চিররঞ্জন সরকার
করোনা আতঙ্কে জর্জরিত পুরো পৃথিবী। তবে এর মাঝে আশার কথা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের সবশেষ ৫ দিনের করোনাভাইরাস আক্রান্তের পরিসংখ্যান (৫ জুলাই পর্যন্ত) তুলে ধরে জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনাভাইরাস ট্র্যাকার বলছে, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমে আসতে শুরু করেছে। যদিও এই সংবাদে আশাবাদী হতে পারে, এমন মানুষ বড় বেশি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ করোনাভাইরাস নিয়ে কারোর কোনো ভবিষ্যদ্বাণীই খাটছে না।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বা সংখ্যাতত্ত্বের অধ্যাপক গবেষকরা আক্রান্তের সংখ্যা, মৃত্যুর হার, ভাইরাসটি বিস্তারের ধরন, মানবদেহে ক্ষতিকর প্রভাব ও বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি পর্যালোচনা করে নানা ভবিষ্যদ্বাণী করে আসছেন। সিঙ্গাপুর ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি অ্যান্ড ডিজাইন (এসইউটিডি)-এর ডাটা ড্রিভেন ইনোভেশন ল্যাবে করা এক গবেষণায় বলা হয়েছিল, ১৫ জুলাইয়ের আগেই বাংলাদেশ থেকে করোনাভাইরাস সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যাবে। আর মে মাসের শেষ দিকে বিদায় নেবে ভাইরাসটির ৯৯ শতাংশ। সেই পরিসংখ্যান গবেষকরা কিন্তু চুপ মেরে গেছেন। কোনো কথা বলছেন না। কারণ কথা বললে বিপদ আছে। ‘ভুল আশাবাদ’ দেখানোর জন্য মানুষ মারমুখি হয়ে উঠতে পারে!
করোনাভাইরাস বিষয়ে পরিসংখ্যানবিদদের ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে যেমন অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছে, করোনাসংক্রান্ত বিভিন্ন পরিসংখ্যান নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে বিতর্ক। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, সুস্থ হওয়া ও মৃত্যুবরণকারী মানুষের যে সংখ্যা বলা হচ্ছে, সেটাও কেউ বিশ্বাস করছে না। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা নিয়ে দেশে দেশে চলছে অবিশ্বাস। ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ান সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলেছে, ব্রিটেনে আক্রান্ত ও মৃতদের সংখ্যা সম্পর্কে সরকারিভাবে যা বলা হচ্ছে তা সঠিক নয়। এই সংখ্যা বহুগুণ বেশি। একই অভিযোগ আমেরিকায় আক্রান্ত ও মৃতদের সংখ্যা সম্পর্কে উঠেছে। আমেরিকার রোগ নিয়ন্ত্রণ ও নিরাময় কেন্দ্র সিডিসির ডিরেক্টর ড. রবার্ট রেডফিল্ড বলেছেন, আমরা এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাস সংক্রমণের যে চিত্র দেখেছি, প্রকৃতপক্ষে তারচেয়ে ১০ গুণ মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। আমেরিকায় প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা ২ কোটির ওপরে।
বাংলাদেশেও এই সংখ্যা অনেক কম দেখানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। টেস্ট এবং শনাক্তের ভিত্তিতে মোট আক্রান্ত, এদের মধ্যে সেরে উঠা, মৃত্যুবরণকারী মানুষের সংখ্যা নিয়ে অনেক দেশের বিরুদ্ধেই অভিযোগ আছে। চীন, রাশিয়া, জার্মানির বিরুদ্ধেও আক্রান্ত ও মৃতের তথ্য গোপন করা বা কম করে দেখানোর অভিযোগ আছে। করোনাবিষয়ক তথ্য-উপাত্ত-পরিসংখ্যান নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক অবিশ্বাস ও সন্দেহ।
অবশ্য এটা শুধু করোনাসংক্রান্ত পরিসংখ্যান নয়, যে যেকোনো পরিসংখ্যান নিয়েই আছে বিভ্রান্তি, সন্দেহ। পরিসংখ্যানকে অনেক রসিকজনই মিথ্যের সঙ্গে তুলনা করেন। মিথ্যে কয় প্রকার? ইংরেজ স্টেটসম্যান ও লেখক বেঞ্জামিন ডিসরেইলি (Benjamin Disraeli) মিথ্যেকে ভাগ করেছেন তিনভাগে: মিথ্যে, ডাহা মিথ্যে ও পরিসংখ্যান।
পরিসংখ্যান জিনিসটা আসলে খুবই গোলমেলে। এর দ্বারা অনেক সময় মিথ্যেকে সত্যে রুপান্তরিত করা যায়। আবার কঠিন সত্যও মিথ্যে হয়ে যায়। যেমন ধরা যাক, একজন লোকের মাসিক বেতন ৫ লাখ টাকা, আর এক জনের ২০ হাজার টাকা; পরিসংখ্যান মতে, দুজনের গড় বেতন লাখ টাকার ওপরে। গড় বা অ্যাভারেজকে পরিসংখ্যানে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হলেও এ থেকে আসল ঘটনা বোঝা কষ্টকর: যদি একজন লোকের মাথা হিমশীতল বরফে এবং পা গনগনে আগুনে রাখা হয়, তবে তার অ্যাভারেজ বডি টেম্পারেচার হবে নরমাল।
আমার এক বন্ধু পরিসংখ্যানের বুজরুকি সম্পর্কে বোঝাতে গিয়ে বলেছেন, মনে করুন এক ভদ্রলোক একটি আস্ত মুরগী একা খেয়েছেন, তার বাড়ির পাশেই আর এক ভদ্রলোক অভাবের কারণে কিছু না খেয়ে অনাহারে মারা গেছেন। এখন অর্থনীতির পরিসংখ্যান অনুযায়ী পাশের বাড়ির লোকটি গরিব নন, কারণ হিসেবে উনি অর্ধেক মুরগী খেয়েই মারা গেছেন। গড় হিসেব তাই বলে!
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যশাস্ত্রের শিক্ষক অ্যারন লেভেনস্টাইন পরিসংখ্যানকে তুলনা করেছিলেন বিকিনির সঙ্গে৷ যা প্রকাশ পায় সেটি ইঙ্গিতময়, যা আচ্ছাদিত সেটিই গুরুত্বপূর্ণ৷ বলা অসঙ্গত হবে না, পরিসংখ্যান ও বাস্তবের এই নিরন্তর ফারাকটি আমাদের দেশের প্রশাসনিক কাঠামোর মজ্জাগত অসুখ৷ যে দলই ক্ষমতাসীন হোক, পরিসংখ্যান যখন উন্নয়নের একমাত্র মাপকাঠি, তখন দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীরাও যেনতেন প্রকারে উজ্জ্বল চিত্রাঙ্কনেই উৎসাহী৷ ফলে সরকারি নথিপত্রে দেখা যায় বহু বিদ্যালয় তৈরি হয়েছে, কিন্তু এটি অনুক্তই থাকে যে সেই বিদ্যালয়গুলিতে যথোচিত সংখ্যায় শিক্ষক নেই৷ বলা হয় যে গ্রামে গ্রামে প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে উঠেছে, কিন্তু সেগুলিতে ওষুধপত্র ও চিকিৎসাকর্মীর সরবরাহ আছে কি না সেই জরুরি তথ্যটি উহ্যই থাকে৷ পুলিশ থানা উদ্বোধনের খবর প্রকাশিত হয় সংবাদমাধ্যমে, কিন্তু অতঃপর সেখানে যথেষ্ট পুলিশ মোতায়েন হয় কি না, সেই খবর রাখে শুধু ভুক্তভোগীরা৷ প্রচার করা হয় যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়ুয়ার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু তারা আদৌ কর্মসংস্থানের যোগ্য হয়ে উঠতে পারছে কি না, সেটি অজ্ঞাত থাকে৷ উন্নয়ন অবশ্যকাম্য, কিন্তু যখন সেটি কেবলই পরিসংখ্যানে সীমাবদ্ধ, বাস্তব তার বিপরীত, আদতে সেটি তখন অর্ধসত্য৷
পরিসংখ্যান, অন্তত আমাদের দেশে, সব সময় সঠিক চিত্র তুলে ধরে না এ-কথা সত্য। কিন্তু তাই বলে ‘পরিসংখ্যান’ শব্দটিকে মিথ্যের সমার্থক মনে করা বোধকরি ঠিক ন্যায়সঙ্গত হবে না। তবে, এ-নিয়ে অযথা বিতর্কে লিপ্ত হতে চাই না। তারচে বরং অন্য আরেক ধরনের মিথ্যের কথা বলি। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ‘সাদা মিথ্যে’ বা ‘নির্দোষ মিথ্যে’-র সঙ্গে। ইংরেজিতে একে বলে White Lie। ‘এলাম আমি কোথা থেকে?’-ধরনের প্রশ্নের জবাবে আমাদের দেশের মায়েরা বাচ্চাদের যা বলে থাকেন, তাকে হোয়াইট লাই বা সাদা মিথ্যে বলা যেতে পারে। অনেকে অবশ্য বলেন যে, মিথ্যে মিথ্যে-ই। একে ভিন্ন ভিন্ন নাম দেয়ার কোনো অর্থ হয় না। বরং মিথ্যেকে ‘ছোটো’, ‘বড়’, বা ‘সাদা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে, প্রকারান্তরে, মিথ্যে বলাকে উৎসাহিত করা হয়ে থাকে। সুতরাং, তাদের মতে, মিথ্যে ‘মিথ্যে’ হিসেবেই সর্বক্ষেত্রে এবং সর্বাবস্থায় পরিত্যাজ্য।
মিথ্যে বলার সঙ্গে যখন বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্নটি জড়িত, তখন এ-ব্যাপারে সবচে বেশি সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত রাজনীতিবিদদের। মনে রাখতে হবে, তারা জনপ্রতিনিধি, জনগণের ভোটে নির্বাচিত (তা সে সত্য ভোটেই হোক আর মিথ্যে ভোটেই হোক)। সেই জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সরকার যখন মিথ্যেচারে লিপ্ত হয়, তখন তা ডাবল অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবার যোগ্য। মনে রাখা দরকার যে, সত্য সব সময় সুন্দর বা প্রিয় হয় না। আমাদের মতো দরিদ্র ভূখণ্ডে ‘দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে’-ধরনের ‘ডাহা মিথ্যে’ বলার চেয়ে, দেশের প্রকৃত চেহারাটি দেশবাসীর সামনে তুলে ধরে, সে ‘চেহারাটি’ কীভাবে আরো সুন্দর করা যায় তার বিশ্বাসযোগ্য ও বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনা পেশ করলেই বরং দেশবাসী বেশি খুশি হবে।
আর যেকোনো বিষয়ে শুধু সংখ্যাতত্ত্বের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিলে ভুল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অন্য দেশের অভিজ্ঞতা আমাদের সঙ্গে নাও মিলতে পারে। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে যা আরও বেশি সত্যি হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ বাংলাদেশে এই ভাইরাসের চরিত্র অন্য রকম। ফলে সংক্রমণের হার এবং মৃত্যুর হারও আলাদা। তা ছাড়া এই দেশের মানুষের স্বভাব, চরিত্র, বেড়ে ওঠা, দূষণ ও ভেজালের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অভিজ্ঞতা, জীবনযাত্রা পৃথিবীর অন্য সব দেশের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। কাজেই এখানে অন্য সব দেশের সংখ্যাতত্ত্বের হিসেব চিকিৎসাবিজ্ঞানে ভ্রান্ত হিসেবে বিবেচিত হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রথম কথা হলো, এই পেশাতে ২+২=৪ হয় না সবসময়। ২৫ জন রোগীর যদি একই ভাইরাস সংক্রমিত হয় সেক্ষত্রে কখনোই বলা যায় না যে ২৫ জনেরই একই রকম উপসর্গ এবং জটিলতা দেখা যাবে। প্রত্যেকের শারীরিক গঠন এবং সেই সময়ে শারীরিক অবস্থার ওপর নির্ভর করবে রোগের ব্যাপ্তি। সংখ্যাতত্ত্বের পণ্ডিতরা সেসব মাথায় রাখেন না!
পরিশেষে পরিসংখ্যান নিয়ে একটা পুরোনো কৌতুক।
এক বন্ধু অপর বন্ধুকে বলছে, পরিসংখ্যান জিনিসটা আছে বলে আমরা কুমিরের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছি। দ্বিতীয় বন্ধু বলে, সেটা কীভাবে? এবার প্রথম বন্ধু বলে: পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পৃথিবীতে প্রতিবছর কুমিররা চার কোটি ২০ লাখ ডিম পাড়ে। এগুলোর মধ্যে কেবল দুই ভাগের এক ভাগ ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। এসব বাচ্চার চার ভাগের তিন ভাগই আবার জন্মের প্রথম ৩৬ দিনে শিকারি প্রাণীর হাতে মারা পড়ে। বাকিগুলোর মধ্যে শতকরা পাঁচ ভাগ কেবল এক বছর বেঁচে থাকে। এবার নিশ্চয়ই স্বীকার করবে, পরিসংখ্যান কতই না বিস্ময়কর!
দ্বিতীয় বন্ধু: এখানে বিস্ময়ের কী আছে?
দূর, তুমি এখনো ব্যাপারটা ধরতে পারোনি। পরিসংখ্যান না থাকলে বুঝতে, কী হতো। তোমার পশ্চাদ্দেশটা এখন কুমিরের ওপরই রাখতে হতো!
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন