শেখর দত্ত
এতটা কনফিডেন্স প্রধানমন্ত্রী পান কীভাবে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলন টেলিভিশনে গভীর মনোযোগের সঙ্গে শুনে সবেমাত্র ভারত-অস্ট্রেলিয়ার খেলা দেখার জন্য রিমোট কন্ট্রোলে চাপ দিয়েছি, এমন সময় উত্তরবঙ্গের গ্রামের এক রাজনৈতিক বন্ধুর টেলিফোন বেজে উঠল। ঈদ উৎসবের শুভেচ্ছা জানানোর পরই তিনি বললেন, সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর প্রধানমন্ত্রী কীভাবে দিলেন, তা কি দেখলেন? আমাকে উত্তর দিতে না দিয়ে তিনিই বলতে লাগলেন, একটি প্রশ্নও তিনি এড়িয়ে যাননি। প্রশ্ন করতে যেমন বাধা দেননি, তেমনি একটুও তাড়াহুড়ো করেননি। সব যেন তার নখদর্পণে। মনের কথা সব সুস্পষ্ট, খোলামেলা ও সাবলীলভাবে বলেছেন। রাখঢাক নেই।
এতটা কনফিডেন্স নিয়ে উত্তর তিনি দিয়েছেন, যাতে মনে জোর ও আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে। এতটা মনে রাখেন কীভাবে? এতটা কনফিডেন্স তিনি পান কীভাবে? এই প্রশ্নে তিনি কী বলেন, সেই উত্তর শুনতে চাইছিলাম। কিন্তু তিনি আমাকে কোনো কথা বলতে না দিয়ে চলে গেলেন, তারেক রহমান প্রসঙ্গে। বললেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে মনে তো হচ্ছে তারেককে এবার দেশে ফিরিয়ে আনা যাবে। শাস্তিও কার্যকর হবে। দেশ ও রাজনীতি নিয়ে কথাবার্তায় তারেক রহমান প্রসঙ্গ উঠলে অন্য সব কথা চাপা পড়ে যায়, আজো তেমনটাই হলো। প্রধানমন্ত্রী মনে এতটা জোর বা আস্থা পান কী কারণে, এই প্রশ্নে বন্ধুটির ভাবনা তার কাছ থেকে শোনা হলো না।
উন্নয়ন ও বাজেট, দারিদ্র্য ও জনকল্যাণমূলক কাজ প্রভৃতি নিয়ে তিনি সংক্ষেপে যা বলেছেন, তা খুবই চিত্তাকর্ষক। যে কথাটি সবচেয়ে মূল্যবান তা তিনি এক কথায় বলেছেন, মানুষ যাতে ‘কর্মবিমুখ না হয়’ সেটা মাথায় রেখে ভাতা নির্ধারণ করা প্রয়োজন
বন্ধুটির ওইসব কথা শোনার কারণেই পরদিন সোমবার গভীর মনোযোগের সঙ্গে কয়েকটি পত্রিকা খুলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনের খবর পড়লাম। বন্ধুটি যে সত্য কথাই বলেছেন, তা আবারো মনে হলো।
প্রসঙ্গত, সংবাদ সম্মেলনের প্রশ্নোত্তর শুনে আবারো মনে হলো দেশের অবস্থাসহ রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহের আগাগোড়া ও খুঁটিনাটি আর সে সঙ্গে দেশ কোথায় ছিল, বর্তমানে কী অবস্থায় আছে, তিনি কী করতে চান, দেশকে বিশ্ব দরবারে কোথায় টেনে তুলতে চান প্রভৃতি সব বিষয় তার নখদর্পণে আছে বলেই তিনি এতটা সাবলীল ও সুস্পষ্টভাবে সব কথার উত্তর দিতে পারেন।
বলাই বাহুল্য, রোহিঙ্গা আমাদের জন্য যেমন বড় বোঝা তেমনি তাদের সামলে রাখা আমাদের জাতির জন্য বড় এক সমস্যা। আমাদের নিজেদেরই আছে নানা সমস্যা, প্রতিনিয়ত এদিক-ওদিক নানা সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে এবং হবেও। এসবের সমাধান করে সামনে অগ্রসর হতে হবে, প্রয়োজনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ভুল-শুদ্ধ পথে সমাধান খুঁজতে হবে, এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে, শরণার্থী সমস্যা যদি একবার ঘাড়ে চাপে তবে তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া জটিল ও কঠিন।
বলাই বাহুল্য, এই সমস্যা বিশ্ব বাস্তবতা থেকে উত্থিত এবং সাধারণভাবে শরণার্থীরা অসহায় হলেও এখন কোনো দেশই তাদের নিতে চায় না। জাতিসংঘও এখানে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না। তাই এই গ্লোবাল সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে তা এখনো অজানা থাকছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘সবাই (সব দেশ) চায় রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফেরত যাক। কিন্তু মিয়ানমারের সাড়াটা পাই না। তারা আগ্রহী নয়।’ এরপর তিনি সরাসরি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোকে অভিযুক্ত করে বলেছেন, ‘তারা চায় না কোনো রিফিউজি স্বদেশে ফেরত যাক। তালিকা যখন করলাম প্রত্যাবাসনের জন্য তখন রোহিঙ্গারা আন্দোলন করল তারা ফেরত যাবে না। এর পেছনে উসকানি দেয় কে? অনেক সংস্থা চায় না তারা ফেরত যাক। কারণ গেলে তাদের চাকরি থাকবে না। ফান্ড আসবে না। কক্সবাজারে আরামে থাকা যাবে না।’ সার্বিক বিবেচনায় বলা যায়, রোহিঙ্গাদের স্বদেশে কিংবা আপাতত ভাসানচরে পাঠানোর বিষয়ে দেশ-বিদেশে সরকারের পক্ষে তীব্র ও ব্যাপক জনমত গড়ে তোলা আজ সময়ের দাবি।
দেশে জঙ্গি দমন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী যেসব কথা বলেছেন, তা নিঃসন্দেহে জনমনে শক্তি ও সাহস জোগাবে। মানুষ যাতে ভয় না পায় সেদিকেও তিনি সজাগ। তাই তিনি বলেছেন, ‘সবটা বলে মানুষকে আমি ভীত করতে চাই না।’ এই সমস্যা মোকাবিলা তথা জঙ্গিবাদ দমনে তিনি জনগণের সচেতনতাকে দেশের ‘সবচেয়ে বড় শক্তি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। জঙ্গি সমস্যা ও ইসলামি দেশগুলোর পারস্পরিক খুনোখুনি সস্পর্কে তিনি খোলামেলাভাবে যেসব কথা বলেছেন, তা মহামূল্যবান। ‘লাভবান কে হচ্ছে? যারা অস্ত্র বানাচ্ছে তারা। যারা অস্ত্র দিচ্ছে তারা।’ নিরীহ মানুষ মারলে আল্লাহ, ঈশ্বর, গড যে পাওয়া যায় না- সেই চরম সত্যটা তিনি তুলে ধরে মানুষের বিবেককে জাগ্রত করতে প্রয়াসী হয়েছেন। অশুভকে দমনের পাশাপাশি এর বিরুদ্ধে মানুষের বিবেককে জাগ্রত করার পথই যে যথার্থ পথ, তা তিনি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন।
উন্নয়ন ও বাজেট, দারিদ্র্য ও জনকল্যাণমূলক কাজ প্রভৃতি নিয়ে তিনি সংক্ষেপে যা বলেছেন, তা খুবই চিত্তাকর্ষক। যে কথাটি সবচেয়ে মূল্যবান তা তিনি এক কথায় বলেছেন, মানুষ যাতে ‘কর্মবিমুখ না হয়’ সেটা মাথায় রেখে ভাতা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে একটুও এদিক-ওদিক চিন্তা না করে তিনি বলেছেন, ‘তাদের বিশাল এলাকা। অত্যন্ত রিসোর্সফুল জায়গা। আমাদের জায়গা তো অনেক কম। অনেকে তুলনা করেন।
কিন্তু যারাই করুক, তাদের মাথায় রাখা উচিত, বাংলাদেশের মতো এই ভূখণ্ড দিয়ে ১৬ কোটি মানুষকে বসিয়ে দেই? কতটুকু সুস্বাস্থ্য আর কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারবে তারা?’ এসব প্রশ্ন তুলে চরম আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছেন, ‘মাত্র ৫৫ হাজার বর্গমাইল এলাকায় ১৬ কোটি মানুষের দেশে যে কাজগুলো দক্ষতার সঙ্গে করতে পেরেছি, সেটুকু দিয়ে তারা পারবে কিনা- এই প্রশ্ন করা দরকার।’ বাস্তবেই শত সমস্যা-সংকটের মধ্যেও আমাদের অর্জনটা অনেকেই আমরা দেখি না। এটা না দেখলে আরো আরো অর্জন করে বিশ্ব দরবারে আমরা যোগ্য জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াব কীভাবে? লাখ লাখ শহীদের স্বপ্নইবা বাস্তবায়িত হবে কীভাবে?
পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সাফল্যও তিনি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। আগামী দিনগুলোতে বর্তমান ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এই বিশ্ব ও উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে তিনি যে ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতির নীতি-কৌশল অব্যাহত রাখবেন, এমন ইঙ্গিত তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় দিয়েছেন। চীন সফর ইতোমধ্যে স্থির হয়ে গেছে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে অর্জনের দিকটি তিনি সামনে এনেছেন, যা গুরুত্ব সহকারে আলোচনায় আসে না। মেরিটাইম বাউন্ডারি ও ছিটমহল প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেছেন, ‘এসব নিয়ে বহু দেশে যুদ্ধ হয়। কিন্তু আমরা উৎসবমুখর পরিবেশে এসব সমাধান করেছি।’
এ ক্ষেত্রে তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি যা বলেছেন, তা সবচেয়ে আগ্রহোদ্দীপক। বিকল্প নতুন ব্যবস্থা উত্থাপন করে তিনি বলেছেন, ‘পানির জন্য কারো মুখাপেক্ষী হতে হবে না। ডেল্টা প্ল্যান করেছি। পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করলে পানি পানি করে কারো দিকে চেয়ে থাকতে হবে না।’ প্রসঙ্গত, ডেল্টা পরিকল্পনা-২১০০ নিয়ে নির্বাচনী ইশতেহারে অভিযোজন বিবেচনায় নিয়ে ‘পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা’-এর বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছিল।
বিমান ও পর্যটন নিয়ে ভাবনার দিগন্তও যে প্রসারিত, তা তিনি সুস্পষ্ট ও সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরেছেন। জনগণ চায় আইন নিজস্ব গতিতে চলুক; সবার জন্য সমভাবে প্রয়োগ হোক। বিমানে আসা-যাওয়া নিয়ে প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন, তাতে দেশ বিশেষত বিমানের প্রতি গভীর মমত্ববোধ ফুটে উঠেছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রসঙ্গ উঠতেই প্রধানমন্ত্রী দেশে গণতান্ত্রিক ও অগতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিয়ে অনেক কিছুই বলেছেন।
বলাই বাহুল্য, গণতন্ত্র থাকলে তা জনগণের মনোভাব, সচেতনতা ও কর্মকা- দিয়েই সংশোধিত হবে, অগ্রসর হবে। কিন্তু গণতন্ত্র না থাকলে আম ও ছালা দুই-ই যাবে, এটাই তো বাস্তব সত্য। ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ভয় পায়। কোনো কোনো মহলগোষ্ঠী ও ব্যক্তির যে অবৈধ সামরিক শাসন, সামরিক কর্তাদের শাসন ইত্যাদি ভালো লাগে, তা ইতোমধ্যে প্রমাণিত। নতুবা সামরিক কর্তাদের শাসন এলে হালুয়া-রুটির নেশায় মন্ত্রিত্ব বা পদের জন্য লাইন পড়ে কেন? নিরপেক্ষ দাবিদার সুশীল, অবসরপ্রাপ্ত আমলা, বিচারপতি ও পেশাজীবীদের মধ্যে ক্ষমতার বড় পদে বসা বা কিংস পার্টি গড়ার তৎপরতা চলে কীভাবে? এ ক্ষেত্রে দেশবাসী সত্য প্রকাশ প্রত্যাশা করে। সরকারের কাছ থেকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত রাখার গ্যারান্টি চায়।
প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য শুনে ও পড়ে এসব নিয়ে যখন ভাবছিলাম, তখন রাজনৈতিক বন্ধুর উপরিল্লিখিত প্রশ্নটি কেবলই মনকে আলোড়িত করছিল। প্রধানমন্ত্রী এতটা মনে রাখেন কীভাবে? এতটা মনের জোর তিনি পান কীভাবে? প্রশ্ন দুটি নিয়ে নাড়াচাড়া করতেই ভাবনা এলো এর উত্তর রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের ভেতরেই। প্রশ্নোত্তরে তিনি বলেছেন, ‘বাবাও মাথা নত করেননি, আমিও করব না। যা সত্য তা-ই বলে যাব।’
এ থেকে বলা যায়, দেশের অতীত সবসময়েই তিনি মনে রাখেন। পিতার মতোই তার সাহস। শেকড় তার রয়েছে জাতিসত্তার গভীরে প্রোথিত হয়ে। ভুঁইফোঁড় তিনি নন।
‘সুফলটা কি সবাই পাচ্ছে না’, মর্যাদাটা কি বিশ্বে উন্নত হচ্ছে না’ প্রভৃতি মন্তব্য করে তিনি বলেছেন, ‘আমি যা করি দেশের জনগণের কল্যাণে কাজ করি। এই বিশ্বাসটা যদি আমার থাকে, তাহলে কে কোনটা ভালো বলল, মন্দ বলল তা নিয়ে তো আমার মাথা ব্যথার কিছু নেই।’ এ থেকে সুস্পষ্ট বর্তমানে তিনি কোথায় আছেন, কী করছেন, সেটাও তার কাছে সুস্পষ্ট। একই সঙ্গে প্রকাশ পেয়েছে তার দূরদৃষ্টি। সব কথার ভেতর দিয়ে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের একটা চিত্র তিনি সুন্দরভাবে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেছেন।
বলাই বাহুল্য, দেশনেতা হিসেবে সমস্যা-সংকট, বাধাবিপত্তি, কঠিনতা-জটিলতা সত্ত্বেও অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে ঊর্ধ্বমুখী সমতলে একই দৃষ্টিতে যিনি নিয়ে আসতে পারেন, তিনি সবটা মনে রাখতে কিংবা সবটা বাস্তবায়ন করতে কনফিডেন্স পাবেন না কেন!
লেখক : রাজনীতিক।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন