তুষার আবদুল্লাহ
দরজা খানিকটা ফাঁক রেখে সোমবার ভোর থেকে লকডাউনে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ছোটবেলায় দেখেছি দুই পাল্লার দরজার কড়াতে তালা দিলেও, বেশ খানিকটা ফাঁক হয়ে থাকত। ঘরের ভেতরটা দেখা যেত। ওটাকে তখন ঠিক তালাবদ্ধ ঘর মনে হতো না আমার কাছে। এবার করোনা নিয়ন্ত্রণে আনতে যে তালা মারা হলো, সেটা ওই দুই পাল্লার দরজার মতোই মনে হচ্ছে। সারাদেশ বন্ধ কিন্তু পোশাক তৈরি কারখানাসহ শিল্পকারখানা খোলা থাকবে।
এখানকার কোটি শ্রমিক প্রতিদিন বাড়ি থেকে কারখানায় আসবেন কোন বাহনে, ফিরবেন কোন বাহনে? কারখানার স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিত করা গেলেও, পথে-বাড়িতে কি সম্ভব হবে? কয়টি কারখানা স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারবে? প্রশ্নগুলোর সমাধান ও সমন্বয় না করে এমন সিদ্ধান্তে যাওয়া ঠিক হলো কিনা, সেই উত্তর বিজ্ঞনির্ধারকদের কাছে। ২০২০ এ কারখানা বন্ধ ও খোলা রাখার নাটকের পুনঃমঞ্চায়ন দেখতে চাচ্ছি না। শনিবার বিকেল থেকে যেভাবে মানুষ ঢাকা ছাড়ল, তাও করোনার বিস্তারের কারণ হয়ে উঠল কিনা, সেই ভাবনাটাও রয়ে গেল।
স্বাস্থ্যবিভাগের বড় কর্তার মুখ ফসকে বেরিয়েছিল ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল লকডাউন দেয়া হতে পারে। পরে সেটি গুজব বলা হয় সরকারের দিক থেকে। কিন্তু সাধারণের মধ্যে ধারণাটি ছিল যে, লকডাউন আসছে। ওই দিন থেকেও যদি আমরা ধরি, তবে এক প্রকার আলাপ-আলোচনা শুরু করা যেত। কীভাবে লকডাউন থেকে ষোলআনা সুফল আনা যায় এবং আন্তঃদফতর সমন্বয় কেমন হবে? সরকারের দিক থেকে ১৮ দফা নির্দেশনা এলো। কিন্তু নির্দেশনার সঙ্গে মাঠের বিস্তর ফারাক। সবকিছু স্বাভাবিক রেখে শুধু অর্ধেক মানুষ দিয়ে অফিস চালানো কি করে সম্ভব?
গণপরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে প্রস্তুতি না নিয়েই এসেছিল এমন নির্দেশনা। করোনার শুরুর দিকে অর্থাৎ ২০২০ সালেও আমরা দেখেছিলাম লকডাউন বা বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়ার বেলায় স্বাস্থ্যবিভাগ, বিশেষ করে পরামর্শক কমিটি উপেক্ষিত থেকেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দিক থেকে এমন অনুযোগ, অভিযোগ শোনা গেছে। এবারও পূর্বের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। সিদ্ধান্ত, সমন্বয় ও বাস্তবায়নে ‘হ য ব র ল’ অবস্থা থাকলে করোনার সঙ্গে পেরে ওঠা সম্ভব হবে না।
কোভিড-১৯ পুরো গোলককে যেভাবে কুপোকাত করেছে, তাতে পৃথিবীর সকল দেশ এখনও অদৃশ্য জীবাণুকে সমীহের চোখেই দেখছে। ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। আমরা ভাবছি করোনাই আমাদের সমীহ করছে। তাই তুড়ি মেরে তাকে উড়িয়ে দিয়ে আমরা অতিস্বাভাবিক জীবনে নেমে পড়লাম। ভুলে গেলাম করোনার চরিত্র বদলানোর কথা, অধিক শক্তিশালী হওয়ার ভয়ের কথা। আমাদের স্লোগান হয়ে উঠল- আমরা করেছি জয় করোনা। অদৃশ্য জীবাণু মুচকি হাসে আমাদের কাণ্ড দেখে। বলে আসো মাঠে চলো কাবাডি খেলি। সেই খেলায় নিত্য আমরা হারাচ্ছি স্বজন। হারানোর অঙ্ক অর্ধশতকের ওপর প্রায় এক সপ্তাহ। শনাক্তের সংখ্যাটাও ছয় হাজারের ওপরে। আমরা হারছি, হেরে যাচ্ছি, আমাদের অবহেলা আর অহংবোধের কারণেই।
আরেকটি বিষয় খেয়াল রাখা প্রয়োজন- গতবছর এ সময়ে কোভিড সংক্রমণের কারণে অন্যান্য রোগী চিকিৎসা বঞ্চিত হয়েছিলেন। নিয়মিত ফলোআপ না করাতে পেরে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়েছেন অনেকে। চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুও হয়েছে অনেকের। রোগীরা তাদের পরিবারের স্বজনদের কোভিড আক্রান্ত হওয়ার তথ্য গোপন করায়, চিকিৎসক ও নার্সরা করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন।
খেয়াল রাখতে হবে ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়াতে আক্রান্তদেরও আমরা করোনা রোগী বলতে শুরু করলাম কিনা। হাসপাতালগুলোতে কোভিড রোগী ও সাধারণ রোগীর জন্য আলাদা ইউনিট করা সম্ভব হলো কতটা? একইভাবে মানুষের যেন ভ্যাকসিন দেয়ার প্রতি আগ্রহ যেন কমে না যায় সেদিকটা খেয়াল রাখতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে ভ্যাকসিনের সরবরাহ।
অর্থাৎ আবারও অনেক কিছু গুছিয়ে নেওয়ার অনিবার্যতা তৈরি হয়েছে। যা গেল বছরে আমরা করে উঠতে পারিনি, সুযোগ থাকার পরও। তারপরও জীবন ও জীবিকার দিকটির একটা ভারসাম্য রাখতেও সরকারকে মনোযোগ দিতে হবে। যেন দ্বিতীয় ধাক্কার আঘাতটাও সইতে পারে আমাদের অর্থনীতি।
লেখক : সাংবাদিক।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন