মাঝে মাঝে আমি নিজের শরীরে চিমটি কেটে দেখি, আমি কি জেগে আছি না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি। চারদিকে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি। মনে হয় স্বর্গে আছি অথবা স্বর্গে চলে যাচ্ছি। আগামী ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। আর এই নির্বাচন সামনে রেখেই চারপাশে বইছে প্রতিশ্রুতির নহর। সম্ভব-অসম্ভব, এখতিয়ারের ভেতরে বা বাইরে সবরকম প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন প্রতিদ্বন্দ্বীরা। আমি জানি, আপনারাও জানেন; এসবই কোনোরকমে ১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়ার জন্য। গাং পার হইলেই মাঝি আবারও শালা হয়ে যাবে। ভোটাররা আগে যেমন ছিলেন, ভোটের পরও তেমনই থাকবেন; বাসের অযোগ্য হয়ে ওঠা এই ঢাকা শহরেই থাকতে হবে আমাদের।
রাজনীতিবিদদের আমার কাছে জাদুকরের মতো মনে হয়। জাদুকররা যেমন আমাদের চোখের সামনেই একটা ইল্যুশনের জগৎ তৈরি করে, মিথ্যাটাকে আমরা বিশ্বাস করি। রাজনীতিবিদরাও কথার জাদুতে আমাদের সামনে একটা বিভ্রমের জগৎ তৈরি করেন। অবচেতন মনে আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করি, এবার বুঝি বদলে যাবে ঢাকা। কিন্তু স্বপ্নের ঘোর কাটলেই বুঝি, এ নিছক মায়ার জগৎ, কথার খেলা। এমন অনেক প্রতিশ্রুতি আছে, পাস করলেও যা করার এখতিয়ার তার নেই। আবার এমন অনেক প্রতিশ্রুতি আছে, পাস না করলেও বাস্তবায়ন সম্ভব। কিন্তু আমরা জানি, কিছুই হবে না। গত কয়েকবছরে যা প্রতিশ্রুতি নিজ কানে শুনেছি, তার সিকিভাগ বাস্তবায়িত হলে ঢাকা এতদিনে বদলে যেত।
গত কয়েকদিন কান ঝালাপালা করা প্রতিশ্রুতিগুলো গোছালে এমন হতে পারে। এই প্রার্থীরা জিতলে আমরা একটি আধুনিক, স্মার্ট, সুস্থ, সচল, নিরাপদ ঢাকা পাব। তার মানে এখন ঢাকা একটি অনাধুনিক, আনস্মার্ট, অসুস্থ, অচল ও অনিরাপদ শহর। নির্বাচিত হলে কেউ ২৪ ঘণ্টা সিটি করপোরেশন খোলা রেখে জনগণের পাশে থাকতে চান, কেউ তিন মাসে যানজট দূর করতে চান, কেউ আধুনিক পদ্ধতিতে মশা মারতে চান, কেউ এলইডির আলোয় আলোকিত করতে চান, কেউ ঢাকাকে সিঙ্গাপুর বানিয়ে দিতে চান। আগে সবাই ঢাকাকে ‘তিলোত্তমা’ বানাতে চাইতেন। ইদানীং এই শব্দটা আর শুনি না। তিলোত্তমার আবেদন বুঝি ফুরিয়েছে।
প্রতিশ্রুতির বহর শুনলে আমার খালি একটা প্রশ্ন করতে মন চায়, ভাই পাস করলে করবেন, তাহলে এতদিন করেননি কেন? অবশ্য ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বীরই এই প্রশ্ন বলার সুযোগ আছে, আমরা আগে ছিলাম না, এবার সুযোগ দিয়ে দেখুন। যেমন ঢাকা দক্ষিণে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শেখ ফজলে নুর তাপস টানা তিনবারের এমপি হলেও এই প্রথম মেয়র হতে চাইছেন। পারিবারিকভাবে প্রভাবশালী তাপস ভদ্র, বিনয়ী, সৎ ও পরিচ্ছন্ন ইমেজের মানুষ। চাইলে তিনি অনেককিছু করতে পারবেন। তিনি যদিও নতুন প্রার্থী, তবুও তাকে প্রশ্ন করা যেতে পারে, আপনার দল তো টানা ১১ বছর ক্ষমতায়, বর্তমান মেয়রও তো আপনাদের দলেরই; তিনি এই কাজগুলো করেননি কেন? আপনি যেহেতু আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী, তাই দলের মেয়রের ব্যর্থতার দায় কিছুটা হলেও আপনাকে নিতে হবে। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি প্রার্থী ইশরাক হোসেন রাজনীতির মাঠে একদমই নতুন। ৩২ বছর বয়সী এই তরুণের এখন পর্যন্ত একটাই যোগ্যতা; তিনি অবিভক্ত ঢাকার সর্বশেষ মেয়র ও মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকার ছেলে। ঢাকা, বিশেষ করে পুরান ঢাকা তার কাছে উঠানের মতো। এই আলো-হাওয়াতেই তার বেড়ে ওঠা। তার কাছেও প্রশ্ন করা যায়, আপনার পিতা দীর্ঘসময় মেয়র ছিলেন। তিনি এই কাজগুলো করেননি কেন?
ঢাকা উত্তরের মানুষ বড় দুর্ভাগা। তারা কপালগুণে আনিসুল হকের মতো একজন মেয়র পেয়েছিল; যিনি কথায় নয়, কাজে বড় ছিলেন। তার অকালমৃত্যুর ক্ষতি কখনোই পূরণ হবে না। আনিসুল হকের উত্তরসুরীও তার মতোই একজন ব্যবসায়ী আতিকুল ইসলাম। মজাটা হলো আনিসুল হকই আতিকুল ইসলামের শক্তি এবং দুর্বলতা। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে আনিসুল হকের সহধর্মিণী রুবানা হক আতিকুল ইসলামকে আনিসুল হকের সাথে তুলনা না করার অনুরোধ করেছেন। কিন্তু আতিকুল ইসলামের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো, মানুষ সারাক্ষণ তাকে আনিসুল হকের সাথে তুলনা করবে। আর আনিসুল হক আমাদের প্রত্যাশার মাত্রা যেই আকাশে তুলেছেন, তা স্পর্শ করা আতিকুল ইসলাম কেন, যে কারও জন্যই কঠিন। এখন প্রার্থীরা সম্ভব-অসম্ভব প্রতিশ্রুতি দেন; আর আনিসুল হক অসম্ভব সব কাজ। আনিসুল হক প্রমাণ করেছেন ইচ্ছা থাকলে, আন্তরিকতা থাকলে, কমিটমেন্ট আর ভিশন থাকলে অসম্ভবকে সম্ভব করা সম্ভব।
আতিকুল ইসলামের শক্তি হলো, তিনি আনিসুল হকের অসমাপ্ত কাজ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। আনিসুল হকের মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে আতিকুল ইসলাম মেয়র হয়েছিলেন। মাত্র ৯ মাস একজন মানুষকে যাচাই করার জন্য যথেষ্ট নয়। তাই বাড়তি ছাড় তিনি পাচ্ছেন। তবে গত ৯ মাসে আমি আউট অব দ্য বক্স কিছু পাইনি। তিনি আনিসু্ল হকের অসমাপ্ত কাজ শেষ করার অঙ্গীকার করেছেন। নগর ভবনের ফাইল ঘাটলে দেখবেন, আনিসুল হক ঢাকায় হাতিরঝিলের মতো আরও তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন। একটি রামপুরায়, একটি গাবতলী, আরেকটি মিরপুর চিড়িয়াখানার পেছনে। এ তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ঢাকার জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির নাটকীয় উন্নতি হতে পারে।
‘নির্বাচিত হলে জলাবদ্ধতা নিরসন করব’ এ কথা বললে কেউ বিশ্বাস করবে না। কারণ আমরা জানি সেটা অসম্ভব। কিন্তু আনিসুল হক জানতেন অসম্ভব বলে কিছু নেই। তাই প্রতিশ্রুতি দিলে, সাথে তা পূরণের পথও বাতলে দিতে হবে। আতিকুল ইসলাম যদি সেই তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারেন, তাহলে আমি তার মাথায় সফল মেয়রের মুকুট পরিয়ে দেব। আপাতত একটা প্রশ্ন, এখন যে আপনি বলছেন, তিন মাসের মধ্যে যানজট নিরসন করবেন, তাহলে গত ৯ মাসে করেননি কেন?
তবে আমার সবচেয়ে বড় প্রশ্ন তাবিথ আউয়ালের জন্য। ব্যবসায়ী আব্দুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে তাবিথ সজ্জন, শিক্ষিত, ভদ্র, বিনয়ী। আনিসুল হকের সাথেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন তাবিথ। দলীয় সিদ্ধান্তে দুপুরেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হলেও তাবিথ ভালো ভোট পেয়েছিলেন। কিন্তু সেই যে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন, তারপর আবার ফিরে এলেন ঠিক পাঁচ বছর পর। মাঝের সময়টুকু একদম হাওয়া ছিলেন, দলীয় কোনো কর্মসূচিতেও দেখা যায়নি তাকে। রাজনীতি মানে কি শুধু পাঁচ বছর পরপর নির্বাচন? আগের নির্বাচনে তাবিথ এমন অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, পাস না করলেও যেটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব ছিল। অন্তত মানুষের পাশে থাকতে তো পাস করতে হয় না। তাবিথ যদি গত পাঁচ বছর বিপদে-আপদে মানুষের পাশে থাকতেন, তাহলে এবার তার গলা অনেক উঁচু থাকত। আমি নিশ্চিত ফেল করলে আবারও তিনি ডুব মারবেন। এমন মৌসুমী পাখিরা রাজনীতির জন্য ভালো নয়।
সবাই আধুনিক আর স্মার্ট ঢাকা গড়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তাদের প্রচারণায় তার কোনো ছোঁয়া নেই। এমনিতেই ঢাকার আকাশ দেখা যায় না। যেটুকু দেখা যেত, তাও ঢেকে গেছে পোস্টারে। নির্বাচিত হলে যারা জলাবদ্ধতা দূর করবেন, বর্জ্য পরিষ্কার করবেন; তারাই পোস্টার করেছেন পলিথিনে মোড়ানো বা লেমিনেটেড। শুধু এই পোস্টারের কারণে নির্বাচনের পর ঢাকার অনেক ড্রেন বন্ধ হয়ে যাবে, জলাবদ্ধতা বাড়বে। যেটা ঠেকানোর দায়িত্ব ছিল হবু মেয়র-কাউন্সিলরদের, সেটা হাইকোর্ট করেছে। লেমিনেটেড পোস্টার নিষিদ্ধ করে ঢাকাকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিয়েছেন হাইকোর্ট। নীরব পোস্টারের অত্যাচার না হয় মানা গেল; কিন্তু সারাক্ষণ কান ঝালাপালা করা ক্যাম্পেইনের জ্বালায় ঢাকায় থাকাই মুশকিল। উচ্চশব্দের মাইকে সারাক্ষণ নিম্নরুচির প্যারোডি আর ভাঁড়ামি, অসহ্য হয়ে গেছে। নির্বাচনের দুদিন পর এসএসসি পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। প্রার্থীরা হয়তো ভাবছেন, এসএসসি পরীক্ষার্থীরা তো ভোটার নন, তাই তাদের পড়াশোনার ব্যাপারে মনোযোগ দেয়ার দরকার নেই। তবে মনে রাখবেন এসএসসি পরীক্ষার্থীদের অভিভাবকরা কিন্তু ভোটার। যারা যত জ্বালিয়েছেন, তারা তত কম ভোট পাবেন আমি নিশ্চিত। যাদের প্রচারণায় কোনো সংবেদনশীলতা নেই, স্মার্টনেস নেই; তারা গড়বেন স্মার্ট ঢাকা! কেউ একজন নিশ্চয়ই পাস করবে। কিন্তু আমার কোনো উচ্চাশা নেই।
অকালপ্রয়াত কবি আবুল হাসানের নিঃসঙ্গতা নামে একটা কবিতা আছে:
‘অতটুকু চায়নি বালিকা!
অত শোভা, অত স্বাধীনতা!
চেয়েছিল আরও কিছু কম...’।
সেই বালিকার মতো আমাদের চাওয়াও অত বেশি নয়। আমার চাওয়া চারশ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী শহরটি অন্তত বাসযোগ্য থাকুক। এ বছর বেশ কয়েকবার ঢাকা বায়ুদূষণের বিবেচনায় প্রথম হয়েছে। এটাই বাস্তবতা। ঢাকার বাতাস শ্বাস নেয়ার যোগ্য নয়। শব্দদূষণে কান ঝালাপালা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় কেটে যায়। বর্ষায় জলাবদ্ধতায় আটকে যায় মহানগরী। পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট নেই, সকাল-বিকাল হাঁটার ভালো জায়গা নেই, লাইব্রেরি নেই। এমন অসংখ্য নেই নিয়েই ঢাকা। রাস্তাঘাট নোংরা, অস্বাস্থ্যকর, অনিরাপদ। যারাই নির্বাচিত হবেন সেই মেয়র আর কাউন্সিলরদের কাছে আমাদের চাওয়া সামান্য- আরেকটু সবুজ, আরেকটু পরিচ্ছন্ন, আরেকটু নিরাপদ, আরেকটু সচল এবং বাসযোগ্য ঢাকা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন