নাদিম মাহমুদ
বছরখানেক আগে যখন দেশে ডেঙ্গুতে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটল, দিগ্বিদিক ছোটাছুটির পরও আমরা যখন প্রাণ সংহার কমাতে ব্যর্থ হয়েছিলাম, সেই সময় ভেবেছিলাম, এইবার অন্তত সরকার দেশের গবেষণায় মনোনিবেশ করবে। গবেষণায় বরাদ্দ বাড়বে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ নিয়ে হবে বিশদ গবেষণা। কিন্তু বছর ঘুরে আসার পরও আমরা সেই আশার আলো দেখতে পাইনি। বরং এই শঙ্কার মধ্যে যোগ হয়েছে নভেল করোনাভাইরাস নামের প্রাণঘাতী ভাইরাসের। বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রাণহানির পরিপ্রেক্ষিত্রে প্যানডেমিক বা মহামারির অক্ষে থাকা এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে। লাশের মিছিল প্রতিদিনই দীর্ঘতর হচ্ছে। বাংলাদেশে কয়েকজনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নয়া ভীতির সঞ্চার হয়েছে জনমনে।
কভিড-১৯ মোকাবিলা করতে বিশ্বের প্রায় সব গবেষক একযোগে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রয়োজনে ডেটা শেয়ার করছেন। জার্নালগুলো পিয়ার-রিভিউ করার আগে প্রি-প্রিন্ট ভার্সন অনলাইনে আনছেন, যাতে গবেষকদের তথ্য-ডেটা অন্য বিজ্ঞানীরা সহজে ব্যবহার করতে বা জানতে পারেন। বিজ্ঞানের এই উদারতা বরাবরই ছিল। তবে কভিড-১৯কে শিল্ড করতে বেশ কিছু গবেষণাগার রাত-দিন পরিশ্রম করে যাচ্ছে। এর মধ্যে সাফল্যের খবরও কম নয়। কয়েকটি দেশ স্থানীয়ভাবে নভেল-করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ প্রযুক্তিও বের করছে। কেউ কেউ আবার ভ্যাকসিন বা টিকা তৈরিতে এগিয়ে যাচ্ছে। গত কয়েক মাসে করোনাভাইরাস নিয়ে অন্তত তিন শতাধিক জার্নাল প্রকাশিত হয়েছে। শুধু এগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। রোগ প্রতিরোধে স্থানীয় কিংবা আন্তর্জাতিক নীতিমালা তৈরির কাজও গবেষকরা করে যাচ্ছেন। রোগ শনাক্ত থেকে শুরু করে জনসাধারণের জন্য যেসব সর্তকতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায় তার মানচিত্র তারা করে যাচ্ছেন।
বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো কভিড-১৯ কে বাধা দিতে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, তখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা আইসোপপানলের সঙ্গে গ্লিসারিনের মিশ্রণে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করে মোকাবিলায় নামছেন। বিষয়টি হাস্যকর হলেও সত্য। অর্ধশত বছর আগে লুপ হার্নাদেজের ফর্মুলার এই স্যানিটাইজারের সাফল্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রশান্তির হাওয়া দেখলাম। তাতে তারা যদি করোনাভাইরাসের কিট কিংবা ওষুধ আবিস্কার করতেন, তাহলে সে আনন্দ যে কোন পর্যায়ে যেত, তা অনুমেয়।
আবার ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার বনে গেছে কেউ কেউ। ব্যবহারিক প্রয়োগ না দেখিয়ে ১৬/১৭ বছর আগে সার্স ভাইরাস শনাক্তকরণ পদ্ধতির মাধ্যমে কভিড-১৯ ভাইরাস শনাক্তকরণের তত্ত্ব দিয়ে শিরোনাম হচ্ছে। বায়োলজিক্যাল কিংবা কোষের মরফোলজিক্যাল বা শারীরবৃত্তিক স্টাডি না করে কিংবা শনাক্তকরণ কিটের ক্রিয়াশীলতা কেমন হবে, যাচাই না করেই সারাদেশে প্রচারণায় গেল এক দল।
গবেষকদের গবেষণার উদ্দেশ্য থাকে না পত্রিকার শিরোনাম হওয়া। বরং নিজেদের পরিশ্রমের ফসল ঘরে তোলার স্বীকৃতি পাওয়াটাই হলো আসল। কিন্তু আমাদের দেশে গবেষক কিংবা শিক্ষকদের মধ্যে এক ধরনের প্রবণতা চলে এসেছে- হাঁড়ি-পাতিলে রান্না তুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই রান্নার সুগন্ধি গণমাধ্যমে জানানো। গবেষণার ফল জার্নালে প্রকাশের আগে সংবাদপত্রে প্রকাশেই যেন তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে ফেলেন।
আপনি যত বড় গবেষকই হোন; কিংবা জগদ্বিখ্যাত আবিস্কার করে ফেলেন, আপনার গবেষণা কোনো স্বীকৃত আন্তর্জাতিক জার্নাল বা সাময়িকীতে প্রকাশ না পেলে আপনার গবেষণাকে নিজের বলে দাবি করার রেওয়াজ বিজ্ঞানী মহলে নেই। আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন, বেতার বা রেডিও আবিস্কারক হিসেবে গুইয়েলমো মার্কনিকে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও এই জিনিসটি আবিস্কারের কৃতিত্ব কিন্তু আমাদের জগদীশচন্দ্র বসুরও ছিল। কিন্তু বসুর গবেষণা নিবন্ধটি প্রকাশনা বিলম্বিত হওয়ায় তাকে কিন্তু সায়েন্টিফিক কমিউনিটিতে কোনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
এমন ঘটনা অহরহ রয়েছে, যে আমাদের গবেষণার যেন উদ্দেশ্য শুধুই সংবাদপত্রে নিজের নাম দেখা। এ কথা ঠিক, আমাদের অনেক ভালো ভালো গবেষণার আইডিয়া রয়েছে। এসব আইডিয়ার প্রায়োগিক দিকগুলো বিবেচনা করতে হবে। প্রতিযোগিতা সব জায়গায় আছে, থাকবে। তবে মৌলিক বিষয়গুলো আমাদের মনে-প্রাণে ধারণ করতে হবে। আপনি দেখছেন, আপনি নতুন কিছু আবিস্কার করতে চলেছেন, ঠিক তখনি আপনি পেটেন্টের জন্য আবেদন করুন। পেটেন্ট করতে তো আহা মরি ডেটা দিতে হয় না। বরং আপনার ইন্টেলেকচুয়াল সম্পদ নিরাপদ রাখতে পত্রিকায় জানানোর আগে পেটেন্ট পাওয়া জরুরি।
এসব সস্তা জনপ্রিয়তার কথা বাদ দিয়ে এবার আসি কভিড-১৯ প্রসঙ্গে। আমরা ধরেই নিয়েছি, আমরা আক্রান্ত হবো না। কিন্তু আক্রান্ত হলে যে পরিস্থিতি দাঁড়াবে, তা সামাল দেওয়ার মতো যথেষ্ট শক্তি ও অবকাঠামো যে আমাদের নেই। বছরের পর বছর আমরা অনেকটা অবহেলা করেই চিকিৎসা ক্ষেত্রটা বাগে আনতে পারিনি। প্রতি বছর এ দেশের রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে অর্থশালীরা দেশের বাইরে চিকিৎসা করাতে যান। দেশের অর্থে বড় একটা অংশ চলে যাচ্ছে বিদেশি হাসপাতালে। যে অর্থ আমাদের যাচ্ছে, তা দিয়ে এই দেশে যেমন মানসম্মত হাসপাতাল করা যেত, তেমনি চিকিৎসা গবেষণায়ও ব্যবহার করা যেত। এমনকি আমরা আন্তর্জাতিক মানের রিসার্স ইনস্টিটিউট করতে পারতাম।
আবার যেসব গবেষণা প্রতিষ্ঠান দেশেই রয়েছে, সেগুলোতে লুকুইড বা অর্থ বরাদ্দের অপ্রতুলতায় সেগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। দক্ষ গবেষক কিংবা মানসিক বিকাশের অভাবে আমরা দিন দিন গবেষণাবিমুখ হয়ে পড়ছি। বিষয়টি এমন যে, আপনি কোনো ওষুধ আবিস্কার করবেন; সঙ্গে সঙ্গে সেটা প্রোডাকশনে যাবে। আসলে সেটি নয়। কোনো কিছু আবিস্কার হলে, সেটা যে কয়েক বছরে কয়েক ধাপের প্রয়োজন, তা আমাদের সরকারের কর্তাব্যক্তিরা মানতে চান না।
তবে কৃষি গবেষণার ফল তাৎক্ষণিক হওয়ায় সরকার এই ক্ষেত্রের প্রতি সদয়। বায়োলজিক্যাল কিংবা ভৌতবিজ্ঞান গবেষণার ফল কখনোই মাস বা বছর ঘুরে পাওয়া যায় না। সেটা আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে। যে কোনো মৌলিক গবেষণায় যে অর্থ প্রয়োজন, সেটা দিতে আমাদের সরকার সব সময় কার্পণ্য দেখায়। যাদের হাতে গবেষণার বরাদ্দ দেওয়ার দায়িত্ব থাকে, তারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞান না রাখার ফলে গবেষণা প্রকল্পের যথার্থ মূল্যায়ন করতে পারে না।
আজ যে কভিড-১৯ এ আমাদের দেশ তথা বিশ্ব আক্রান্ত, সেই ভাইরাসটি শনাক্তকরণে যে যন্ত্রপাতি প্রয়োজন সেটি বলতে গেলে ২/১টি প্রতিষ্ঠানে রয়েছে। রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেজ পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (আরটিপিসিআর) যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণাগারে থাকার কথা, সেটি দেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। আবার দেশের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রোবায়োলজি বা অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ থাকলেও সে বিভাগের গবেষণা কিংবা ভাইরাস নিয়ে স্টাডি করার যে বায়োসেফটি ল্যাব লেবেল-৩ প্রয়োজন, সেটিও নেই। আর চিকিৎসাবিদ্যার কথা তো বাদ দিলাম। পৃথিবীর খুব কম দেশই রয়েছে, যে দেশে চিকিৎসকরা গবেষণা করার কোনো সুযোগ পান না। শুধু পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞানে ওষুধের জেনেরিক চিকিৎসার প্রসার কখনোই সম্ভব নয়।
দেশে গবেষণার বরাদ্দ দিতে চায় না সরকার। ডেঙ্গু কিংবা কভিড-১৯ এলে মনে হয়, গবেষকদের বেশ প্রয়োজন। বিষেজ্ঞদের মতামত যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা সরকার এই সময়ে খুব কাছ থেকে অনুভব করে। সিভিল সোসাইটির ওপর নির্ভরা আমাদের হতাশাকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
আজ দেশে অনেক দক্ষ অধ্যাপক কিংবা গবেষক শুধু গবেষণার রসদ জোগাতে না পেরে গবেষণাবিমুখ হয়ে পড়েছেন। দেশের ভেতর কিংবা বাইরে থেকে যে মেধা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, সেটি দিনে দিনে ভোঁতা হয়ে গেছে। এটাকে শানিত করার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। এই মানবিক বিপর্যয়গুলো রোখার জন্য বিজ্ঞানকে পুঁজি করতে হবে। আমরা যখন স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে চাই, তখন গবেষণার দায়-দায়িত্বও নিতে হবে। জলবায়ুর পরিবর্তন কিংবা মানবিক বিপর্যয় থেকে ডেঙ্গু-কভিডরা বছর ঘুরে আসবে। এটাকে অস্বাভাবিক ভাবার কিছু নেই। তবে সেটাকে মোকাবিলা করতে যে চর্চাকেন্দ্র চালু রাখা দরকার, তা আমাদের বুঝতে হবে। মনে রাখতে হবে, ঝাড়-ফুঁক দিয়ে রোগ ভালো করার দিন আমাদের আর নেই। রোগ যত কঠিন হচ্ছে, বিজ্ঞানের গবেষণা আমাদের তত বেশি করা উচিত। গবেষণা যে শুধু পথ দেখাবে, তা নয়; আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তির সোপান হিসেবে দাঁড়াবে। আমরা চাই, সরকার এসব বিপর্যয় থেকে এইটুকু শিক্ষা নিয়ে আগামীতে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার ক্ষেত্র তৈরি করে দেবে।
জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিতে অধ্যয়নরত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন