করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে ঘরবাড়ি ও আঙিনাকে জীবাণুমুক্ত রাখতে হঠাৎ করেই এসময়ে ব্লিচিং পাউডারের গুরুত্ব অনেকটা বেড়ে গেছে। কিন্তু কখনো কখনো ব্লিচিং পাউডার এবং এই পাউডার মেশানো পানির ব্যবহার নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি একদিকে যেমন মানবদেহের জন্য বড় ক্ষতিকর বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা, অন্যদিকে এর মনোসামাজিক প্রভাব নিয়ে ভাবনারও যথেষ্ট প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়।
সম্প্রতি করোনাভাইরাসের সাথে লড়াই করে সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছেন আমার বড় ভাইয়ের পরিবারের সকল সদস্যরা। তারা সরকারি যে কোয়ার্টারে বসবাস করেন, সেখানে অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরই বসবাস। তাদের অসুস্থতাকালীন সময়ে আমরা তার পরিবারের সদস্যরা পালাক্রমে তাদের জন্য খাদ্য সরবরাহ করতে ওই কোয়ার্টারে যেতাম। এ সময়ে কিছু বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন আমাদেরকে হতে হয়েছে। সম্ভবত তাদের আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে এই কোয়ার্টারে বসবাসরত সবার ভেতর মারাত্মক সংকোচ ও ভীতি কাজ করেছে। যে কারণে বাসা সংলগ্ন নিয়মিত প্রবেশ ও বাহির হওয়ার গেট বন্ধ করে দেয়া হয়। আগে যে গেটগুলো বন্ধ থাকতে দেখেছি সেগুলো নিরাপত্তাকর্মীদের কড়া নজরদারিতে খোলার ব্যবস্থা করা হয়।
যখনই পিইপি পরিহিত অবস্থায় হাতে খাবারের আইটেম নিয়ে কোয়ার্টারে ঢুকতে গিয়েছি, নিরাপত্তাকর্মীদের আচরণ ছিলো ক্ষমার অযোগ্য। ওরা বুঝেই জিজ্ঞাসা করতো কোথায় যেতে চাই। তখন বিরক্ত সহকারে রিকশাচালকসহ আমার শরীরে ব্লিচিং মিশ্রিত জীবানুনাশক দিয়ে স্প্রে করে।
আমি অবাক হই এবং জিজ্ঞাসা করি অনুমতি না নিয়ে আমাকে স্প্রে করলে কেনো? তাদেরকেও এটাও মনে করে দিই আমার হাতের খাবারগুলো রোগীদের জন্য। এভাবে স্প্রে করলে খাবারগুলোওতো বিষাক্ত হয়ে যাবে! কিন্তু ভদ্রলোকদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় তা হয়তো এদেরকে শেখানো হয়নি। বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে তারা জানায় এই কোয়ার্টারের বড় স্যারদের হুকুম কেবল তারা তামিল করছে!
উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এই ভবনে না ঢুকলে বোঝা যাবেনা আমার ভাইয়ের বাসার সামনের হাল হকিকত এ সময় কি ছিলো! তাদের বাসার সামনে টবে রাখা গাছ আর পাপোশগুলো দিয়ে বাসাটিকে পৃথক করে রাখা হয়েছে। সেখানে ব্লিচিং পাউডার মিশ্রিত পানি ঢেলে পরিস্কারের নামে জলাবদ্ধতা তৈরি করা হয়েছে। চারপাশ জুড়ে স্তুপাকারে ব্লিচিং পাউডার দিয়ে একটি প্রাচীর তৈরি করা হয়েছে। বিষাক্ত ক্লোরিন মিশ্রিত একটি বালতি সারাক্ষণই সেখানে রাখা আছে। কোন একটি শুকনো ও পরিচ্ছন্ন স্থানে খাদ্য সামগ্রী রাখার কোন অবস্থা নেই। তীব্র বিষাক্ত গন্ধে যেখানে কয়েক মিনিট দাড়িয়ে থাকা ভয়ংকর কষ্টদায়ক।
একজন সহকর্মী যখন সপরিবারে করোনার সাথে লড়ছে, তখন উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চপদস্থ প্রতিবেশী কর্মকর্তারা মানসিক সহযোগিতাতো দূরের কথা এমন সনাতনী নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী যদি পোষণ করে থাকেন, তাহলে আর কিইবা বলার থাকে। শেষদিকে যেদিন ওই বাসায় যাই, সেদিনও দেখি ওই একই অবস্থা এবং দীর্ঘদিন ধরে সযত্নে পরিচর্যা করা বেশীরভাগ গাছগুলোই মরে গেছে!
অথচ, গত ১৬ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে দেশের সকল সিভিল সার্জনদের কাছে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে জীবাণুমুক্ত করার জন্য ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার না করতে বলা হয়েছে। ওই বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশনা অনুযায়ী, জীবাণুনাশ করার এ পদ্ধতিটি একেবারেই সঠিক নয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া ওই নির্দেশনায় জীবাণুনাশক তৈরির পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে - কোনও পদার্থ, শরীর নিঃসৃত বর্জ্য ইত্যাদি পরিষ্কার ও জীবাণুনাশ করতে স্ট্রং ক্লোরিন ০.৫% প্রয়োজন এবং প্রতিদিন নতুন করে এই দ্রবণটি তৈরি করা এবং আগের দিনের অবশিষ্ট ক্লোরিন ফেলে দেয়া অবশ্যই উচিত। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ চোধুরী একটি সাক্ষাতকারে বলেছেন, ব্লিচিং পাউডার মানবদেহের বাহ্যিক অংশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতির কারণ হতে পারে। বিশেষ করে যেসব মানুষের অ্যালার্জি জনিত সমস্যা রয়েছে। আমার বড় ভাইয়েরও অ্যালার্জি আছে, আমার নিজেরও আছে।
চিকিৎসকের দেয়া পরামর্শ মেনে ঔষধ খাওয়া, শুরু থেকেই প্রচলিত বিভিন্ন টোটকা কঠোরভাবে মেনে চলা, শরীরচর্চা করা সর্বোপরি পরিবারের সবার মানসিক সহযোগিতা ও তাদের দৃঢ় মনোবল দিয়ে তারা করোনা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। এজন্য আমরা মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করি। কিন্তু আমাদের চারপাশে যে মনোসামাজিক পরিবেশ, সেখানে এই রহস্যময় ভাইরাসের বিরুদ্ধে আক্রান্ত ব্যক্তি বা পরিবারের যুদ্ধ করে জয়ী হওয়াটা মোটেও সহজ ব্যাপার নয়!
লেখক: মনজুর রশীদ, সমাজ বিশ্লেষক, উন্নয়ন গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী।
পূর্বপশ্চিমবিডি
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন