দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসলীলার পর ইউরোপ যখন ক্ষণিক শান্তির খোঁজে নেমেছিল, তখন উইনস্টন চার্চিলের একটি মন্তব্য সুরক্ষিত ভবিষ্যতের পথ দেখাতে কিছুটা সক্ষম হয়। ইউরোপের যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার অন্যতম নায়ক চার্চিল বলে বসেন, ‘আসুন গড়ে তুলি এক সংযুক্ত ইউরোপ।’ জানি না ইউরোপের যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার প্রশ্রয়দাতা চার্চিলের এই মন্তব্য প্রচ্ছন্ন পরিতাপের কিনা।
তবে ২৫ মার্চ ১৯৫৭ সাল ট্রিটি অব রোম স্বাক্ষর করে সংযুক্ত ইউরোপের যাত্রা শুরু হয়েছিল। পরিণতিতে বেলজিয়াম, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, ইতালি, লুক্সেমবার্গ এবং নেদারল্যান্ডস ঠিক করে তারা অর্থনৈতিক কাজকর্মে একে অপরকে সাহায্য করবে। অবশ্য এর আগেই ১৯৫১ সালে প্যারিস ট্রিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। যার ফলে এই মিত্রশক্তি কয়লা ও ইস্পাত শিল্পের ব্যাপারে পরস্পরকে সহযোগিতার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্য যে, গত ৩১ জানুয়ারি নবাবিয়ানা দেখাতে গিয়ে যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করেছে। যুক্তরাজ্যের এই সিদ্ধান্ত সুখকর হবে বলে মনে হয় না। কারণ স্কটল্যান্ড বহুদিন থেকে বলে আসছে যে, ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করলে তারা যুক্তরাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন হয়ে যাবে। এখন স্কটল্যান্ডে জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতায়; তারা এরই মধ্যে স্বাধীনতা সম্পর্কে আরেকবার গণভোট আয়োজন করার দাবি তুলেছে।
ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড আর উত্তর আয়ারল্যান্ড নিয়ে সংযুক্ত যুক্তরাজ্য গঠিত হয়েছিল। যুক্তরাজ্য গঠনের সময় আয়ারল্যান্ডের অন্তর্ভুক্তি আইরিশরা মানেনি। তাই তারা ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৭০০ বছর ধরে যুদ্ধ করেছে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিদ্রোহ করে স্বাধীন হয়েছে। তারা ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে এইসব বিদ্রোহে এত জনশক্তি হারিয়েছিল যে, এখনও আইরিশ প্রজাতন্ত্রে নারীর চেয়ে পুরুষ কম। ১৮৮৬ সালে উইলিয়াম ইওয়ার্ট গ্ল্যাডস্টোন যখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হন তখন তিনি ‘হোম রুল’ নামে এক আইন পাস করে আয়ারল্যান্ডকে শান্ত করতে চেয়েছিলেন কিন্তু কমন্স সভা সেই আইন পাস না করায় তার উদ্যোগ ব্যর্থ হয় এবং তার পতন হয়।
১৮৯২ সালে গ্ল্যাডস্টোন পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হন। তখন তিনি আয়ারল্যান্ডের জন্য হোম রুল আইন পাস করাতে সক্ষম হন। হোম রুল মানে তাদের স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচন ও কিছু ক্ষমতা প্রদান। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ও ভারতীয় নেতারা মাঝেমধ্যে হোম রুলের কথা বলতেন। সম্ভবত ১৯১৯ সালের আর ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। এই ব্যবস্থা দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানোর মতো।
ইউরোপের উপনিবেশিক শক্তিগুলোর মধ্যে ব্রিটিশ ছিল খুবই দূরদর্শী এবং তারা বুঝেছিল আয়ারল্যান্ডকে শেষ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে রাখা যাবে না, আখেরে তাদের স্বাধীনতা দিতে হবে। ইংরেজরা বংশে অ্যাংলো স্যাক্সন আর আইরিশরা কেল্ট। ধর্মবিশ্বাসে ইংরেজরা প্রোটেস্ট্যান্ট আর আইরিশরা নিষ্ঠাবান ক্যাথলিক। সুতরাং এত ভিন্নতার মধ্যে একসঙ্গে থাকার অর্থই হলো জনমের মতো অশান্তি অব্যাহত রাখা। সর্বোপরি আইরিশরাও পিছিয়ে থাকা জাতি নয়। বর্বর ভ্যান্ডল এবং হুনের আক্রমণে ষষ্ঠ শতাব্দীতে যখন রোমের পতন হয় তখন ইউরোপের সংস্কৃতি ও সভ্যতার শিখা জ্বালিয়ে রেখেছিল আইরিশরাই।
এসব কথা চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা দিতে হলেও যেন আয়ারল্যান্ডের কিছু অংশ যুক্তরাজ্যের সঙ্গে রেখে দেয়া যায় সেই কু-মতলবে উত্তর আয়ারল্যান্ডের ছয়টি কাউন্টি অধিগ্রহণ করে এবং ইংরেজদের ওইসব ভূমির জমিদারি প্রদান করা হয়। লন্ডন থেকে বহু ব্যবসায়ীকে নিয়ে এসে ছয় জেলায় পুনর্বাসন করে। এ জন্য উত্তর আয়ারল্যান্ডের ডেরি শহরটাকে লন্ডনডেরি বলে। ব্রিটেনের সঙ্গে বর্তমানে উত্তর আয়ারল্যান্ডই রয়েছে শুধু, বাকি অংশ স্বাধীন আইরিশ রিপাবলিক।
এবার আসি মূল প্রসঙ্গে। আয়ারল্যান্ড প্রজাতন্ত্রের একটি বামপন্থী রাজনৈতিক দল আছে, নাম শিন ফেইন, যার বাংলা অর্থ করলে হয় ‘আমরা নিজেরা’। ১৯০৫ সালে এই দল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল চরম জাতীয়তাবাদীদের হাতে। গত ডিসেম্বরে যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে উত্তর আয়ারল্যান্ডও এই দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েছিল। গত ৮ ফেব্রুয়ারি আয়ারল্যান্ডের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আইল্যান্ডের মোট আসন সংখ্যা ১৬০টি। তার মধ্যে শিন ফেইন পেয়েছে ৩৭টি আসন। ফিয়ানা ফাইল পেয়েছে ৩৮টি আসন আর ফাইন গায়েল দলটি পেয়েছে ৩৫টি আসন। এই ১১০ আসন ছাড়া অবশিষ্ট ৫০ আসন পেয়েছে স্বতন্ত্র এবং ছোট ছোট বামপন্থী দল।
শিন ফেইন ছিল মূলত আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির রাজনৈতিক প্লাটফর্ম। গত ১০০ বছর ধরে ফিয়ানা ফাইল এবং ফাইন গায়েল দলের আধিপত্য ছিল। এবার তাদের প্রতি বিরক্ত হয়ে শিন ফেইনকে আইরিশরা ভোট দিয়েছে। ছোট বামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে ঐক্য পরিষদের নেতা মেরি লো ম্যাকডোনাল্ড সরকার গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন এবং সফল হবেন বলা যায়। আয়ারল্যান্ডে সরকার গঠনে কোয়ালিশন অনিবার্য কারণ শাসনতান্ত্রিক বিধি অনুসারে সেখানে ভোটপ্রাপ্তির আনুপাতিক হারে আসন বণ্টন হয়।
শিন ফেইন আইরিশদের স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। বহু বছর তারা ক্ষমতায় ছিল না। শিন ফেইন নেতা ম্যাকডোনাল্ড এরই মধ্যে দাবি উত্থাপন করেছেন- ব্রিটেন যেন উত্তর আয়ারল্যান্ডে গণভোটের আয়োজন করে। আগেই বলেছি উত্তর আয়ারল্যান্ডেও শিন ফেইন দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েছে। সুতরাং গণভোটের দাবি না মানলে জোরদার আন্দোলন হবে। ব্রিটিশ কমন্স সভায় উত্তর আয়ারল্যান্ড থেকে শিন ফেইনের যেসব নির্বাচিত প্রতিনিধি রয়েছে তারাও গণভোটের কথা বলবেন। সুতরাং দাবি আদায় কঠিন হবে বলে মনে হয় না। আয়ারল্যান্ড ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য। তারা ইউনিয়নের সমর্থন প্রত্যাশা করতে পারে। স্কটল্যান্ড আর উত্তর আয়ারল্যান্ড বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে ব্রিটেন তার প্রাচীন অস্তিত্বে ফিরে যেতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন