ভাবমূর্তি নিয়ে পুলিশ বাহিনী খুব সংকটের মধ্যে পড়েছে। ‘ভিতর-বাহির’—উভয় দিক থেকে পুলিশের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে। অন্তত পুলিশের বক্তব্য তা-ই বলে। ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার দায়ে এক পরিচালক ও অভিনেতাকে আটক করা হয়েছে। কেউ যদি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে থাকেন তবে তাঁকে আইনের আওতায় নিয়ে আসাই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু পুলিশ যদি নিয়মিত নিজেরাই ভাবমূর্তি নষ্ট করে, তবে কতজনকে আটক করবে পুলিশ। এমন সব ঘটনার জন্ম দিচ্ছেন পুলিশের সদস্যরা, যাতে মারাত্মকভাবে এই বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। পুলিশ বাহিনীর কেউ খুনের দায়ে আটক হচ্ছেন, মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন অনেকেই। কেউ কেউ আবার ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। ছেলে-ছোকরারা কীভাবে চুল কাটবে, তা-ও ঠিক করে দিচ্ছে পুলিশ। এমনও হচ্ছে, প্রাপ্তবয়স্কদের বিয়েশাদিতে হস্তক্ষেপ করছে পুলিশ।
সম্প্রতি এক পুলিশ কর্মকর্তা এক দম্পতিকে আটক করে আলোচনায় এসেছেন। তিনি পুলিশ সুপার (সিআইডি) মিলু মিয়া বিশ্বাস। একজন চিকিৎসক যে একজন নরসুন্দরকে বিয়ে করতে পারেন, তা মিলু মিয়া বিশ্বাসের বিশ্বাসই হয়নি। এ কারণে তিনি ওই দম্পতিকে আটক করেছেন। চিকিৎসক নারী জানিয়েছেন, তাঁকে কেউ অপহরণ করেননি। তিনি স্বেচ্ছায় ওই নরসুন্দরকে বিয়ে করে ঘর-সংসার করছেন। কিন্তু মিলু মিয়া বিশ্বাসের অভিমত, ওই ভদ্রমহিলাকে তাঁর পরিবার অনেক অর্থ ব্যয় করে চিকিৎসাশাস্ত্রের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শিক্ষিত করেছেন এবং সে কারণে তিনি একজন নরসুন্দরকে বিয়ে করতে পারেন না। তবে মিলু মিয়ার আচরণে পুলিশ বাহিনী বিব্রত।
শুধু মিলু মিয়া বিশ্বাস নন। অনেক কর্মকর্তা ও সদস্যই পুলিশ বাহিনীকে বিব্রত করছেন। কিছুদিন আগে দুই পুলিশ অফিসার হত্যার দায়ে আটক হয়েছেন। অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সিনহা মুহাম্মদ রাশেদকে হত্যার অভিযোগে টেকনাফের ওসি প্রদীপ কুমার এখন জেলে। অভিযোগ রয়েছে তিনি ধরে ধরে নিয়ে বিচারবহির্ভূতভাবে অনেককেই হত্যা করেছেন। এঁদের অনেকেই নাকি মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন। মাদকের কারবারিদের বিচারের জন্য দেশে আইন আছে। কিন্তু ধরে ধরে হত্যা করার কোনো আইন নেই এবং এটা দীর্ঘ মেয়াদে কোনো স্থায়ী সমাধান আনবে না। উপরন্তু, অভিযোগ রয়েছে ওসি প্রদীপ নিজেই মাদক ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।
সিলেটের বন্দরবাজার ফাঁড়ির সহকারী পরিদর্শক আকবর হোসেন ভূঁইয়া চাঁদার দাবিতে রায়হান নামের একজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছেন। আকবর হোসেনও এখন জেলে। এই দুটি ঘটনাই কয়েক মাসের ব্যবধানে সংঘটিত হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহাকে হত্যা করা হয়েছে জুলাই মাসে। আর রায়হানকে ১০ অক্টোবর হত্যা করা হয়। এর মধ্যে তাজা সংবাদ হচ্ছে পুলিশের দুই সদস্য নিজেদের গোয়েন্দা শাখার সদস্য পরিচয় দিয়ে সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের সঙ্গে মিশে বিভিন্ন অপরাধ করেছেন। ডাকাতি ও অপহরণের সময় তাঁরা সরকারি আগ্নেয়াস্ত্র, গাড়ি ও হ্যান্ডকাফ ব্যবহার করতেন। পুলিশ শুধু খুন, ডাকাতি, অপহরণেই জড়িত নয়। গণপিটুনির জন্য উন্মত্ত জনতার হাতে অপরাধীকেও তুলে দিচ্ছে। নোয়াখালীতে আটক ব্যক্তিদের জনতার হাতে তুলে দিয়ে হত্যা করেছিল পুলিশ।
পুলিশ বাহিনী নিয়ে নানা তথ্যই আমরা পাই। একটি পেশায় নানা ধর্ম, বর্ণ ও বিশ্বাসের লোকজন চাকরি করেন। এটাই স্বাভাবিক। সামাজিক বাস্তবতার নিরিখে একটি পেশায় ঘুষখোর থাকবে। সৎ কর্মকর্তা ও কর্মচারী থাকবেন। ধনী পরিবারের সন্তান আছেন। দরিদ্র শ্রেণির লোকজনও চাকরি করবেন। কিন্তু যেকোনো পেশাদার, প্রশিক্ষিত ও স্পর্শকাতর বাহিনীতে সমাজের বিভিন্ন-শ্রেণি ও স্তরের লোকজনকে একটি শ্রেণি ও বর্ণ নিরপেক্ষ অবস্থায় আনতে হয়। কারণ, পুলিশের দক্ষতার ওপরই অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোটা নির্ভর করে। তাই পুলিশ সদস্যদের নানা ধরনের অপরাধে সম্পৃক্ত হওয়ার সংবাদ খুবই উদ্বেগজনক। এসব ঘটনা সেবাদানকারী সংস্থার পরিবর্তে পুলিশের নেতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরে। হতে পারে, এসব ঘটনায় গুটিকয় পুলিশের সদস্য জড়িত। কিন্তু গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান বিবেচনায় নিলে গুটিকয় পুলিশের আচরণ বলে অপরাধের মাত্রাকে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই।
পুলিশ সদস্যদের বিভিন্ন অপরাধে জড়িত হওয়ার বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করে দেখা উচিত। পুলিশের আচরণ অনেকটাই সামরিক শাসনামলের মতো। না হলে পুলিশ কেন ছেলে-ছোকরাদের চুলের ছাঁট নিয়ে কথা বলবে? কে কাকে বিয়ে করবে, সে বিষয়ে পুলিশ কথা বলবে কেন? পুলিশের মনে রাখা উচিত, তারা প্রজাতন্ত্রের বেতনভুক্ত কর্মচারী।
পুলিশের মতো একটি পেশাদার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তার মধ্যে এমন বর্ণবাদী মনোভাব থাকার কথা নয়। পুলিশের প্রশিক্ষণের প্রথম ধাপই হবে দেশের সব নাগরিক সমান এবং সমানভাবে বিচারের সুযোগ পাবে, এই চিন্তা সব পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া।
দম্পতি আটকের ঘটনায় ওই পুলিশ অফিসার সম্পর্কে দুটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। প্রথমত, বুঝে হোক আর না বুঝে হোক পুলিশের ওই কর্মকর্তা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন। তাঁর মধ্যে লুকিয়ে থাকা শ্রেণি চেতনা ও বর্ণবাদকে প্রকাশ করেছেন। পুলিশের মতো একটি পেশাদার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তার মধ্যে এমন বর্ণবাদী মনোভাব থাকার কথা নয়। পুলিশের প্রশিক্ষণের প্রথম ধাপই হবে দেশের সব নাগরিক সমান এবং সমানভাবে বিচারের সুযোগ পাবে, এই চিন্তা সব পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া।
দ্বিতীয়ত, দম্পতিকে আটক করার পেছনে কোন স্বার্থের সম্পর্ক থাকতে পারে। না হলে তিনি একজন প্রাপ্তবয়স্ক অপর একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে বিয়ে করার অপরাধে এমন মন্তব্য করতে পারেন না। ওই ভদ্রমহিলার বাবা অপহরণের মামলা করেছিলেন। আইনে তিনি তাঁদের আটক করতে পারেন। কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তার মন্তব্যগুলো নিতান্তই বর্ণবাদী ছিল। দম্পতি আটকের ঘটনাকে বৈধতা দিতে গিয়ে তিনি বর্ণবাদী আচরণ করে ফেলেছেন।
শেষ কথা হচ্ছে, একটি সিনেমায় পুলিশকে নিয়ে ‘আপত্তিকর’ মন্তব্য করায় সিনেমাটির পরিচালক ও একজন অভিনেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ নিয়ে পুলিশের লোকজন মনোযাতনায় আছেন। এ নিয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক শহীদুল হক বলেছেন, চলচ্চিত্রে পুলিশের অবদানের কথাও উল্লেখ করা উচিত। ব্যস্ততার কারণে উনি হয়তো দেখতে পারেননি দেশে সৎ পুলিশ অফিসারদের উপজীব্য করে অসংখ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। অনেক অভিনেতা সৎ পুলিশ অফিসারের ভূমিকায় অভিনয় করে অনেক অপরাধীকে সমূলে ধ্বংস করেছেন।
কিন্তু এখন প্রদীপ কুমার বা আকবর হোসেনদের মতো খুনে অফিসারদের নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হলে বিব্রত বা মনঃক্ষুণ্ন হওয়ার কিছু নেই। থানায় অভিযোগ বা মামলা করতে গেলে নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়। এটা পুলিশের লোকজনও স্বীকার করবেন। তাই বরং অনুসন্ধান করা উচিত পুলিশে প্রদীপ বা আকবরের ক্ষমতার উৎস কোথায়। জনগণকে রক্ষার শপথ নিয়ে তাঁরা খুন করছেন কেন। ডাকাতির মতো অপরাধে পুলিশ জড়িয়ে যাচ্ছে কীভাবে। পুলিশকে দেখে জনসাধারণ ভয় পায় কেন? পুলিশকে জনগণের বন্ধুর পরিবর্তে শত্রুতে পরিণত করল কারা? এর পেছনের কারণগুলো খুঁজে বের করা জরুরি।
ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন