অনেক বিষয় রয়েছে, যা নিয়ে বৃহত্তর স্বার্থে আপস এবং কিছুটা ছাড় দেওয়া যায়। কিন্তু রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে এমন বিষয় নিয়ে হেলাফেলা বা আপস করার অর্থ আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া। শাসককুল কখনো কখনো নিজেদের মসনদ রক্ষা ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ইস্যুর মধ্যে ভারসাম্য খুঁজতে গিয়ে আম-ছালা দুটিই হারিয়েছেন। ইতিহাসে এর অনেক উদাহরণ আছে। ঘরের মধ্যে থাকা ছদ্মবেশী শত্রুর চাটুকারিতা-মোসাহেবিতে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং তাতে শুধু ক্ষমতা হারা নয়, নিজের জীবন ও রাষ্ট্র—দুটিই গেছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, রাজ্য শাসনে রাজার জন্য আপন-পর বলতে কিছু নেই, সবাই আপন, আবার সবাই পর। বিশেষ আপন বিবেচনা ইতিহাসের অনেক মর্মান্তিক ট্র্যাজেডির জন্ম দিয়েছে। নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও মীরজাফরের মধ্যকার আত্মীয়তার সম্পর্ক ও তার পরিণতি আমাদের ইতিহাসের বড় এক ট্র্যাজেডি। আপসের পথে হাঁটায় সিরাজউদ্দৌলা নিজের জীবন হারিয়েছেন এবং তার মধ্য দিয়ে প্রায় ২০০ বছর ভারতবর্ষকে ব্রিটিশের গোলামি করতে হয়েছে। ১৭৫৭ সালের ২ জানুয়ারিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির সঙ্গে আলীনগরের সন্ধি যদি স্বাক্ষর না করতেন, তাহলে ভারতবর্ষের ইতিহাস ভিন্ন হতে পারত।
লেখার শুরুতে ইতিহাসচর্চা এই কারণে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে ঘটে চলা অনেক কিছু নিয়ে মনে হয় আমরা হেলাফেলা ও উপেক্ষা করছি অথবা আপসের পথে হাঁটছি, যা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক। সম্প্রতি একটি ভিডিও আমার মোবাইলে এসেছে। কারা এটি তৈরি করেছে তার পরিচয় ভিডিওতে পাওয়া যায় না। তবে পর্দার ডান দিকের ওপরের কর্নারে লেখা আছে কক্স টিভি। দেখা যায় বেশ কিছু রোহিঙ্গা এক জায়গায় জড়ো হয়েছে, যার বেশির ভাগ নারী, যাদের সঙ্গে একজন রিপোর্টার কথা বলছেন। রিপোর্টারের চেহারা একবারও পর্দায় দেখা যায়নি। বোঝা যায় রিপোর্টার পূর্বপরিকল্পিত লিডিং কোয়েশ্চেন মুখে তুলে দিচ্ছেন এবং তার উত্তর দিচ্ছেন জড়ো হওয়া রোহিঙ্গারা। আপনারা নাগরিক অধিকার চান? হ্যাঁ, আমরা নাগরিক অধিকার চাই, উত্তর দিলেন একজন বোরকা পরা রোহিঙ্গা নারী। রিপোর্টার বলছেন, আপনারা শুদ্ধ ভাষায় বলুন। আবার প্রশ্ন, আপনারা বার্মা যাবেন না? না, আমরা বার্মা চিনি না, এখানে আমাদের জন্ম, এখানেই আমরা স্বাধীনতা চাই। একসঙ্গে সবাই বলছেন, রিফিউজি জীবন চাই না, বার্মা চিনি না। এ রকম একটা ভিডিও কারা, কোথায়, কিভাবে ধারণ করেছেন তা আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তবে বোঝা যায় অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে এটা করা হয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যু বাংলাদেশের জন্য একটা বড় জাতীয় সংকট। এই সংকটকে আরো ঘনীভূত এবং সেটিকে পুঁজি করে দেশি-বিদেশি কিছু পক্ষ আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকারকে বড় একটা উভয়সংকটের মধ্যে ফেলতে চেষ্টা করছে এবং আগামী দিনে সেটি আরো জোরদার হবে তা বোঝা যায়। প্রত্যাশা করি, সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই চ্যালেঞ্জ সঠিকভাবে মোকাবেলা করবে। তবে দেরি হয়ে যাচ্ছে। হাতের আঙুুলের ফাঁক দিয়ে এরই মধ্যে অনেক কিছু বেরিয়ে গেছে। সেগুলো হাতের মুঠোয় আনা কতখানি সহজ হবে জানি না। একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর একটা উদ্ধৃতি দিই : For it is by foreseeing difficulties from afar that they are easily provided against; but awaiting their near approach, remedies are no longer in time, for the malady has become incurable
(সূত্র : নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি, দ্য প্রিন্স, পৃষ্ঠা ১১)। অসুখ জটিল হওয়ার আগেই ওষুধ প্রয়োগের কথা বলেছেন ম্যাকিয়াভেলি। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সজাগ আছে বলেই আমার মনে হয়।
গত বছর কয়েক হাজার রোহিঙ্গার জন্য বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেওয়ার সৌদি দাবি এবং এ বছর বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে সব রোহিঙ্গার জন্য প্রায় একই রকম দাবি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে। কিন্তু কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে অনেক ঘটনা ঘটছে এবং ঘটানো হচ্ছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কক্সবাজার ক্যাম্পের দায়িত্বে ওখানে যাঁরা রয়েছেন তাঁরা বিদেশি এজেন্সির ওপর সব কিছু ছেড়ে দিয়ে খুব ভালো আছেন বলে স্থানীয় সাংবাদিকদের তথ্য সূত্রে জেনেছি। উল্লিখিত ভিডিওতে দেখা যায়, একজন বোরকা পরিহিত নারী বলছেন, আমার বয়স ৩২ বছর, বাংলাদেশে আমার জন্ম, আমি বার্মা চিনি না, জন্মগত অধিকার চাই। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের ঘটনার এক বছর আগে ২০১৬ সালের জুন মাসের ৬ তারিখে একটি সহযোগী দৈনিকে লেখা আমার কলাম থেকে একটা উদ্ধৃতি দিই, ‘প্যান ইসলামিজমের উন্মাদনায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কের আরো অবনতি হবে। বাংলাদেশের ভূখণ্ডীয় নিরাপত্তার জন্য জটিল ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। কক্সবাজার বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্ট্র্যাটেজিক লোকেশন। সুতরাং সুদূরপ্রসারী দূরদৃষ্টি ও পরিকল্পনা না থাকলে সংকট মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার পর তখন সেগুলো সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে। কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মিলে বাংলাদেশে এখন চার লাখের মতো রোহিঙ্গা আছে। আরো পাঁচ লাখ এসে ১০ লাখ হলে কী হবে ভাবা যায় (মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার, দুর্ভাগা রোহিঙ্গা জাতি সংকটে বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা ৬৩)। ২০১৬ সালের ১২ মে রাতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আনসার ক্যাম্পের ওপর রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের আক্রমণ হয়। তাতে ১১টি রাইফেল ও ৫৯০ রাউন্ড গুলি লুট এবং আনসার কমান্ডার আলী হোসেন নিহত হন। পরবর্তী সময়ে ওই আক্রমণকারী দলের কমান্ডার গ্রেপ্তার হয়, নাম ওমর ফারুন এবং সে পাকিস্তানি নাগরিক। কক্সবাজারে অবস্থানকারী বৃহত্তর রোহিঙ্গারা নিরীহ। তারা সীমাহীন গণহত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের প্রতি সবার সহানুভূতি ও সমর্থন রয়েছে। তাদের ওপর নির্যাতনের প্রতিকারে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সব কিছু করা হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে বেশ কিছু সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে। এরা নারী পাচার, ড্রাগ ব্যবসা, অস্ত্রের চোরাচালান, চাঁদাবাজিসহ বহুবিধ অপতৎপরতায় লিপ্ত, যা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথে বড় এক অন্তরায়। নিরীহ রোহিঙ্গারা এদের কাছে পুরোপুরি জিম্মি।
ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের কার্যক্রমের সময় এবং ২০১৯ সালে প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়া যখন শুরু হতে যাচ্ছিল তখন রাতের অন্ধকারে ক্যাম্পের ভেতরে ঘরে ঘরে গিয়ে এই সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে বলেছে, বার্মাতে ফেরত যেতে রাজি হলে এবং ভাসানচরে যেতে সম্মত হলে তাদের গুলি করে মারা হবে। বাংলাদেশের কিছু ব্যক্তি টেলিভিশনের টক শোতে বলছেন, রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে কোনো নেগেটিভ ও খারাপ কথা বলা যাবে না। তাতে নাকি মিয়ানমার সুবিধা পাবে এবং প্রত্যাবাসনের পথ বাধাগ্রস্ত হবে। বরং আমি বলব, এই অপরাধীদের সামনে আনলে প্রত্যাবাসনের পথ সুগম হবে। বৃহত্তর নিরীহ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী উপকৃত হবে, তারা মাতৃভূমিতে ফেরত যেতে পারবে। কক্সবাজার ক্যাম্পের ভেতরে কী ঘটছে তা মিয়ানমার সরকার জানে না, এমন ধারণা একেবারেই ভুল। সবার জানা একটা কথার পুনরুল্লেখ করি। নিরীহ মানুষ হত্যা করে গাছে উল্টোভাবে লাশ ঝুলিয়ে রাখার ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পরও তখনকার মন্ত্রী জামায়াত নেতা নিজামী বলেছিলেন, বাংলা ভাই বলে কিছু নেই, ওটা মিডিয়ার সৃষ্টি। তখনকার সরকারেরও এ রকম ধারণা ছিল, বাংলা ভাইয়ের অপকর্মের কথা স্বীকার এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে সরকারবিরোধীরা সুবিধা পেয়ে যাবে। এ রকম প্রটেকশন পেলে অপরাধীদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় না, দ্বিগুণ উৎসাহে আরো বড় অপরাধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। একসময় তারাই প্রটেকশন প্রদানকারী প্রভুর বিরুদ্ধে ফ্রাংকেনস্টাইনের দানবের মতো অস্ত্র ধারণ করে। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। অপরাধকে ঢাকা দিয়ে, অপরাধীকে আড়াল করে কোনো সমস্যার সমাধান কোনো দিন হয়নি। বরং তার পরিণতি সব সময় খারাপ হয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান পরিষ্কার। মিয়ানমার সরকার বা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী কারো পক্ষে বা বিপক্ষে আমাদের অবস্থান নয়। আমাদের অবস্থান মানবতা, ন্যায় ও আন্তর্জাতিক আইনের পক্ষে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সীমাহীন অপরাধের বিরুদ্ধে আমরা স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছি। একইভাবে রোহিঙ্গা অপরাধীদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান নিলে বরং প্রত্যাবাসনের পথ সুগম হবে। প্রত্যাবাসনের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। তবে সেটি কবে নাগাদ সফল হবে তার কোনো নিশানা আপাতত নেই। তাই কক্সবাজারের ক্যাম্পের ভেতরে সংঘটিত ঘটনাবলির ওপর আরো কড়া নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।
রোহিঙ্গাদের ভেতর থেকে উৎপত্তি হওয়া সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, তার সঙ্গে দেশি-বিদেশি চক্রান্ত এক হয়ে প্রত্যাবাসনের পথটি যেন আরো কঠিন করতে না পারে তার জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ দরকার। লেখার শুরুতে উল্লিখিত ভিডিওটি যাঁরা করেছেন তাঁরা বিচ্ছিন্ন কেউ সেটি ভাবা মোটেও উচিত হবে না। তাঁদের পেছনে কারা রয়েছে তা উপলব্ধি করা প্রয়োজন। মানবিকতা ও মানবাধিকারের পক্ষে আমরা সব সময় থাকব; কিন্তু সেই ধোয়া তুলে বা তার আড়ালে কেউ যেন রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকে হুমকির মধ্যে ফেলতে না পারে তার জন্য করণীয় নির্ধারণে দ্বিধাহীন থাকতে হবে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সব কিছুর ঊর্ধ্বে। এই জায়গায় দেখি কী হয় ভেবে অপেক্ষা করা মানে জেনেশুনে বিপদ ডেকে আনা, যে কথা ‘দ্য প্রিন্স’ গ্রন্থে ম্যাকিয়াভেলি বলেছেন।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
[email protected]
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন