নুসরাত হত্যার সাথে সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে যৌন নির্যাতন নিয়ে যখন সবাই সোচ্চার। সব অনিয়ম অপরাধ দুর্নীতি অবিচার জালিয়াতি গুম খুন ছাপিয়ে আমরা এখন কেবলই ধর্ষকদের পিছনে ধাবমান। পরবর্তী লোমহর্ষক ঘটনা না ঘটা পর্যন্ত যখন সেটাই যখন রেওয়াজ তখন সফরে আসা ভুটানের প্রধানমন্ত্রী অন্য এক নির্যাতনের কথা বলে গেলেন। মানুষ হওয়ার উপদেশ দেয়ার ছলে তিনি যেন অভিযোগ লিপিবদ্ধ করলেন। দুই দশকের পুরাতন অভিযোগ হয়তো আইনের চোখে তামাদি হয়ে গেছে কিন্তু অভিযোগটি গুরুতর। যাদের আমলে নেয়ার দায় ক্ষমতা ইচ্ছা বা ফুরসত আছে তাঁরা বিষয়টি আমলে নেয়ার দায়িত্ব কি এড়াতে পারবেন? তিনি সকল নির্যাতনের সূতিকাগার (ইংরাজিতে যাকে বলে মাদার অব অল এবিউজ) সেই ‘অবহেলা আর অন্যায় আচরণের’ কথা বলেছেন। বলেছেন নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতার সুত্র ধরে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনেক হর্তাকর্তাদের হাড়ের মজ্জায় ঢুকে যাওয়া অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণের বলি হচ্ছে নিরীহ ছাত্রছাত্রীরা। কেউ এসব আচরণের কারনে অঘোরে প্রান হারাচ্ছেন। কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। ভুটানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কপাল ভাল (নাকি ভুটানের মানুষের ভাগ্য ভাল) তিনি এমন এক অবহেলার শিকার হয়েও মৃত্যুর গুহা থেকে ফিরে আসতে পেরেছিলেন। কিন্তু পারেনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র নুরুজ্জামান। এই দুঃখজনক অকালমৃত্যুর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা না থাকা এবং অবহেলাকে দায়ি করে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করছে শিক্ষার্থীরা। শনিবার রাতে ইংরেজি বিভাগের ৪৫তম আবর্তনের ছাত্র নুরুজ্জামান নিভৃত (২২) হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব অবহেলার কোন ছাপ যেহেতু সরাসরি শরীরে ফুটে ওঠে না তাই এসব নিয়ে অভিযোগ দূরে থাক ছোট খাটো টুঁ শব্দও কেউ করে না। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন ছাত্র লোটে শেরিং সে সাহস আর সুযোগ পেয়েছিলেন— তাঁকে ধন্যবাদ সুযোগটা নেয়ার জন্য । এইজন্যই তিনি আলাদা একজন মানুষ, ঝাঁকের কৈ তিনি নন।
ভেবেছিলাম আর দশটা পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের মতো ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর ময়মনসিংহ ভ্রমণ ঝাকানাকা আর মউজ-মাস্তিতে শেষ হবে। বক্তৃতায় গুণগান করবেন তাঁর সাবেক বিদ্যাপীঠে শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারীদের। দান ধ্যান করবেন যেমন করেন মন্ত্রী মহাজনরা। চিকেন কাচ্চি ইম্প্রুফড ডায়েটের রগরগে সেকাল–একালের আলোচনার পর হাততালি শুনতে শুনতে আর ঢেঁকুর তুলতে তুলতে বিদায় নেবান। ছোটবেলায় যেমন ছড়া কাটতাম ‘রাজা যায় হেলতে দুলতে/পানের পিক ফেলতে ফেলতে’।
এসব ছিল কিনা জানিনা কিন্তু টিভিতে হটাৎ শোনা তার কথোপকথন আমাদের অনেকেই চমকিয়ে দিয়েছে। তিনি পান না খেয়েও রক্তের পিক ফেলেছেন আমাদের আপাত সাদা কাপড়ে। এটা “ঝিঙ্গা ফুলের সাঁঝেতে, পেয়ে পথের মাঁঝেতে” দেয়া কোন ভালবাসার কাদা নয় রীতিমতো রক্ত। সে রক্তের দাগ দেখার চোখ আমরা অনেক আগেই খুইয়ে বসেছি। তাই মনে দাগ কাটবে কি হয়তো নজরেই পড়েনি অনেকের। কথাপকথনে সরলতা থাকলেও তিনি যে মনের গভিরে একটা দগদগে ঘা নিয়ে ফিরছেন সেটা আড়াল করতে পারেননি। হয়তো আড়াল করতে চাননি। অবহেলা আর কষ্টের কথা বলে মনটা হালকা করতে চেয়েছেন।
তখন তিনি ৪র্থ বর্ষের ছাত্র। বিদেশি ছাত্র কয়জন আর থাকে একটা মফস্বলের মেডিক্যাল কলেজে। না চেনার কোনো কারণ নেই (চিন্তেই বা হবে কেন)। তাছাড়া পড়াশোনায় ভালো জানার আগ্রহ অনেক এমন ছাত্রকে সাবারই চোখে চোখে রাখার কথা। প্রচণ্ড পেটের ব্যাথা নিয়ে তাঁকে তাঁর প্রিয় কলেজের চিকিৎসকের ডাকের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। রোগীর কথা সবটা না শুনেই লিখে দেন ওষুধ। বাথ্যায় কাতরাতে কাতরাতে আর বমি করতে করতে মালয়েশিয়ান শিক্ষার্থী বন্ধুকে নিয়ে পরদিন আবার আসেন সেই চিকিৎসকের কাছে। চিকিৎসক বলেন তুমিতো দেখছি নাছর বান্দা! বুঝেছি পড়াশোনা ভালো লাগছে না, রেস্ট চাও? এইযে লিখে দিলাম স্টুডেন্ট বেডে গিয়ে ভর্তি হয়ে যাও! বেচারা লোটে লোটাকম্বল নিয়ে ভর্তি হয়ে গেলেন। দিন যায় রাত যায় ব্যাথা আর কমে না। শুকনা বসে যাওয়া চোখ মুখ শক্ত পেট এসব নানা আলামত দেখে হঠাৎ এক সার্জেন চিৎকার করে ওঠে, এতো এপেনডিক্সের রোগী এখানে এভাবে ফেলে রাখেছে কেন। এখনই অপারেশন না করলেই না। শেষ পর্যন্ত অপেরশন হয়, ততক্ষণে সংক্রমিত (ইনফেকটেড) এপেনডিক্স ফেটে গেছে, কপালের জোরে আর সার্জেনের হাতজশের গুনে তিনি বেঁচে যান।
কিন্তু সবার ভাগ্য এতো ভাল থাকে না। যেমন তৃতীয় বর্ষ পার করা সামিয়া ইসলামকে শেষ পর্যন্ত বাঁচানো সম্ভব হয়নি। একই রকম অবহেলায় ২০০৯ সালে উত্তরের এক সরকারি মেডিক্যাল কলেজের এই ছাত্রী মারা যান। তিনি যতই তার অসুস্থ্যতার কথা বলেছেন কতৃপক্ষ ততই সেটাকে ক্লাস ফাঁকি দেয়া আর পরীক্ষা এড়ানোর অজুহাত বলে মনে করেছেন। চিকিৎসা দেননি। একই মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষকদের অবহেলা আর গঞ্জনা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় মিরেরসরাই থেকে পড়তে আসা মধুসুধন। তাঁর কোন স্বাস্থ্যগত সমস্যা ছিল না। খুবই লাজুক এই শিক্ষার্থী কথা বলতে গিয়ে জিভে সেটা জড়িয়ে যেতো আমরা যাকে তোতলামি বলে চিহ্নিত করে থাকি। গরিব বাবা মার–একমাত্র সন্তান মধুসুধনের তোতলামি নিয়ে শিক্ষকদের হাসি ঠাট্টা আর তাদের দেখাদেখি সহপাঠিদের নিষ্ঠুরতা ক্রমশ বাড়তে থাকে।
তিনি সিধান্ত নেন বাড়ি ফিরে যাবেন। বাবাকে চিঠি লেখেন সব জানিয়ে। বাবা ছুটে এসে অধ্যক্ষের সাথে দেখা করেন। ফল হয় উল্টো, বেড়ে যায় মানসিক নির্যাতনের মাত্রা। আত্মহত্যা করে বসেন মধু। মধু বা সামিয়ার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কোনো সুযোগ নেই বা ছিল না। তাঁদের কাহিনী কেউ কোনোদিন বলবে না। লোটে মধু সামিয়া কিন্তু কোন হটাৎ ঘটে যাওয়া বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। ধারাবাহিকভাবে এসব ঘটছে আমাদের নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। ঝরে যাচ্ছে অমুল্য প্রান কিংবা দগদগে মানসিক ক্ষতের বোঝা নিয়ে থেকে যাচ্ছে সমাজে। মেনে নিচ্ছে সব অন্যায়। লোটের অভিযোগ আমলে নিয়ে দাগি বা ডাইন অথবা ডাইনি ধরার কাজ শুরু করার দরকার নাই। দরকার একটা ব্যাবস্থা গড়ে তোলা যেখানে অবহেলা অন্যায্য আচরণকে পাপ বলে গণ্য করা হবে। লোটে ঘটনাক্রমে বেঁচে যাবেন, কিন্তু বাঁচবে না মর্যাদার সাথে চিকিৎসা আর স্বাস্থ্যের অধিকার নিয়ে। সামিয়া মরবে না তার নিজের প্রতিষ্ঠানে অবহেলার ট্রলিতে আর মধুসুধন খাবে না মাত্রারিক্ত ঘুমের বড়ি ।
গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন