দেশে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে একের পর এক ঘটনায় বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল। যারা সরাসরি দুর্নীতি-অনিয়ম, প্রতারণা, জালিয়াতির মতো ঘটনার সাথে জড়িত দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, তাদের অনেকেই সরকারদলীয় রাজনৈতিক দলের সাথে কোনও না কোনও ভাবে সম্পৃক্ত। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার সুযোগ কাজে লাগিয়েই তারা লোকচক্ষুর আড়ালে একের পর এক অপকর্ম করছেন। এদের পাপের দায় সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলো কি এড়াতে পারে? বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ উত্তরে বলবেন- ‘না’।
দেশজুড়ে করোনাকালীন মহামারিতেও করোনার রিপোর্ট নিয়ে সাম্প্রতিক জালিয়াতি দেশের মানুষের মাঝে বিরূপতার জন্ম দিয়েছে। মানুষ এখন নমুনা দিতে চাচ্ছে না। মানুষ এখন আস্থার জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না। আর জালিয়াত চক্রগুলোর কারণে দেশে-বিদেশে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশ, ক্ষুণ্ন হয়েছে দেশের ভাবমূর্তি।
সর্বশেষ বেসরকারি রিজেন্ট হাসপাতালে সাড়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি ভুয়া করোনা টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে এখনও তোলপাড় চলছে। ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকজন কর্মচারীকে গ্রেফতার করে হাসপাতালটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিলো। গা ঢাকা দিয়েছিল ঘটনার মূল হোতা সাহেদ। অবশেষে গত ১৫ জুলাই সাতক্ষীরা সীমান্তের দেবহাটা থানার সাকড় বাজারের পাশে অবস্থিত লবঙ্গপতি এলাকা থেকে নৌকায় পালিয়ে থাকা অবস্থায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। তার গ্রেফতারের আগে-পরে তার সাথে সরকারদলীয় একাদিক মন্ত্রী, এমপি, পদস্থ কর্মকর্তা, এবং সাংবাদিক সহ ঘটনার পর যে সকল ছবি প্রকাশ পাচ্ছে তাতে ভিমড়ি খাওয়ার অবস্থা। শুধু তাই নয়, তিনি টেলিভিশন টকশো'র নিয়মিত আলোচক ও বটে।
২০১৩ সালে রিজেন্ট হসপিটালের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হলেও স্বাস্থ্য অধিদফতর অজ্ঞাত কারণে উক্ত হসপিটালটিকে করোনা ডেডিকেটেড হসপিটাল হিসাবে ঘোষণা করে। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর শনিবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশেই তারা উক্ত চুক্তিটি করতে বাধ্য হয়েছিল। শর্ত ছিলো হাসপাতালটি লাইসেন্স নবায়ন করবে, কিন্তু পরবর্তীতে তা করেনি।
সাধারণ মানুষ এত বোকা নয় যে, কোনও রকমের ফেভার ছাড়াই লাইসেন্সবিহীন মেয়াদ উত্তীর্ণ একটি হসপিটালকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় করোনা ডেডিকেটেড হসপিটাল হিসেবে অনুমতি প্রদান করল। মানুষ মনে করে, মন্ত্রণালয়ের কেউ না কেউ বড় ধরনের ফেবার পেয়েছেন। নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে, এমনটিই বিশ্বাস সর্বসাধারণের। প্রতারক সাহেদের সাথে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদের অন্তরঙ্গ বেশ কয়েকটি ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সাহেদের পার্সোনালিটি, এটিচিউড, এক্সপ্রেশন দেখে বিন্দুমাত্র বোঝার উপায় নেই যে সে একজন ইন্টারন্যাশনাল প্রতারক।
বিশেষ করে টিভির টকশোর অনুষ্ঠানগুলোতে সাহেদ নিজেকে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির একজন সদস্য হিসেবে পরিচয় দিতেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ থেকে সুস্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে যে সাহেদের এরকম কোন পদ পদবি নেই।
সম্প্রতি জেকেজি স্বাস্থসেবা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধুরী গ্রেফতার হন। তিনি এবং তার স্বামী আরিফ চৌধুরী সাহেদের প্রতারণাকেও হার মানিয়েছেন। উনারা দু’জন মিলে ১১ হাজার করোনার ভোয়া টেস্ট এবং রিপোর্ট সরবরাহ করেছেন। যদিও টেস্ট বিহীন ভুয়া রিপোর্ট তৈরির জন্য সাবরিনার স্বামী আরিফ চৌধুরী পূর্বেই (গত ২৩ জুন) গ্রেফতার হয়েছিলেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সাথে সাবরিনা চৌধুরীর ঘনিষ্ঠতা থাকায় তাকে গ্রেফতার কিঞ্চিৎ ঘাম ঝরাতে হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে।
কদিন আগেই চাপের মুখে হঠাৎ করেই স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজি স্বপ্রণোদিত হয়ে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। যেহেতু ডা. সাবরিনা একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, সেহেতু সে কোনোভাবেই একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান থাকতে পারেন না। যদিও গ্রেফতার পরবর্তী তিনি তা অস্বীকার করছেন। তার ব্যক্তিগত লাইফস্টাইল এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত ছবিগুলো দেখে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, সে উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে রূপের মহিমা বিলিয়ে অনেক কাজ বাগিয়ে নিতেন।
গত ২০ সেটেম্বর বাংলাদেশে ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি আরেকটি আলোচিত ঘটনা ক্যাসিনো কাণ্ডে এ পর্যন্ত সম্রাট সহ গ্রেফতার হয়েছেন যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, প্রভাবশালী যুবলীগ নেতা জি কে শামীম, কৃষক লীগ নেতা শফিকুল আলম, মোহামেডান ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, গেন্ডারিয়ার আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক এনু, রুপম ভুঁইয়া এবং অনলাইন ক্যাসিনো এর মূল হোতা সেলিম প্রধান। পাশাপাশি আলোচনায় আসে যুবলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরীর নাম। অন্যান্যদের গ্রেফতার করা হলেও ওমর ফারুক চৌধুরীদের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া ছাড়া অন্য কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
ওয়েস্টিন হোটেল কেলেঙ্কারির ঘটনায় যুব মহিলা লীগ নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়াকে ফেব্রয়ারি মাসে গ্রেফতার করা হয়। সকল অপকর্মের ইন্দনদাতা ছিলেন স্থানীয় একজন সাংসদসহ যুবলীগের একাধিক শীর্ষস্থানীয় নেতা। তাকে গ্রেপ্তারের পর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা, মন্ত্রী, এমপিদের সাথে তার ঘনিষ্টতার ছবি প্রকাশ পায়। তাকে আটকের পর যুব মহিলা লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু তার কোনও অপকর্মের খবরই নাকি নেতারা জানতেন না। তাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া নেতাদের গায়ে কোনো আঁচই লাগেনি।
উল্লিখিত ব্যক্তিগণ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙ্গিয়ে হাইব্রিড নেতাদের সহযোগিতায় দাপটের শহীদ চষে বেড়িয়েছেন সর্বত্র। সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার অপপ্রয়াস নিয়ে নানা রকমের অপকর্মে লিপ্ত ছিলেন এহেন ব্যাক্তিরা। এদেরকে যারা আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে স্বীয় লাভের আশায় দলে টেনে নিয়েছিলেন তাদেরকে যথাযথ জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত।
করোনায় বিপর্যস্ত সারা বিশ্ব বিপর্যস্ত আমাদের এই দেশ। করোনাকালীন ভয়াবহতার মাঝে সৃষ্ট সংকট মোকাবেলায় দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার একক নেতৃত্বে দূরদর্শী দিকনির্দেশনা কাজ করে যাচ্ছে সরকারের মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সংস্থা। অথচ জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে দুঃসময়ে কিছু মানুষরূপী নরপিচাশ সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপপ্রয়াস নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে নির্বিঘ্নে। এরা শুধু দলকে নয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে।
সরকার কেবল গুটিকয়েক জেকে শামীম, সাহেদ,সাবরিনা, পাপিয়াকে গ্রেফতার করতে পেরেছে। অথচ এর বাহিরেও রয়ে ঢের। যারা সময়ের সাথে সাথে খোলস পরিবর্তন করে সমাজে দাপটের সাথে চষে বেড়াচ্ছে। এদেশ আপনার, আমার, সকলের। সুতরাং হাইব্রিড দাপটের কাছে মাথা নথ না করে প্রতিবাদী নাগরিক হয়ে উঠুন।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এই বিজয় ছিনিয়ে আনে আমাদের বাঙালি জাতি। সুতরাং বাঙালি বীরের জাতি, হেরে যাবার জাতি নয়। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে আরও একবার প্রতিবাদী হয়ে উঠুন। সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলার যোগ্যতা অর্জন করুন।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। উক্ত নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশভাবে জয় লাভ করেছিলো । নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়কালে ব্যাপক বিচার-বিশ্লেষণ এবং গোয়েন্দা রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে ক্লিন ইমেজ, সৎ এবং অধিকতর তরুণদের মনোনয়ন প্রদান করা হয়েছিলো। মন্ত্রিপরিষদকেও নতুন করে ঢেলে সাজানো হয়েছিলো। সাধারণ মানুষ নতুন নেতৃত্বের দিকে বুকভরা আশা নিয়ে তাকিয়ে ছিলো। মানুষের এক্সপেকটেশন লেভেল অনেকগুণ বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু সরকার কি তা পূরণ করতে পেরেছে আদৌ?
ঢালাওভাবে আমরা সকল নেতৃবৃন্দের কথা বলছি না, বরং গুটিকয় নেতৃবৃন্দের কথা বলতে চাইছি। যারা শাহেদ, পাপিয়া, সাবরিনা, সম্রাটের মতো আরো অনেক অপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে দল ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে।
আরও একটি কথা না বললেই নয়, গত সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নের ক্ষেত্রে সরকার অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে যাদের জনপ্রিয়তা সর্বোচ্চ অবস্থানে ছিল কেবল তাদেরকেই মনোনয়ন দিয়েছিল। অথচ মাত্র দেড় বছরের ব্যবধানে এমন কিছু কিছু সাংসদ আছেন যাদের জনপ্রিয়তা একেবারে শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। তাই সরকার আগামী দিনে দলীয় মনোনয়ন দেয়ার ক্ষেত্রে আরও বেশি সতর্ক, কৌশলী এবং বিচক্ষণ হবে- হয়তো এটাই স্বাভাবিক।
লেখক: সাংবাদিক
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন