আবদুল মান্নান
ইদানীং সরকারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা, নীতি-নির্ধারক ও ব্যক্তির দায়িত্বহীনতা, সমস্যা মোকাবিলায় ব্যর্থতা অথবা অনিহা দেখলে মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে যে অনেক ক্ষেত্রে সঠিক মানুষ সঠিক দায়িত্বে নেই অথবা থাকলেও তারা সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তেমন একটা গুরুত্ব দেন না। আর দিলেও তাতে আন্তরিকতা বা কমিটমেন্টের অভাব থাকে। অনেকে এটা ধরে নিয়েছেন সব সমস্যার সমাধান প্রধানমন্ত্রীর কাছে আছে। তাই যদি হবে তাহলে জনগণের অর্থে এত সভা পারিষদ লালন করে কী লাভ? সব কথা সব সময় বলাও যায় না। বললে বিপদ। অনেকে নাখোশ হন। তবুও অনেক সময় বিবেকের তাড়নায় কিছু সত্য কথাতো বলতেই হয়। দেশে এখন পেঁয়াজের দাম দিয়ে হুলুস্থুল চলছে। কে কত দাম হাঁকতে পারে তার প্রতিযোগিতা। প্রধানমন্ত্রী হতে সাধারণ ক্রেতারা পর্যন্ত পেঁয়াজের দাম নিয়ে বেজায় বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ। অনেকে একে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে বেশ তৎপর। বিভিন্ন মন্ত্রী আর দু’দক পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করছেন। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। বাংলাদেশ পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ং সম্পূর্ণ নয়। প্রতি বছর কম-বেশি কিছু পেঁয়াজ ভারত বা মিয়ানমার হতে আমদানি করতে হয়। এই বছর ভারতে পেঁয়াজের উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তারা রফতানি শুধু নিষিদ্ধই করেনি, তারা এই অর্থবছর এক লক্ষ কুড়ি হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশে এই সংকট যে হতে পারে তা আগাম আঁচ করতে পারেনি আমাদের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অথবা করার প্রয়োজন মনে করেনি কিংবা করার মতো তাদের প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতার ঘাটতি ছিল। কোথায় ঘাটতি আছে তা খতিয়ে না দেখে মন্ত্রণালয়ের কোনও কোনও ব্যক্তি পেঁয়াজ সংকটের জন্য ভারতকে একতরফাভাবে দায়ী করছেন। কোনও দেশ তাদের নিজের প্রয়োজন না মিটিয়ে নিজের দেশের উৎপাদিত পণ্য অন্য দেশে রফতানি করে না। ভোগ্যপণ্য হলেতো নয়ই। এটাই প্রচলিত নিয়ম। এই সব বিষয় নিয়ে পরে অন্য কোনও সময় আলোচনা করা যাবে।
বুধবার আদালত ঢাকার হলি আর্টিজান জঙ্গি হামলার রায় দিলো। রায়ে সাতজন জঙ্গিকে ফাঁসির দণ্ড দেওয়া হয়। একজন খালাস পায়। ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ধার পর একদল সশস্ত্র জঙ্গি আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এক ভয়াবহ হামলা চালায়। সেই হামলায় কয়েকজন ইতালীয়, জাপানি ও ভারতীয় নাগরিক সহ মোট বাইশজন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান। তারা এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডটি চালায় ‘ইসলামি খেলাফত’ প্রতিষ্ঠার নামে। নিজেদেরকে মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস’ এর সদস্য দাবি করে। তাদের এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচার করে। এতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজের প্রভূত ক্ষতি হয়। এই জঙ্গিরা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে শুধু মধ্যপ্রাচ্য বা পাকিস্তানে নয় বাংলাদেশের মতো একটা শান্তিপ্রিয় দেশেও আইএস’এর মতো ভয়াবহ জঙ্গির অস্তিত্ব আছে। হামলাকারি জঙ্গিদের নিরস্ত্র বা কাবু করতে সেনা বাহিনীর কমান্ডোদের ডাকতে হয়। তারা ভোরের দিকে এসে হলি আর্টিজানের ভেতরে ঢুকে সকল জঙ্গিকে হত্যা করে। তবে ইতোমধ্যে জঙ্গিরা যা করতে চেয়েছিল তা সফলভাবে করতে পেরেছে। দেশে ও আন্তর্জাতিক মহলে তারা প্রচার পেয়েছে। নিরীহ বিদেশি হত্যা করে বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশের ইমেজ নষ্ট করেছে। কিছুদিন বাংলাদেশের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ থমকে গিয়েছিল। যে সকল বিদেশি এই হামলায় নিহত হয়েছিলেন তাদের বেশিরভাগই মেট্রোরেল প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কয়েকজন ছিলেন তৈরি পোশাক ক্রেতার প্রতিনিধি বা বায়ার আর আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মকর্তা। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত কিন্তু ঘটনার দিন হলি আর্টিজানে উপস্থিত ছিল না, পরবর্তীকালে বিভিন্ন স্থান হতে যে ক’জন আটক হয়েছে, বুধবার তাদের বিচার হয়েছে।
বিচারে যে রায় হয়েছে তা ছিল প্রত্যাশিত। একজন অভিযুক্ত খালাস পেয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ বলেছে তারা এই খালাসের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবে। আর দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের কৌশলী বলেছেন তাঁর মক্কেলরা নিম্ন আদালতে ন্যায় বিচার পাননি। তিনিও তার মক্কেলদের নির্দোষ প্রমাণ করতে উচ্চ আদালদের দ্বারস্থ হবেন। এটি একটি প্রচলিত আইনি প্রক্রিয়া।
বুধবারে আদালতের এই মামলার রায় দেওয়ার আগে ও পরে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও কারারক্ষীদের অবাক করার মতো বেশ কিছু দুর্বলতা সবার চোখে পড়েছে। সাধারণত এমন অপরাধীদের আদালতে আনা-নেওয়ার সময় মাথায় হেলমেট ও শরীরে বুলেট প্রুফ জ্যাকেট থাকে। প্রিজন ভ্যান হতে নামানো বা উঠানোর সময় সাধারণ মানুষকে দূরে রাখা হয়। কোনও সাংবাদিক বা অন্য কোনও ব্যক্তিকে আসামিদের সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হয় না। অথচ বুধবার দেখা গেলো আসামিরা প্রিজন ভ্যান হতে নামার সময় তাদের শরীরে না আছে কোনও বুলেট প্রুফ জ্যাকেট, না আছে কোনও হেলমেট। তাদের দেখে মনে হচ্ছিল তারা বেশ খোশ মেজাজেই আছে। কয়েকজন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টাও করেছে। তবে সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হচ্ছে রায়ের পরে আসামিদের দু’জন মাথায় কালো কাপড়ের আইএস-এর প্রতীক লাগানো কালো টুপি দেখে। আদালতে ঢুকার সময় তাদের মাথায় এমন কোনও টুপি ছিল না। তারা পুলিশের সঙ্গে আদালত হতে বের হওয়ার সময় ‘আল্লাহু আকবার’ বলে শ্লোগান দিচ্ছিল। সাথে থাকা পুলিশ ও কারারক্ষীরা একবারও এই কর্মকাণ্ড থামানোর কোনও চেষ্টা করেননি। তারা প্রিজন ভ্যানে ওঠার সময় জোর গলায় বলতে লাগলো এই দেশে তাদের স্বপ্নের ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠা হবে। ফাঁসি দিয়ে তাদের লক্ষ্য হতে বিচ্যুত করা যাবে না। তারা এও জানিয়ে দিলো তাদের পরে তাদের অনুসারিরা অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করবে। আদালতে তাদের আচরণ ছিল বেশ ঔদ্ধত্যপূর্ণ।
প্রশ্ন হচ্ছে তারা আইএস-এর প্রতীকওয়ালা টুপি পেলো কোথায়? টুপি যদি আদালতে সরবরাহ করা হয় তা হলে তো টুপির বদলে অন্য কিছুও দেওয়া যেত পারতো। তা হতে পারতো বিস্ফোরক বা অস্ত্র জাতীয় কিছু। পাঠকের মনে থাকতে পারে ১৯৬৩ সালের ২৪ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত লী হারভে অসওয়াল্ডকে পুলিশের হেফাজতে থাকাকালে জ্যাক রুবি নামক একজন ইহুদি ঘাতক গুলি করে হত্যা করেছিল। হত্যার সময় পুলিশ অসওয়াল্ডকে কারাগারে নিয়ে যাচ্ছিল। তখন সাংবাদিকদের ভিড় ছিল। রুবি সেই ভিড় ঠেলে অসওয়াল্ডকে গুলি করে হত্যা করে। এর ফলে কেনেডি’র হত্যা রহস্যের জট আর খোলেনি। এই সব কারণেই বিশ্বের যে কোনও দেশে জঙ্গি বা বিপদজনক কোনও অপরাধীকে আদালতে বা অন্য কোনও জায়গায় নিয়ে যাওয়ার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেক সতর্কতা অবলম্বন করে।
২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি কাশিমপুর কারাগার হতে গাজীপুর কারাগারে স্থানান্তরের সময় ময়মনসিংয়ের ত্রিশালে তিনজন জেএমবি সদস্য একজন পুলিশকে হত্যা করে পালিয়ে যায়। তারা এখনও অধরা আছে। এই ঘটনায় দু’জন পুলিশও আহত হন। ধারণা করা হচ্ছে সেই ঘটনায় কিছু ভারতীয় জঙ্গিও জড়িত ছিল। বাংলাদেশের পুলিশ মারাত্মক সব বিপদের ঝুঁকি নিয়ে অনেক অপারেশন করে কিন্তু যে ধরনের প্রশিক্ষণ তাদের থাকা প্রয়োজন তা তাদের অনেকেরই নেই। এই জঙ্গিরা যে কালো রংয়ের টুপি পরেছিল তা নিশ্চয় কেউ তাদের দিয়েছে অথবা তারা কারাগার হতে আনার সময় সাথে নিয়ে এসেছে। এমন একটা সন্দেহ হওয়াটা স্বাভাবিক। আইনমন্ত্রী মন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য একটি তদন্ত করবেন। মানুষ দ্রুত তদন্ত শেষে তার ফলাফল দেখতে চায়। এই সব ঘটনা রিপোর্টিংয়ের সময় ইলেকট্রনিক মিডিয়ার আরো দায়িত্বশীল হওয়া উচিত। বিশ্বের কোনও দেশে এই ধরনের ঘটনাকে লাইভ দেখানো হয় না। এই ব্যাপারে বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক মিডিয়া সব সময় দায়িত্বশীল ছিল না। বিশেষ করে বিডিআর বিদ্রোহ ও হলি আর্টিজান ঘটনার সময়। বুধবারেও তাদের একই ভূমিকায় দেখা গেলো। ২০০৮ সালের ২৯ নভেম্বর মুম্বাইয়ের তাজ হোটেলে যখন পাকিস্তানি জঙ্গিরা হামলা করেছিল তখন ভারতের এনডিটিভি পুরো ঘটনা সরাসরি সম্প্রচার করছিল। এনডি টিভি’র রিপোর্টার বারখা দাত পুরো ঘটনার ধারাবর্ণনা দিচ্ছিলেন। পরে এনিডিটিভি ও বারখা দাত বেশ সমালোচিত হয়েছিলেন। অনেক সময় এই ধরনের রিপোর্টিং নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে।
যে কোনও সরকার রাষ্ট্রের ভূত তাড়াতে নানা ধরনের সরষের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু সেই সরষের মধ্যেই যদি ভূত থাকে তা হলে তাকে তো তাড়ানো অসম্ভব। এমনটি হলে শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
বুধবারের রায় বিশ্বে বাংলাদেশকে একটি ভিন্ন পরিচয়ে পরিচিত করেছে। বর্তমান সরকার জঙ্গি দমনে জিরো টলারেন্স নীতিতে বিশ্বাস করে এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত কেউই পার পাবে না। অপরাধ করলে তাদের বিচারের মাধ্যমে সাজা পেতে হবে।
লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন