পল্লী কবি জসিমউদদীন রচিত বেদের মেয়ে নাটকের ‘ও বাবু সেলাম বারে বার’ গানটি শোনেননি এমন লোকের সংখ্যা খুব কমই রয়েছে। বাংলাদেশ বেতারের তথ্য অনুসারে ‘বেদের মেয়ে’নাটকটি এ যাবত কালের সর্বাধিক প্রচারিত নাটক। তবে ‘বেদের মেয়ে’নাটক কবি জসীমউদদীন একটি সত্য-বাস্তব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে রচনা করেছিলেন। সে ঘটনা হয়তো অনেকেরই জানা নেই।
আমাদের ছোট বেলায় দেখেছি ‘বেদের মেয়ে’নাটক যে দিন প্রচারিত হতো সে দিন পুরো গ্রামের মানুষ এসে রেডিওর সামনে জড়ো হতো। বেদের মেয়ে নাটকের পাশাপাশি গ্রামের মানুষের কাছে জসীমউদদীন রচিত ‘মধুমালা ও মদন কুমার’নাটকটিও জনপ্রিয় ছিলো। জসীমউদদীনের ‘আসমানী কবিতা’টি পড়েছি ছোট বেলায়। সে সময়ে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া বড় ভাইদের আড্ডার গল্পে শুনতাম আসমানীদের বাড়ি রসুলপুর গ্রামে। সত্যিই আসমানী নামের কেউ আছেন। এর বহু বছর পর সাংবাদিকতায় এসে সত্যিকারের আসমানীকে খুজেঁ বের করেছিলাম। এ নিয়ে আমার লেখা একটি বইও রয়েছে। নাম‘ আসমানীদের গাঁয়ের পথে।’ সেই আসমানীকে খুঁজতে গিয়ে খুজেঁ পেয়েছিলাম বেদের মেয়ে নাটকের কাহিনি।
তখন বৃটিশ যুগ। ফরিদপুরের প্রতাপশালী জমিদার হচ্ছেন ফরিদপুর সদরের ঈশান গোপালপুরের বিশ্বাস পদবীর লোকেরা। পরবর্তীতে বৃটিশ সরকার তাদেরকে চৌধুরী উপাধি প্রদান করে। সে সময়ে ঈশান গোপালপুর বাজারটি ছিল পদ্মার পাড়ে। ওই ঘাটে এসে নোঙ্গর করতো বেদে বহর। মাসের পর মাস ঘাটে নৌকা রেখে বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে ঘুরে এরা সাপের খেলা দেখিয়ে,তাবিজ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতো। সাপের খেলা দেখানোর সময়ে এরা কখনো একক আবার কখনো দ্বৈত কণ্ঠে গান পরিবেশ করে দর্শক-শ্রোতাদের মনোরঞ্জন করে অর্থ-কড়ি রোজগার করতো। এখনো আমাদের দেশে বেদেরা রয়েছেন। এরা যাযাবরের মত জীবন-যাপন করে। তবে এদের বেশীর ভাগের আদি ঠিকানা হচ্ছে মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায়।এরা বর্ষকালে নৌকায় এবং শুস্ক মৌসুমে তাবুতে বসবাস করে।
এমনি একটি বেদে বহর নৌকা নোঙ্গর করেছিলো ঈশান গোপালপুর বাজারের ঘাটে। ওই বাজারের পাশেই জমিদার বাড়ি। জমিদার বাড়ির ডানপিটে যুবক ছিলেন উমেদ আলী বিশ্বাস। উমেদ আলী বিশ্বাস একদিন খবর পান ঘাটে নোঙ্গর করা বেদে বহরের মধ্যে সুন্দরী এক যুবতী আছে,সে খুব সুন্দর গান করে। ঈশান গোপালপুর বাজারে তার গান শোনার জন্য হাজার হাজার লোক জড়ো হয়।
জমিদার পুত্র উমেদ আলী বিশ্বাস এ খবর পাওয়ার পর তার লোকজন পাঠায় বেদে কন্যাকে তার বাড়িতে নেওয়ার জন্য। জমিদার পুত্র গান শুনলে অনেক টাকা রোজগার হতে পারে এমন আশা নিয়ে বেদে কন্যা চম্পাবর্তী এবং তার স্বামী গয়া বাইদা সাপের ঝাপি নিয়ে উমেদ আলী বিশ্বাসের বাড়িতে যান। সাপের খেলা দেখানোর সময়ে চম্পাবতী ও গয়া বাইদা যৌথ কণ্ঠে‘ও বাবু সেলাম বারে বার/আমার নাম চম্পাবতী বাড়ি পদ্মার পার/আমার নাম গয়া বাইদা বাবু বাড়ি পদ্মার পার/ মোরা এক ঘাটেতে রন্দি-বাড়ি আরেক ঘাটে খাই /মোদের ঘরও বাড়ি নাই.....সব দুনিয়া বাড়ি মোদের সকল মানুষ ভাই/ সেই ভায়েদের আজো মোরা খুজিঁয়া বেড়াই...
অপূর্ব সুন্দরী বেদে কন্যা চম্পাবতীর রূপ ও গানে মুগ্ধ হন জমিদার পুত্র উমেদ আলী। গান শোনার পর উমেদ আলী বিশ্বাস তার লাঠিয়াল বাহিনী ডেকে চম্পবতীকে বাড়িতে আটকে রাখেন এবং তার স্বামী গয়া বাইদাকে জোর করে তাড়িয়ে দেন। বেদে বহরের লোকেরা এ নিয়ে প্রতিবাদ করলে উমেদ আলী বিশ্বাস তার লাঠিয়ালদের দিয়ে পুরো বেদে বহরে হামলা চালিয়ে তাদেরকে এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেন। বেদে বহরের লোকেরা চলে গেলে চম্পাবতীকে ফিরে পাওয়ার আসায় গয়া বাইদা এলাকায় থেকে যান। এর মধ্যে উমেদ আলী বিশ্বাস জোর করে চম্পাবতীকে বিয়ে করেন। গয়া বাইদা স্ত্রীকে ফিরে পেতে বিভিন্ন লোকের কাছে ধর্না দেন।
সে সময়ে ফরিদপুরে জমিদারদের বিরুদ্ধে কথা বলার মতো লোক এলাকায় ছিল না। কয়েক মাস ঘোরা-ঘুরির পর ব্যার্থ হয়ে থানায় যান গয়া বাইদা। থানা উমেদ আলীর বিরুদ্ধে মামলা নিতে অপারগতা প্রকাশ করে। শেষ পর্যন্ত আদালতেও কোন মামলা করতে পারেননি গয়া বাইদা। প্রায় ছয় মাসের মতো চম্পাবতীকে ফিরে পেতে চেষ্টা করে এক সময়ে এলাকা ছাড়েন গয়া বাইদা।
বছর দেড়েক পর বেদে কন্যা চম্পাবতীর প্রতি মোহ কেটে যায় জমিদার পুত্র উমেদ আলী বিশ্বাসের। শুরু হয় তার ওপর নির্যাতন। মনোযোগ দিয়ে বেদের মেয়ে নাটক শুনলে শুনতে পাওয়া যাবে ওই পর্যায় এসে চম্পাবতী বলছেন.‘এত কিছু করি তবু উমেদ আলীর মন ভরে না।’ শেষ পর্যন্ত চম্পাবতীকে তাড়িয়ে দেন উমেদ আলী বিশ্বাস। ফরিদপুরের ঈশান গোপালপুরের এখনো যারা বয়স্ক মানুষ রয়েছে তারা তাদের পূর্ব সূরীদের কাছে শুনেছেন,তাড়িয়ে দেওয়ার পর প্রায় বছর খানেক চম্পাবতী একটি কাপড়ের গাট্টি বুকে নিয়ে পাগলের মতো পদ্মার পাড় দিয়ে ঘুরতেন। গয়া বাইদাকে খোঁজ করতেন। তারপর আর দেখা যায়নি তাকে। কেউ কেউ বলেছেন,এক সময়ে পদ্মা নদীতে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন চম্পাবতী।
সে সময়ে কেউ উমেদ আলী বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কথা বলতে না পারলেও কবি জসীমউদদীন প্রতিবাদ হিসেবে ‘বেদের মেয়ে’নাটকটি রচনা করেন। ওই নাটকের মধ্যে তিনি উমেদ আলী বিশ্বাসের নামও উল্লেখ করেছেন। এ নিয়ে উমেদ আলী বিশ্বাসের উত্তর পুরুষদের সঙ্গে অনেকবার কথা বলেছি। তারাও ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন। তবে তাদের বক্তব্য হলো বিদায়ের সময়ে চম্পাবতীকে শূন্য হাতে তাড়িয়ে দেওয়া হয়নি। পারিবারিক সিদ্ধান্তে তাকে বেশ পরিমান অর্থকড়ি দেওয়া হয়েছিল।
লেখক-গণমাধ্যমকর্মী
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন