এম আই কে রাশিদুল ইসলাম রাশেদ
রাষ্ট্রীয় আমলাদের ঘষামাজার (দুর্নীতি ও প্রকল্প লুটপাট, হরিলুট করার) মাঝে রাষ্ট্র ও সরকার যেন নির্বিকার অবস্থায়! যাকে হতভম্ব বলা যায়। আমলারা নিয়মিত দুর্নীতি আর লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রের সর্বত্র। রাষ্ট্রের হেন কোনো প্রশাসনিক স্তর নেই, যেখানে দুর্নীতি আর লুটপাট করছে না আমলারা! এমনকি কোথাও কোথাও হরিলুট পর্যন্ত করে যাচ্ছে। রূপপুরে বালিশ ক্রয়ে, ফরিদপুরে পর্দা ক্রয়ে, ঢেউটিন ক্রয়ে, গোপালগঞ্জে কম্পিউটার মেরামতে, খাল খননের প্রশিক্ষণ যাত্রাসহ বিভিন্ন ধরনের ক্রয় ও মেরামতে এবং বিভিন্ন প্রকল্পে উল্লেখযোগ্য লুটপাট বা হরিলুট খুবই লক্ষণীয়। যা রাষ্ট্র ও সরকারের মেরুদণ্ডটি নাড়িয়ে দিচ্ছে। সরকারের উন্নয়নকে ইতোমধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে আমলাদের এই ঘষামাজার দুর্নীতি! নাগরিক বিতৃষ্ণা এসেছে এসব দুর্নীতি আর লুটপাটের বিরুদ্ধে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন স্তরের মিডিয়ায় প্রচুর সমালোচিত হচ্ছে এসব দুর্নীতি, লুটপাট আর হরিলুট। Bangladesh Pratidin ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ই-পেপারে এসেছে যে, রেলওয়ের কারিগরি প্রকল্প: ক্নিনারের বেতন মাসে ৪ লাখ ২০ হাজার আর অফিস সহায়কের বেতন ৮৪ হাজার টাকা। অবাক হলেও রেলওয়ের কারিগরি প্রকল্পে এমনই অবিশ্বাস্য বেতন ধরা হয়েছে। সম্প্রতি রেল মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা কমিশনে এ প্রকল্প প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। আর এই প্রস্তাবকে ‘অস্বাভাবিক ও অগ্রহণযোগ্য’ বলে মন্তব্য করেছে স্বয়ং পরিকল্পনা কমিশন। প্রকল্পের আওতায় কেমন দুর্নীতির চিত্র ভেসে এসেছে! তা একটু ভেবে দেখুন!
আজ অবাক বাংলাদেশ!
শুধু তাকিয়ে রয়!
দুর্নীতি ও লুটপাট এমন সমস্ত প্রকল্পে হয়!
দুর্নীতি রোধিবে যে, সেও আজ করাপ্টেড বয়!
দুর্নীতি প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। এর থেকে রেহাই পাচ্ছে না কোনো নাগরিক। যখন নাগরিকগণ নাগরিক সেবা গ্রহণ করতে যাচ্ছে, তখন অক্টোপাসের মতো দুর্নীতি জড়িয়ে ধরছে নাগরিকদের। তাই দুর্নীতি রোধে স্বয়ং সরকারের প্রধানমন্ত্রী নজরদারি করতে মনোনিবেশ করছেন। গত ১৮ আগস্ট রোববার সকালে প্রধানমন্ত্রী তার তেজগাঁও কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে পবিত্র ঈদুল আজহা পরবর্তী শুভেচ্ছা বিনিময়কালে বলেছেন- ‘যে ঘুষ নেবে তার বিরুদ্ধে তো ব্যবস্থা নিতে হবেই, যে ঘুষ দেবে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন- ঘুষ মানুষকে অন্ধ করে দেয়, কবরে কিন্তু একাই যেতে হবে। ‘দুর্নীতির মাধ্যমে যে ঘুষ নেবে, সে শুধু একা অপরাধী নয়, যে দেবে সেও অপরাধী। এই জিনিসটা মাথায় রাখা এবং সেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। তাহলে আমাদের অনেক কাজ দ্রুত হবে।’ তবে প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতি দমন কমিশন দিয়ে দুর্নীতি দমন করতে কতটুকু সাফল্য অর্জন করবেন? তা কিন্তু একটি বাস্তবসম্মত প্রশ্ন। কেননা ইতোমধ্যে দেখা গেছে যে, দুর্নীতি দমন কমিশনে নিয়োজিত অনেক কর্মকর্তা অবলীলায় দুর্নীতি করে বেড়াচ্ছে। সুতরাং নীতিগত প্রশিক্ষণ, নৈতিক আচরণে অঙ্গীকারবদ্ধ এবং রাষ্ট্রীয় আদর্শ ধারণ করতে হবে নির্বিশেষে সবাইকে। তাহলে দুর্নীতি দমন হতে পারে।
যদিও রূপপুরের বালিশ ও ফরিদপুরের পর্দাকাণ্ডকে দিনে দুপুরে ডাকাতি বলে মন্তব্য করেছেন বর্তমান সরকারের কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি মনে করেন, এসব দুর্নীতির কারণে ক্ষমতাসীন দলকে চড়া রাজনৈতিক মূল্য দিতে হতে পারে। এমনটা এসেছে বিবিসি বাংলার খবরে।
ক্ষমতাসীন দল কতটুকু চড়া মূল্য দেবে, সেটা সময় বলে দিবে। কিন্তু এ রাষ্ট্রের নাগরিকগণ নিত্য চড়া মূল্য দিচ্ছে। রাষ্ট্রে দুর্নীতি বিরাজমান থাকার জন্য নাগরিকগণের নাভিশ্বাস অবস্থা। শ্বাস ছেড়ে বাঁচার আকুতি, আর্তচিৎকারে রাষ্ট্রের নাগরিক হাহুতাস করছে সর্বদা।
অবশ্য সর্বোচ্চ আদালতে দুর্নীতিগ্রস্থ হয়েছে স্বয়ং বিচারকগণ। প্রশ্ন হচ্ছে- বিচারপতির বিচার কি হবে? যদিও এসব দুর্নীতিগ্রস্থ বিচারক বিচারের আওতায় সাময়িক বরখাস্ত। পুলিশের সংঘবদ্ধ ধর্ষণ যেভাবে তলিয়ে গেছে, সেভাবে দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার বাছিরের বিচার তলিয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। আর ডিআইজি মিজান তো দুর্নীতির মামলায় বিচারাধীন অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ তালিকায়! বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য একটা মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে এইসব সার্বিক দুর্নীতি, লুটপাট ও হরিলুট। দুর্নীতি আর লুটপাট কিংবা হরিলুট ঠেকাতে হবে এখনই, নতুবা রাষ্ট্রের ভীত নড়ে ওঠার সমূহ প্রয়াস পেতে পারে। অবশ্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডের হাড় যথেষ্ট ক্ষয় শুরু হয়েছে বলে অনেক অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন। এ বিষয়ে অর্থনীতির পরিসংখ্যান আর ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি আমাদের কাছে যথেষ্ট প্রমাণ এনে দেয় বটে। যা আমার রচিত "বঙ্গরাষ্ট্রের রাজনীতি ও দুর্বৃত্তায়ন" গ্রন্থে কিছুটা বর্ণনার চেষ্টা করেছি। যদিও আমি অর্থনীতি নিয়ে অর্থনীতির সঠিক সরণী ব্যাখ্যা ও যথাযথ বিশ্লেষণ করতে পারছি না বলে সন্দেহ হয়, যেমন ভাবে একজন মেধাবী ও স্বচ্ছ অর্থনীতিবিদ বিশ্লেষণ করে থাকে।
দৈনিক জাগো নিউজ থেকে জানা যায়- নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সন্দ্বীপ চ্যানেলের ভাঙন থেকে মুসাপুর ক্লোজার, রেগুলেটর এবং সংলগ্ন এলাকা রক্ষার জন্য মুসাপুর রেগুলেটরের ডাইভারশন চ্যানেল ও সন্দ্বীপ চ্যানেলের বাম তীর প্রতিরক্ষা। এখানে ৪.৪ কিলোমিটার তীর সংরক্ষণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১০০ কোটি ৮৯ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। ১.৩ কিলোমিটার রোড নির্মাণ ও কার্পেটিং খরচ ৩ কোটি ৩ লাখ ৬১ হাজার টাকা। প্রকল্পের পাঁচটি সাইনবোর্ড তৈরিতে ব্যয় হবে সাড়ে ২৭ লাখ টাকা। সিল ও স্ট্যাম্প খাতে ব্যয় ৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এটা রীতিমতো হরিলুটের মহাচিত্র। আর এ চিত্রে আমলাদের ঘষামাজার নিখুঁত দুর্নীতিগ্রস্ত চরিত্র দারুণভাবে ফোটে উঠেছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর কৃত্রিম দুর্যোগ দুটোই দুর্যোগ। যারা ভুক্তভোগী মানুষ, তারাই বুঝেন কেমন হতে পারে দুর্যোগের চিত্র। বর্তমানের বাংলাদেশের মানচিত্রে দুর্নীতি একটি কৃত্রিম মহা-দুর্যোগ। প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের তেমন কিছু করার না থাকলেও সতর্ক হতে পারে, যাতে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়। কিন্তু কৃত্রিম দুর্যোগে মানুষের করার থাকে অনেক, কেননা এ দুর্যোগ মানুষের দ্বারা সংঘটিত হয়ে থাকে। যা মানুষ নিজ ইচ্ছায় সংঘটন করে। তাই ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করে এ কৃত্রিম দুর্যোগ থেকে নিয়ন্ত্রিত হওয়া যায়। দুর্নীতি প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত আমলাদের তৈরি করা ইচ্ছাকৃত কৃত্রিম দুর্যোগ। এর প্রভাবে যা ক্ষতি হচ্ছে, তা তাদের ইচ্ছা লোভের কারণে। তাই তাদের লোভ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর এটা সবার আগে রাজনীতিবিদদের চিন্তা করতে হবে। কিন্তু রাজনীতিবিদদের আজকাল অনেকটা স্বার্থান্বেষী বিশ্ববেহায়াদের মতো আচরণ করতে দেখা যায়। তারাও স্বার্থান্বেষণ করে থাকে, ফলে দুর্নীতি করার পথ সুগম বৃদ্ধি পায়। যেটা অত্যন্ত হতাশাজনক ও দুঃখজনকও বটে। এতে ক্ষতি হচ্ছে সমাজ ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থাসহ রাজনৈতিক ব্যবস্থা। আর এতে করে দিন দিন রাষ্ট্রে সম্পদের বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধনী আরো ধনী হচ্ছে, অন্যদিকে গরীব আরো গরীব হচ্ছে। সুতরাং দুর্নীতি বিদূরিত হলেই শুধুই ধনীরা ধনী হবে না। বরং গরীবরাও ধনী হবে
ধনী লোকগুলো হচ্ছে আরো ধনী,
সোনার বাংলায় এইটা কেমনে মানি?
৯৯% জনগণ হবে তাদের দাস!
এই রীতি হলো তারই বহিঃপ্রকাশ!
সুশাসনের রাষ্ট্রে এটা সর্বনাশ!
এটি পুঁজিবাদের দুর্নীতির দৌরাত্ম্যর ফল!
পুঁজিবাদের শক্তিগুলো করছে নানা কৌশল!
সাধারণ জনগণ নিত্য ভোগ করছে এর কুফল।
আমরা যেমনি লজ্জাকর কাজ করিয়া লজ্জিত নই যখন, সভ্যতা তেমনি সভ্যকরণেই অসভ্য হাসি হাসে তখন। আর বলে তোরা রেপলিকা পড়ে কতদূর এগোতে পারবি? সত্যিই তো- আসলটা অর্জন না করতে পারিলে, রেপলিকা দিয়ে শেষ পর্যন্ত এগোনো যায়? যায় না। দুর্নীতি, লুটপাট, হরিলুট অবশ্যই অসভ্যের ইঙ্গিত বহন করে আধুনিক শিক্ষিত সমাজে। আর মানুষ সভ্যতায় ভর করে এগোতে গিয়ে কৃত্রিম আচরণের দায়ে অসভ্য হয়ে যায়। দুর্নীতি, লুটপাট ও হরিলুট অসভ্যের দারুণ ইঙ্গিত। তাই বলা যায়, দুর্নীতি করার মাধ্যমে সভ্যতার পথেও শিক্ষিত মানুষ অসভ্যতায় পিশাচী হয়ে উঠে। যদিও এটা মানুষের প্রকৃতিগত ও কৃত্রিম আচরণগত শত্রুতার কারণেই হয়। স্বভাবজ প্রকৃতিজাত অনেকটা খারাপ নিদর্শন। এটা পরিহার করিতে পারিলে পুরোপুরিভাবে সভ্য ছোঁয়া পেতে পারবে বাঙলার মানুষ। আর তখনি সে আসল সভ্য মানুষ হয়ে উঠতে পারবে। তবে না পারিলে, অসভ্যতার গ্রাসে ধ্বংস করবে বাঙালির সর্বস্তরের মানুষকে।
এম আই কে রাশিদুল ইসলাম রাশেদ
কবি, লেখক, রাজনীতিবিদ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন