমন তার প্রমাণ বোধকরি সাম্প্রতিক একটি দুঃখজনক মৃত্যুর ঘটনা উল্লেখ করলেই বোঝা যাবে। বগুড়ার একটি হাসপাতালে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত একজন কিশোর ভর্তি হয়েছিল। হাসপাতালেরই একজন অনিয়মিত কর্মচারীর সাথে ২০০ টাকার চুক্তি হয়েছিল। অর্থাৎ হাসপাতালে ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেবার শর্তে ওই কর্মচারী ২০০ টাকা বকিশশ দাবি করেছিল। হতভাগ্য কিশোরের দরিদ্র পিতা ওই কর্মচারীকে ১৫০ টাকা দিয়ে হাত জোড় করে বলেছিলেন, বাবারে আমার কাছে আর কোনো টাকা নাই। বাকী ৫০ টাকা দিতে পারব না। আমাকে তুমি মাফ করে দাও। অসহায় পিতাকে মাফ করেনি ওই অসৎ কর্মচারী। বরং অসহায় বাবার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে আহত কিশোরের মুখ থেকে অক্সিজেন সরঞ্জাম খুলে নেয়। ফলে অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যু হয় হতভাগ্য কিশোরের।
অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন তেলের দাম বৃদ্ধি সেই সাথে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সাথে বকশিশ প্রসঙ্গ টানার অর্থ কী? অর্থ একটা আছে। বকশিশ প্রথা একঅর্থে মানুষকে ভদ্রভাবে জিম্মি করার একটি প্রক্রিয়া। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিও ওই মানুষকে জিম্মি করারই আরেকটি কাঠি, কঠোর প্রক্রিয়া। তেলের দাম বাড়ানো হল। সাথে সাথে বাড়ল পরিবহন ভাড়াও। বলা হল ডিজেল চালিত গাড়ির ক্ষেত্রেই বাড়তি ভাড়া প্রযোজ্য হবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? সিএনজি চালিত বাস, মিনিবাসও সুযোগ বুঝে ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে। সড়ক পথের আইন অনেকেই মানছেন না। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের কারণে গত কয়েকদিনে সারাদেশে ৩৪২টি বাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বাসগুলোকে আর্থিক জরিমানা করা হয়েছে। তবুও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। প্রতিদিনই রাজধানীতে বাস ভাড়া নিয়ে পরিবহন কর্মীদের সাথে অসহায় যাত্রীদের বচসা হচ্ছে। হাতাহাতিও হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চোর পুলিশ খেলা চলছেও। পুলিশ দেখলেই পরিবহন কর্মীদের সাধু সাজার চেষ্টা। পুলিশ নাই তো অসাধু হবার তীব্র প্রতিযোগিতা। ফলে প্রতিদিন নাকাল, নাজেহাল হচ্ছে দেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন জামিল আকতার। তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে তার কি কি অসুবিধা হচ্ছে এ নিয়ে একটা ফিরিস্তি দিলেন। নিজে চাকরি করেন। স্ত্রী গৃহিনী। এক ছেলে এক মেয়ে। একটা ৭ম, অন্যটা ৮ম শ্রেণিতে পড়ে। করোনার সময় তাদের স্কুল ও কোচিং বন্ধ ছিল। তখন কোচিং চালু হয়েছে। আগে মাসে তাদের জন্য শুধুমাত্র যাতায়াত খরচ হতো সাড়ে তিন হাজার টাকা। এখন মাসে খরচ হবে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা। পাশাপাশি কোচিং ফি তো আছেই। দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় কাঁচা বাজার বাবদ এখন নাকি তাকে মাসে ৩/৪ হাজার টাকা বেশি খরচ করতে হবে। একজন বুয়া বাসায় কাজ করেন। তিনিও বেতন বাড়ানোর দাবি তুলেছেন। বাড়িওয়ালা চাপ দিচ্ছেন বাড়ি ভাড়া বাড়ানোর জন্য। জামিল আকতার হিসেবে করে দেখেছেন পরিবহনে তেলের ভাড়া বেড়ে যাওয়া তার সংসারে কমপক্ষে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকার বাড়তি সংস্থান দরকার। কিন্তু বেতন তো বাড়ছে না। তাহলে কী করবেন জামিল আকতার? এই যে তেলে তেলে গরীবের জন্য তেলেসমাতি একটা কাণ্ড ঘটে গেল এর দায় কার? জবাবটা কার কাছে চাইব?
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন