প্রভাষ আমিন
শোনার পর প্রথমে আমি ভেবেছি, এটা হেফাজতে ইসলামের প্রস্তাব। কারণ, মনে মনে যাই থাক, প্রকাশ্যে এমন নারীবিরোধী অবস্থান শুধু হেফাজতে ইসলামের পক্ষেই সম্ভব বলে এতদিন জেনে এসেছি। হেফাজতের উত্থানটা শুরু হয়েছিল নারী নীতির বিরোধিতার মধ্যে দিয়ে। শুরু থেকে কখনোই হেফাজত তাদের নারী বিদ্বেষ গোপন করেনি। হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির আল্লামা শফী নারীকে তুলনা করেছিলেন ‘তেঁতুলে’র সঙ্গে। তিনি নারীকে ‘ক্লাস ফোর-ফাইভ’ পড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন, যাতে তারা স্বামীর টাকা-পয়সার হিসাব রাখতে পারে। নারীকে ঘরে আটকে রাখার পরামর্শ ছিল তার। নারীদের গার্মেন্টসে কাজ করাকে তুলনা করেছিলেন জেনার সঙ্গে। নারীদের ব্যাপারে হেফাজতের নীতিই নোংরাভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন আল্লামা শফী, পরে যার নামই হয়ে গিয়েছিল ‘তেঁতুল হুজুর’। হেফাজত এই নীতি থেকে কখনও সরে আসেনি। বরং হেফাজত নেতারা তাদের নানা বক্তব্যে-ওয়াজে রসিয়ে রসিয়ে নারীকে স্রেফ পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করেন। তাদের দৃষ্টিতে স্বামীকে সন্তুষ্ট করা এবং সন্তান লালন-পালন ছাড়া নারীর আর কোনও উপযোগিতা নেই। সাম্প্রতিক তাণ্ডব এবং মামুনুলের রিসোর্ট কাণ্ডে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে দারুণ চাপে পড়ে যায় হেফাজতে ইসলাম। আগের কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। আমি ভেবেছি, নতুন কমিটিকে আলোচনায় আনতে এবং নতুন করে নিজেদের জানান দিতেই হেফাজত এই সুপারিশ করেছে। এই স্বভাব অবশ্য তাদের পুরনো। নারী নীতির বিরোধিতা করে হেফাজত প্রথমে আলোচনায় আসে। এরপর ঢাকা ঘেরাও করে তো তোলপাড় সৃষ্টি করে। আল্লামা শফীর মৃত্যুর পর হেফাজত মাঠে নামে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতা এবং পরে নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতা নিয়ে। আমি ভেবেছি, হেফাজতের নতুন কমিটি এবার মাঠে নেমেছে নারী ইউএনওর বিকল্পের সুপারিশ নিয়ে।
কিন্তু যখন জানলাম প্রস্তাবটি হেফাজতের নয়, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির, তখন আমার বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতাও ফুরিয়ে যায়। আমার ভয়টা অন্য জায়গায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে হেফাজত আপাতত কিছুটা স্তিমিত হলেও তারা তাদের আদর্শ ছড়িয়ে দিতে পেরেছে সংসদ পর্যন্ত! বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাঁর মরদেহে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। এ অনুষ্ঠানে জেলা সদরে জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি যেখানে নারী ইউএনও আছেন; সেখানে সহকারী কমিশনার (ভূমি), উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বা এই কোনও কর্মকর্তাকে বিকল্প রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। বৈঠক শেষে কমিটির সভাপতি শাজাহান খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘মহিলারা তো জানাজায় থাকতে পারেন না। তাই মহিলা ইউএনও গার্ড অব অনার দিতে গেলে স্থানীয় পর্যায়ে অনেকে প্রশ্ন তোলেন। তাই মহিলার বিকল্প একজন পুরুষকে দিয়ে গার্ড অব অনার দেওয়ার প্রস্তাব এসেছে। আমরা মন্ত্রণালয়কে এটা পরীক্ষা করে দেখতে বলেছি।’ শাজাহান খান নিজেও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তবে তিনি নানা কারণে আলোচিত, সমালোচিত, বিতর্কিত। কিন্তু নারী ইউএনওর বিকল্প খোঁজার যে কারণ তিনি উল্লেখ করেছেন, তাতে তাকে নারী বিদ্বেষী এবং সাম্প্রদায়িক হিসেবেও অভিহিত করা যায়। প্রথম কথা হলো, গার্ড অব অনার একটি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান আর জানাজা একটি ধর্মীয় আয়োজন। সংসদীয় কমিটির প্রস্তাবে সুকৌশলে দুটি অনুষ্ঠানকে মেলানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত নারী ইউএনওর নেতৃত্বে গার্ড অব অনার দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও অসুবিধা হয়নি। ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী জানাজা শেষ হওয়ার পরই বীর মুক্তিযোদ্ধার কফিন জাতীয় পতাকায় মুড়িয়ে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। জানাজার সময় শুধু নারী ইউএনও’ই নন, বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের নারী সদস্যরাও কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ নিয়ে কখনোই কোনও প্রশ্ন ওঠেনি। যদি কেউ প্রশ্ন তোলেও শাজাহান খানদের দায়িত্ব সেই প্রশ্নের জবাব দিয়ে দেওয়া। মানুষের মন থেকে এই সাম্প্রদায়িকতার বিষ দূর করাই সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু উল্টো শাজাহান খানের মতো আইন প্রণেতারা সেই প্রশ্নটি সংসদ পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন।
বাংলাদেশ এখন তার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে। অনেকের অনেক শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হয়েছে। আর এই অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ অনেক বেড়েছে বলে। বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড তৈরি পোশাক খাত। আর তৈরি পোশাক খাতের মেরুদণ্ড হলো নারী শ্রমিক। নারী শিক্ষা এবং নারীর ক্ষমতায়ন প্রশ্নে বাংলাদেশে দারুণ অগ্রগতি হয়েছে। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার নারী। নারী বিচারপতি, নারী পুলিশ, নারী সেনাবাহিনী, নারী ডাক্তার সব আছে। ঘোড়ায় চড়া, রিকশা চালানো, গাড়ি চালানো, ট্রেন চালানো, বিমান চালানো, বিমান থেকে লাফ দেওয়া, সাগরে ঝাঁপ দেওয়া, পাহাড়ে চড়া হেন কোনও কাজ নেই; নারী করতে পারে না। সত্যি কথা বলতে কী, একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে বিশ্বে নারীর কাজ, পুরুষের কাজ বলে আলাদা কিছু নেই। সব কাজ সবাই পারে এবং করেও। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নানাভাবে নারীকে দমন করে রাখা হয়। কিন্তু যেকোনও বিচারে নারী পুরুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। বাংলাদেশের যেসব নারী ঘর সামলান, তাদের কাজ আসলে সংসারের চাকরি করা পুরুষের চেয়ে বেশি। আর বাংলাদেশের কর্মজীবী নারীদের তো আমার কাছে মানুষ মনে হয় না। তারা একসঙ্গে দুইটা চাকরির সমান পরিশ্রম করেন, যেটা কোনও পুরুষ কখনও করে না। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হলো, নারীরা অনেক বেশি সময়ানুবর্তী, দায়িত্বশীল, কর্মঠ, পরিশ্রমী। পুরুষের চেয়ে নারী শ্রেষ্ঠ, কারণ তিনি গর্ভধারণ করতে পারেন। নারীতেই সভ্যতার বিকাশ, অগ্রগতি, নারীতেই প্রাণের স্পন্দন। অন্য সব খাতের মতো প্রশাসনসহ সরকারের সব চাকরিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। নারীরা পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই দায়িত্ব পেয়েছেন। দেশে এখন ৮ নারী ডিসি এবং শতাধিক নারী ইউএনও আছে। তারা সুনাম ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। বরং কোনও কোনও ক্ষেত্রে নারীরা অনেক বেশি যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন। সংসদীয় কমিটির প্রস্তাবনায় রাতে না করে দিনে বীর মুক্তিযোদ্ধার জানাজার ব্যবস্থার করারও সুপারিশ করা হয়েছে। তার মানে রাতে নারীর নিরাপত্তার ইস্যুটিও সামনে আনা হয়েছে। ইউএনও নারী হোন বা পুরুষ, সেই উপজেলার সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তার দায়িত্ব। এক্ষেত্রে কোনও ব্যত্যয় হলে রাষ্ট্রের দায়িত্ব তা ঠিক করা। রাতে নারী নিরাপদে চলাচল করতে পারবে না বা নারীরা গার্ড অব অনার দিতে পারবে না, এই ভাবনাটাই আমাদের রাষ্ট্রের এক ধরনের ব্যর্থতা।
‘নারী ইউএনও’ আসলে কোনও পদ নেই যে তার বিকল্প খুঁজতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধান সব নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করেছে। সংবিধানের ২৯(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।’ আর ২৯(২) অনুচ্ছেদে লেখা আছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনও নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।’ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও হলো বৈষম্যহীন সমাজ গড়া। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সুপারিশটি সংবিধান তো বটেই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনারও পরিপন্থী। সংসদ সদস্যরা সংবিধান সংরক্ষণের শপথ নিয়েছেন। কোনও আইনে বা কারও মানসিকতায় নারীর প্রতি কোরও বৈষম্য থাকলে জাতীয় সংসদের দায়িত্ব তা সংশোধন করা, নারীর জন্য নতুন কোনও বৈষম্য সৃষ্টি করা নয়।
কিন্তু ঘটনা ঘটছে উল্টো। আমরা পদে পদে নারীকে আটকে রাখতে চাই। কখনও বলি, নারী ম্যারেজ রেজিস্ট্রার হতে পারবে না, কখনও বলছি নারী ইউএনও গার্ড অব অনার দিতে পারবে না, কখনও বলছি নারী অত রাতে অমুক জায়গায় যেতে পারবে না। এই পুরুষতান্ত্রিক এবং সাম্প্রদায়িক মানসিকতা থেকে আমাদের সবাইকে বেরিয়ে আসতে হবে।
সংসদীয় কমিটির সুপারিশ শুনে আমার মন যতটা খারাপ হয়েছিল, এই প্রস্তাবের পরের প্রতিক্রিয়ায় তা দূর হয়ে গেছে। সংসদের ভেতরে-বাইরে এই প্রস্তাবের প্রবল বিরোধিতা হচ্ছে। শাজাহান খানদের মতো দুয়েকজন অশুভ চিন্তার মানুষের প্রস্তাবের বিপরীতে শুভ চিন্তার মানুষের রীতিমতো জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। আমি নিশ্চিত এই সুপারিশ কোনও দিন বাংলাদেশে বাস্তবায়িত হবে না। তারপরও বাংলাদেশের একটি সংসদীয় কমিটিতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গার্ড অব অনার দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী ইউএনওর বিকল্প খোঁজার সুপারিশ করা হয়েছে এটিই নারীর প্রতি, মানবতার প্রতি, সভ্যতার প্রতি ‘রেকমেন্ডেশন অব ডিজঅনার’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। আমরা সবার প্রতি ন্যায্যতার আলোকে বৈষম্যহীন একটি সমতার সমাজ গড়তে চাই।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন