সামনে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা। ঈদ মানেই নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা। সারা বছর ধরে সবাই উন্মুখ হয়ে থাকে ঈদে বাড়ি যাবে বলে। কিন্তু এ বছর আমাদের একটু অন্যভাবে ভাবতে হবে এবং এটা করতে হবে আমাদের নিজেদের স্বার্থেই। পারলে এ সময়টা আমাদের যার যার জায়গায়ই থাকা উচিত। কারণ একজন ডেঙ্গুরোগী যখন বাড়ি যাবে, সেখানে সে ডেঙ্গু ভাইরাসটি বহন করে নিয়ে যাবে। তা ছাড়া অনেকেই জ্বর হয় না বলে বুঝতেই পারে না তারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। তাই আমরা জানিই না, অজান্তেই ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করে নিয়ে যাচ্ছি কি না। উপরন্তু সারা দেশেই এডিস মশার বিস্তার ঘটছে বলে ঈদের পর ডেঙ্গু আরো ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এডিস এজিপ্টি ও এডিস অ্যালবোপিক্টাস নামক দুটি মশার প্রজাতি দ্বারা ডেঙ্গু ছড়ায়। এর মধ্যে এডিস এজিপ্টিকে বলা হয় আরবান মসকুইটো বা শহুরে মশা। এরা সাধারণত ঘরের ভেতর, বারান্দা বা ছাদে ফুলের টব, জমানো পানির পাত্র, গাড়ির পরিত্যক্ত টায়ার, নির্মাণাধীন বাড়ির পাশে রাখা চৌবাচ্চা বা ড্রাম, কনডেন্সড মিল্কের কৌটা, নারকেলের খোল ইত্যাদি মানুষের তৈরি কৃত্রিম পানির পাত্রে বংশবৃদ্ধি করে। অন্যদিকে এডিস অ্যালবোপিক্টাসকে বলা হয় রুরাল মসকুইটো বা গ্রাম্য মশা। তাদের ফরেস্ট মসকুইটো বা বন্য মশাও বলে। এই প্রজাতির মশা সাধারণত প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট বদ্ধ স্বচ্ছ পানির উৎস যেমন গাছের গুড়ি, কাটা বাঁশের গোড়া, ভাঙা রাস্তা, বদ্ধ স্বচ্ছ ডোবা ইত্যাদিতে বংশবৃদ্ধি করে। তাই গ্রামে বা মফস্বলে এই মশাটি সহজেই তার বংশবিস্তার করতে পারে। তবে বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে এই দুই ধরনের মশাই একে অন্যের প্রজনন স্থানে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারে। যদিও এডিস এজিপ্টি ডেঙ্গুর প্রধান বাহক কিন্তু মহামারি পর্যায়ে এডিস অ্যালবোপিক্টাসও সমানভাবে ডেঙ্গু রোগ ছড়াতে পারে। তাই শহরের মতো গ্রামে বা মফস্বলেও ডেঙ্গু রোগ ছড়ানোর যথেষ্ট উপযুক্ত পরিবেশ রয়েছে।
যদি বাড়ি যেতেই হয়, কিছু কিছু ব্যাপারে আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের দুই-তিন দিনের অনুপস্থিতিতে আমাদের বাসায়ই জন্ম নিতে পারে এডিস মশা। তাই সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। বাসাবাড়ি ছাড়ার আগে কিছু কাজ অবশ্যই করতে হবে। যেমন—
বাসার ফুলের টব ও ফুলদানির পানি ফেলে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছুই নয়।
ফ্রিজের নিচের ট্রের পানি পরিষ্কার করতে হবে এবং ট্রেতে যাতে পানি জমতে না পারে তার জন্য সেখানে কোনো কাপড় বিছিয়ে রাখা যেতে পারে। কারণ ভেজা জায়গায় এডিস ডিম দিতে পারলেও পানি ছাড়া লার্ভা বৃদ্ধি লাভ করতে পারে না।
এয়ার কন্ডিশনারের পানির ট্রেতে যাতে পানি না জমে, খেয়াল করতে হবে।
কমোডের পানি ফ্লাশ করে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। বেসিনে কলের নিচের যে অংশে পানি জমে, তা কাপড় বা টিস্যু দিয়ে মুছে পরিষ্কার করে যেতে হবে। কোনো গ্লাসে পানি আছে কি না বা জগের ঢাকনা লাগানো আছে কি না পরীক্ষা করে নিতে হবে। বাথরুমের বালতিতে কোনো অবস্থায়ই পানি রাখা যাবে না। পানি ফেলে দিয়ে বালতি উল্টে রাখতে হবে।
বাসার ছাদের কোথাও পানি জমে থাকলে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। বাসার পাশের অগভীর পাকা ড্রেনে যাতে পানি জমতে না পারে, সাধ্যমতো তার ব্যবস্থা করতে হবে। ঘরের ভেতর স্প্রে করে বয়স্ক বা উড়ন্ত মশাকে মেরে ফেলতে হবে, যাতে আমাদের অনুপস্থিতিতে সেগুলো বংশবৃদ্ধি না করতে পারে। যাত্রার সময়ে বা যাত্রাস্থলে গিয়ে যথাসম্ভব কাপড় দিয়ে শরীর ঢেকে রাখতে হবে। মসকুইটো রিপেলেন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। বাড়ি গিয়ে মশারি, স্প্রে ও মশার কয়েল ব্যবহার করতে হবে। দুই-তিন দিনের অনুপস্থিতিতে ভেজা জায়গায় এডিস মশা ডিম দিতে পারে। বাড়ি থেকে ফিরেও সর্তক থাকতে হবে যাতে কোনো জায়গায় এডিস মশার লার্ভা বৃদ্ধি লাভ করতে না পারে। কোরবানির বর্জ্য ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে। কারণ এতে সব ধরনের মশা-মাছির বৃদ্ধি ঘটে।
লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, প্যারাসাইটোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
ড. তাহসিন ফারজানা
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন