পীর হাবিবুর রহমান
আমাদের বাড়ির সবার ছোট সংসদের বিরোধীদলীয় হুইপ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য এমপি পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ সোমবার ভোররাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। হার্ট অ্যাটাকের পেইনে কাহিল মিসবাহকে ধানমন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে ভোররাতেই ঘুম থেকে জেগে কার্ডিওলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. মাহবুবুর রহমান তার সহকর্মীদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়ে ক্যাথল্যাব প্রস্তুত করান। সাতসকালে সস্ত্রীক ডা. দম্পতি মাহবুব হাসপাতালে ছুটে এসেই অপারেশন থিয়েটারে ঢোকেন। সেখানে তার এনজিওগ্রাম করে ডান দিকের রক্তনালিতে চিহ্নিত হওয়া ব্লক অপসারণ করে একটি রিং পরান। তার অসুস্থতার সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে দেশ-বিদেশ থেকে অসংখ্য স্বজন দিনভর টেলিফোন করেন। অনেকে হাসপাতালে ছুটে আসেন। তার নির্বাচনী এলাকা সুনামগঞ্জ সদর ও বিশ্বম্ভরপুরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষ মসজিদে মসজিদে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করে। সিসিইউতে চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকায় বেশির ভাগ দর্শনার্থীকে তার কাছে যেতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু মানুষের এ স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসা ও দোয়া পরম করুণাময় আল্লাহর অশেষ রহমত ছাড়া আর কিছু নয়।
দুই দফা সংসদে বাগ্মিতায়, আচার-ব্যবহারে এবং নির্লোভ, নিরহংকারী, নিরাবরণ, সাদামাটা জীবনের চারিত্রিক গুণাবলির কারণে মিসবাহ দলমতনির্বিশেষে সবার স্নেহ কুড়াতে সক্ষম হয়েছে। তাকে যখন হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছিল, তখন বুকে ও হাতে প্রচ- পেইন। হাসপাতালে নেওয়ার পর স্ট্রেচারে করে তাকে ইমারজেন্সিতে নিতে হয়েছে। হুইল চেয়ারে বসতেও পারেনি। এখন তার অবস্থা স্বাভাবিক। আল্লাহর অশেষ রহমত ও মানুষের অন্তঃহীন ভালোবাসা ও দোয়ায় এ নিয়ে দ্বিতীয় দফা যেন মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছে। এর জন্য আল্লাহতায়ালার কাছে যেমন শুকরিয়ার শেষ নেই তেমনি মানুষের আন্তরিকতা ও ভালোবাসার কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। ডা. মাহবুবুর রহমান ও তার সহকর্মীদের প্রতিও রয়েছে কৃতজ্ঞতাবোধ। একজন চিকিৎসক জীবন বাঁচানোর জন্য লড়াই করেন, জীবন হরণের জন্য নয়।
আমার বড় ভাই অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান পীর কিছুদিন আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হৃদয়ে দুটি রিং পরিয়েছেন। আমার হৃদয় ইতিমধ্যে তিনটি রিংয়ে মেরামত করা হয়েছে। সাতবার এনজিওগ্রাম করিয়েছি। আট ভাই-বোনের মধ্যে দুই বোন দুই ভাই অকালে চলে গেছেন। তিন ভাই এক বোন বেঁচে আছি। তিন ভাই পেশাগত জীবনে দেশ ও মানুষের কল্যাণে যার যার জায়গা থেকে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করছি। কখনো-সখনো জীবন বেদনাভরা নিঃসঙ্গ বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়লেও বেঁচে যে আছি এটাই অনেক বড় রহস্য। আল্লাহর নেয়ামত।
ব্যক্তিগত বা পারিবারিক বিষয় নিয়ে লেখা মূল লক্ষ্য নয়, লেখার মূল লক্ষ্য রাষ্ট্র ও সমাজকে নিয়ে। ব্যক্তিগতভাবে আমি ঢাকায়ই নয়, দিল্লি, লন্ডন ও নিউইয়র্কের প্রখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদেরও শরণাপন্ন হয়েছি। সব বিশেষজ্ঞই প্রেসক্রিপশনে ওষুধের পাশাপাশি নিয়মিত হাঁটা-খাদ্যাভ্যাসসহ লাইফ স্টাইলের যেসব দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তার মধ্যে সবার আগে বলেছেন, দুশ্চিন্তামুক্ত জীবন। এক কথায়, স্ট্রেস নেওয়া যাবে না। নির্বাচিত একনায়কদের কবলে পতিত গোটা বিশ্ব যেখানে অশান্ত-অস্থির সেখানে চিন্তাশীল মানুষই নয়, সাধারণ মানুষের হৃদয়-মনেও তার নেতিবাচক প্রভাব যেখানে পড়ছে, সেখানে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের সীমানায় আমরা নিজেদের অনুশীলনে রাখতে পারি না।
রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতির ঘটনাবহুল ঘটনা আমাদের তাড়িত করে। একদা যে পৃথিবী বর্ণবাদের হিংসাত্মক আগ্রাসনে অভিশপ্ত হয়েছিল সেই পৃথিবী আজ ধর্মের নামে সন্ত্রাসবাদের প্রতিহিংসার পথ দুনিয়াকে ভীতসন্ত্রস্তই করেনি, মানুষকে নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। নিউজিল্যান্ডের মতো মানবিক শান্তির দেশে খ্রিস্টান জঙ্গির গুলিতে নামাজরত মুসলমানদের প্রাণহানি ও রক্তঝরার ঘটনা বিমর্ষ ও ব্যথিত করেছে। তাই বলে বর্ণবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সুদর্শন ডিম বালকের মানবিকতাও প্রতিবাদের মূর্তপ্রতীক হয়ে ওঠে।
মুসলিমবিদ্বেষী অস্ট্রেলিয়ান এমপির মাথায় ডিম ফাটিয়ে পৃথিবীতে তিনি আজ আলোচিত। এমনকি তার মামলার জন্য সংগৃহীত হাজার হাজার ডলার সেই জঙ্গির হামলায় নিহতদের পরিবার-পরিজনকে দান করার ঘোষণা দিয়েছেন। কোথাও জিহাদের নামে বা ইসলামের নামে যেমন সন্ত্রাসবাদ ভয়ঙ্কর মূর্তি ধারণ করে রক্ত ঝরায়, মানুষ, সভ্যতা ও ঐতিহ্যের ওপর আঘাত হানে, সেখানে কোথাও বা মানুষের জীবনের চেয়ে ধর্মান্ধ উগ্রগোষ্ঠীর বর্বরতাই বড় হয়ে দেখা দেয়। কোথাও ইহুদিরা সন্ত্রাসের আগ্রাসনে জ্বলে ওঠে। কোথাও বা উগ্রপন্থি হিন্দুত্ববাদের কাছে মানুষের জীবনের চেয়ে গোমূত্রের মূল্য বেশি হয়ে ওঠে। কোথাও বা অহিংস ধর্মের লালিত বাণী নির্বাসনে পাঠিয়ে রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করা হয়। অর্থাৎ ধর্মান্ধ শক্তির বিষের বাতাসে রাষ্ট্র ও সমাজকে অশান্ত-অস্থির করে রেখেছে। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্দা অরডার্ন ক্রাইস্টচার্চে মসজিদের নৃশংস হত্যাকা-কে সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, এটি তার দেশের একটি অন্ধকার দিন। হামলাকারী অস্ট্রেলিয়ান বংশোদ্ভূত ব্রেন্টন ট্যারান্ট কী নৃশংসভাবে ঠাণ্ডা মাথায় মসজিদে হামলা চালিয়ে একের পর এক গুলি করে জুমার নামাজে আসা নিরীহ মুসলমানদের হত্যা করেছেন, তার ১৭ মিনিটের লাইভ ভিডিওতে দেখা গেছে। মাথায় কালো ওড়না পরে মানবতার পাশে দাঁড়ানো নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বিশ্ববাসীর হৃদয় জয় করলেও দুনিয়া দেখেছে অস্ট্রেলিয়ার চাপ উপেক্ষা করেও কোনো সামরিক জোটে না যাওয়া যে দেশটি শান্তির আবাসভূমি হিসেবে থাকতে চেয়েছে, সন্ত্রাস সেই দেশটিকেও রক্তাক্ত করেছে। পৃথিবীতে শান্তির নিরাপদ আবাসভূমি বলে আর কোনো স্থান থাকল না। জীবনের নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে অস্থির-অশান্ত পৃথিবীতে যেখানে মানুষের বাস, মৃত্যুর সঙ্গে পায়ে পায়ে হাঁটে যে মানবজাতি, তার জীবন আর যাই হোক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারে না।
শুক্রবার দুপুর মানেই জুমার নামাজ ঘিরে মুসলমানদের ইবাদতের এক পবিত্র শুদ্ধতা, সেখানে রাত নামলেই পশ্চিমা দুনিয়ায় মানুষের আনন্দ উৎসবের যাত্রা। পশ্চিমে সপ্তাহের ছুটির দুই রাত আনন্দে ভাসে মানুষ। সব ক্লান্তি-অবসাদ দূর করে টানা পাঁচ দিনের খাটাখাটনির পর নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চও তার ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু সেই রাতে ক্রাইস্টচার্চের জন্য অভিশপ্ত, ভুতুড়ে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল। একজন দক্ষিণপন্থি, উগ্রপন্থি অস্ট্রেলিয়ান বংশোদ্ভূত খুনির গুলিতে অনেকের প্রাণহানি ঘটলেও মাত্র মিনিট কয়েক ব্যবধানের কারণে আমাদের ক্রিকেট দলের সোনার সন্তানরা অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছেন, এটাই যেন আমাদের পরম প্রাপ্তি।
বাঙালি জাতির মহত্তম নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৯তম জন্মবাষির্কী ১৭ মার্চ উদ্যাপিত হয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানেই আমাদের স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানেই বাংলাদেশ। তিনি তাঁর জীবন-যৌবন উৎসর্গ করা অমিত সাহসী ও তেজোদীপ্ত ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বের মহিমায় দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের ভিতর দিয়ে গোটা জাতিকে এক মোহনায় মিলিত করেছিলেন। জনগণের নির্বাচিত একমাত্র নেতায় অভিষিক্ত হয়েছিলেন। তাঁর ডাকে স্বাধীনতা ও মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতি বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের বিজয় অর্জন করেছিল। সেই যুদ্ধে এই মহান নেতাকে পাকিস্তানের অন্ধকার কারাগারে দুঃসহ যন্ত্রণায় কাটাতে হয়েছে বন্দীজীবন। তবু তিনিই ছিলেন রণাঙ্গনে গণযুদ্ধের সব প্রেরণার উৎস। তিনিই ছিলেন নেতা। সেই যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ ধর্মবর্ণনির্বিশেষে জীবন দিয়েছিলেন। সেই যুদ্ধে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হাতে আমাদের আড়াই লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন। আমাদের জনগণ হারিয়েছিল সম্পদ ও ঘরবাড়ি। সেই যুদ্ধের বীরত্ব, গৌরব ও বিজয়ের আনন্দের পাশাপাশি গভীর বেদনাও বাস করে আমাদের হৃদয়ে। তেমনি যে মহান নেতার জন্ম না হলে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা মুক্ত হতো না, সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন এলেও আনন্দের পাশাপাশি গভীর ক্রন্দন ও বেদনা আমাদের হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করে রাখে। কারণ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে মানবসভ্যতার ইতিহাসে ঘটে যাওয়া কলঙ্কতম বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের পথে এ দেশের বিশ্বাসঘাতক সন্তানরা তাকে হত্যা করেছিল। আমাদের জীবন ও ইতিহাস থেকে সেই কলঙ্কিত কালরাত কখনো মুছে যাওয়ার নয়।
আগামী বছর জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী বছরজুড়ে উদ্যাপন হবে। উৎসবের আনন্দে গোটা দেশ ইতিহাসের মাহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষীই হবে না, অংশীদার হবে। ইতিমধ্যে জন্মশতবার্ষিকী ঘিরে উদ্যাপন পরিষদও গঠিত হয়েছে। মন্ত্রী ও আমলানির্ভর সেই কমিটি আমাকে আকর্ষণ করতে পারেনি। আমাদের আশা ছিল, স্বাধীনতাবিরোধী, মুজিববিদ্বেষী ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব রাজনৈতিক দলের এবং সমাজের সব শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিত্বের ব্যাপক অংশগ্রহণ উদ্যাপন পরিষদে যুক্ত করা হবে। কিন্তু কমিটি সেই শোভাবর্ধন করতে পারেনি। মনে হচ্ছে, যেন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে গোটা দেশের জনগণের উৎসবের মহাজাগরণ না ঘটিয়ে প্রশাসননির্ভর কর্মকান্ডের মধ্যে কিছু কর্মকান্ডে জন্মশতবার্ষিকীর আয়োজন হতে যাচ্ছে।
ষাটের দশকের শুরুতে জন্মের পর বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে উঠে আসা মহান নেতা শেখ মুজিবের নাম আমরা শুনেছিলাম। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পূর্ব বাংলায় আমাদের শৈশবে তিনি নায়কের আসন নিয়েছিলেন। আমাদের দুরন্ত কৈশোরে তিনিই ছিলেন বিশ্বনন্দিত এক জীবন্ত কিংবদন্তি। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর ঘোর অন্ধকার সময়ে তার আদর্শিক রাজনীতির কঠিন দুঃসময়ে ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে আমাদের কৈশোর ও তারুণ্য তার নামে পথে পথে মিছিলে মিছিলে সংগঠন শক্তিশালীকরণে অনবদ্য ভূমিকা রাখতে উৎসর্গ হয়েছিল। আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকালে অবাক বিস্ময়ে দেখি সমাজের সব শ্রেণি-পেশা, প্রশাসন সবখানে সবাই আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগ। দেশে যেন এখন আর আওয়ামী লীগ ছাড়া কেউ নেই।
’৭৫-এর পর সেই অন্ধকার সময়ে সামরিক শাসকরাই বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা, ইতিহাস মুছে দিতে চায়নি, সেদিন শুধু সামরিক শাসক আর ’৭১-এ পরাজিত দক্ষিণপন্থি শক্তি মহান বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ প্রচারে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের উগ্রপন্থি অতিবিপ্লবীরাও পথ আগলে দাঁড়িয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মীদের চতুর্মুখী ব্যারিকেড ভেঙে ঘুরে দাঁড়াতে হয়েছে। লড়াই করতে হয়েছে। সেসব মুজিববিদ্বেষী, আওয়ামী লীগবিদ্বেষী এবং বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির আদর্শিক কর্মকাণ্ডের ওপর আঘাত হানা অনেক শক্তি গত ১০ বছরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের করুণাশ্রিত ক্ষমতার দাসে পরিণত হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে এটি শেখ হাসিনার রাজনীতির এক বড় অর্জন। রাজনৈতিকভাবে, সাংগঠনিকভাবে দেউলিয়া এসব অতি প্রগতিশীল, অতি বাম বা উগ্রপন্থি বিপ্লবীরা এখন সবচেয়ে বেশি মুজিববন্দনাই নয়, শেখ হাসিনার গুণকীর্তন করে পিঠ বাঁচাতে আওয়ামী লীগের আশ্রয়ে থাকে। অথচ ’৭৫-এর পর বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সংগঠন ছাত্রলীগের ওপর সামরিক শাসকদের গুণ্ডাপাণ্ডাদের চেয়ে, লাঠিয়াল পুলিশবাহিনীর চেয়ে ওদের সশস্ত্র ক্যাডাররা কম আক্রমণ করেনি। বঙ্গবন্ধু বললে তাদের গায়ের চামড়া জ্বলে উঠত। সেই সময় স্বাধীনতাবিরোধী দালালদের সন্তানরাও সেসব অতিপ্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনে আশ্রয় নিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ বিজয়ী হয়ে অভিষেক অনুষ্ঠানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম কৃতজ্ঞতার সঙ্গে উচ্চারণ করলে সেই অভিষেক প- করে দিত। সেসব বঙ্গবন্ধু ও সেকালের আওয়ামী লীগবিদ্বেষী শক্তির অনেকের নাম বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর উদ্যাপন পরিষদে দেখা গেলেও সেই অন্ধকার সময়ে পিতৃহত্যার প্রতিবাদে যারা সাহসী ও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাদের নাম খুঁজে পাওয়া যায় না। ’৮১ সালে আওয়ামী লীগের ইডেন কাউন্সিলে দলের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে সভানেত্রী নির্বাচিত হয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্রের বাতিঘর হয়ে দেশে ফিরেছিলেন। পিদিমের আলোর মতো সেই ঘোর অন্ধকার সময়ে বঙ্গবন্ধুর সংগঠিত আদর্শিক নেতা-কর্মীদের ওপর দাঁড়িয়ে দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে বঙ্গবন্ধুর পর দ্বিতীয় দফা জনপ্রিয় ও শক্তিশালী রাজনৈতিক দলে পরিণত করেছিলেন। টানা ২১ বছরের সংগ্রাম শেষে দলকে প্রথমবার ক্ষমতায় এনে পিতৃহত্যার বিচার শুরু করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের দম্ভকে কবর দিয়ে খুনিদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন। ’৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের আওতায় এনে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ দমনই করেননি, একুশের গ্রেনেড হামলার মতো তার ওপর আক্রমণ করা নৃশংসতারও বিচার সম্পন্ন করেছেন। অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশকে পৃথিবীর কাছে বিস্ময়কর উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।
দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে মুজিবকন্যার হাত ধরে উঠেছে। কিন্তু নিঃশঙ্কচিত্তে এটা বলা যায় যে, যে গণতন্ত্রের জন্য জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন সংগ্রাম করেছেন, যে গণতন্ত্রের জন্য আমাদের পূর্বসূরিরা নিরন্তর লড়াই করেছেন, যে গণতন্ত্রের জন্য আমাদের তারুণ্য উৎসর্গ করেছিলাম, যে গণতন্ত্রের জন্য ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে অসংখ্য সাহসী সন্তান শহীদের জীবন বরণ করেছেন; এমনকি যে গণতন্ত্রের জন্য বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তার জীবনের দীর্ঘ সময় বার বার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও সাহসিকতার সঙ্গে আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন; সেই গণতন্ত্র আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে, সমাজজীবনে সোনার হরিণ হয়ে দেখা দিয়েছে। সেই গণতন্ত্র আমরা আর ফিরে পাইনি। এই না পাওয়ার জন্য কোনো নির্দিষ্ট দল বা ব্যক্তি দায়ী না হলেও যেসব রাজনৈতিক নেতৃত্বের বা যেসব রাজনৈতিক দলের ডাকে বার বার রাজপথ উত্তাল হয়েছে, বার বার পল্টনে গণজাগরণ ঘটেছে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তৃণমূল জনপদে অগ্নিঝরা আন্দোলন ছড়িয়েছে সেসব নেতা ও রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক দলগুলো কখনো দায় এড়াতে পারে না। মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে- জনগণের অপরাধটা কোথায়? আমাদের পূর্বসূরিদের অপরাধটা কোথায়? যেসব শহীদ ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে গণতন্ত্রের সংগ্রামে জীবন দিয়েছেন, তাদের অপরাধটা কোথায়?
দেশজুড়ে আজ খাবারে বিষ, রাজনীতিতে ফরমালিন নিরাপত্তাহীন সড়ক ও সমাজ। গণতন্ত্রের নামে গণতন্ত্রহীনতার সংস্কৃতি গোটা সমাজকে প্রাণহীন করে রেখেছে। সুবিধাবাদী সুযোগসন্ধানী মতলববাজরা ক্ষমতাসীনদের করুণাশ্রিত হয়ে অর্থ-বিত্ত-বৈভব, ভোগবিলাসের আসমানি চাঁদ হাতে পেলেও গণতন্ত্রকামী মানুষ গণতন্ত্রের সোনার হরিণ কখনো ফিরে পায়নি। বুক ভরে তাই শ্বাস প্রশ্বাস নিতে পারে না।
নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দলই প্রশ্ন তোলেনি, টিআইবি অভিযোগ আনেনি, নির্বাচন কমিশনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার থেকে নির্বাচন কমিশন সচিব হয়ে এবার মন্ত্রিত্ব না পাওয়া ১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেননের বক্তব্যেও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এমনকি মনে সংশয় জাগে যেখানে জনগণ শেখ হাসিনাকেই ক্ষমতায় দেখতে চেয়েছে সেই মুজিবকন্যা শেখ হাসিনাও কি একাদশ সংসদ নির্বাচনে এমন ফলাফল আশা করেছিলেন? তাহলে কি অদৃশ্য কোনো শক্তি বা দৃশ্যমান শক্তি ওভারটার্ম করেছে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ভঙ্গুর করে দিতে? উপজেলা নির্বাচন হচ্ছে একতরফা। সরকারি দলের প্রার্থীর সঙ্গে বিদ্রোহী প্রার্থীর লড়াই। এটা দল না রাজনীতি কার উপকার বয়ে আনছে?
সংসদীয় গণতন্ত্র বাইসাইকেলের মতো সরকারি ও বিরোধী দল দুই চাকানির্ভর হলেও এক চাকানির্ভর হয়ে আজ চলছে। শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তার ওপর ভর করে ক্ষমতায় আসা নৌকাই লাঙ্গল, লাঙ্গলই নৌকা। আর অন্য শরিকরা নৌকায় চড়ে সংসদে এসে বিরোধী দলে বসেছেন। শাসক দলের অংশ হয়ে নির্বাচিত হয়ে বিরোধী দলের আসনে বসা এমন ইতিহাস নজিরবিহীন। মানুষের চোখে তাই শক্তিশালী সরকার দৃশ্যমান হলেও কার্যকর বিরোধী দল এখন অস্তিত্বহীন। আওয়ামী লীগ নামের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল যার পরতে পরতে সংগ্রামের চিহ্ন, যার নেতা-কর্মীদের পিঠে হয় পুলিশের আঘাত, নয় প্রতিপক্ষের আক্রমণের ক্ষতচিহ্ন এবং জেলখাটা অতীত। যে দলের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রের সংগ্রামে নেতৃত্বদানের গৌরব রয়েছে, আত্মত্যাগের অহংকার রয়েছে; সেই দল আজ আকারে আয়তনে অনেক বড়ই হয়নি, সুযোগসন্ধানী সুবিধাবাদীদের অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছে। ’৭৫-এর পর যেভাবে আওয়ামী লীগ খুঁজে পাওয়া যায়নি, গত ১০ বছরে ঠিক তেমনি সবখানে আওয়ামী লীগ ছাড়া কিছু খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দলের জন্য এটা গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার বিষয়ই নয়, বিপদসংকেতও বহন করছে। কখনো ক্ষমতার বাইরে গেলে আজকে চারদিকে যেভাবে মৌমাছির মতো আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগ দেখা যায়, সেভাবে আদৌ দেখা যাবে কিনা এ বিচার-বিশ্লেষণ থেকে দলকে সুসংগঠিত করে কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামোর ওপর ঢেলে সাজানোর সময় দরজায় কড়া নাড়ছে।
যুগে যুগে আওয়ামী লীগে দুঃসময়ের ভূমিকা রাখা নেতা-কর্মীরা উপেক্ষিত হয়েছে। যখনই ক্ষমতা হারিয়েছে তখনই দলকেই তার চড়া মাশুল দিতে হয়েছে। সেটি ’৭৫-এর পরই হোক আর ২০০১ সালের নির্বাচনের পরই হোক। যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এক চাকার কর্তৃত্বনির্ভর, যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি ক্ষমতাশীলনির্ভর সেখানে রাজনীতির বদলে রাজদুর্নীতির বিকাশ ঘটে। আর এ পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার সন্ত্রাসবাদ জঙ্গিবাদ মাদকের পর দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধ কতটা সফল হবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঁকি দেয়। সুবিধাবাদী সুযোগসন্ধানীদের আস্ফালন, দম্ভ ও উন্নাসিকতা এতই বেড়ে যায় যে, শাসক দলকেই প্রাণহীন জনবিচ্ছিন্ন করে না, রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ভঙ্গুর করে দেয়। গণতন্ত্রের যত দুর্বলতাই থাকুক এ দেশের জনগণের কাছে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাই উত্তম। রাজনীতিবিদদের হাতেই দেশের নেতৃত্ব নিরাপদ। সেখানে রাজনীতিতে রক্ত সঞ্চালন শক্তিশালী সরকারের পাশাপাশি শক্তিশালী বিরোধী দলের উপস্থিতি মানুষের পরম চাওয়া। আর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সব দলের অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, কার্যকর সংসদ, মানুষের রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ এবং কথা বলার স্বাধীনতা অনিবার্য।
গোটা সমাজব্যবস্থায় একটা গুমোট হাওয়া রাজনীতিকেই প্রাণহীন করে রাখেনি, গণমাধ্যমকেও গরম নিঃশ্বাসের ওপর রেখেছে। কখনো-সখনো অদৃশ্য শক্তির অতি উৎসাহী ক্ষমতার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার যে হাত প্রসারিত করে তা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারিত্ব বহন করা রাজনীতি গণমাধ্যম ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর। তাই মাঝে মাঝে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে মনে হয়, আমাদের অপরাধ কোথায়? এর উত্তর জানতে। গোটা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় শক্তিশালী সরকার দেখা গেলেও কার্যকর বিরোধী দল কেন নেই? বিরোধী দলের সন্ধান দিন। এ মর্মে মানুষের হৃদয় যেন বাড়ি পালানো বা হারিয়ে যাওয়া নিখোঁজ সন্তানের জন্য বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। ২৮ বছর পর ডাকসু নির্বাচন হলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যর্থতার কারণে সেটিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তবু ছাত্রীরা বীরত্ব দেখিয়ে তাদের হলে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা নুরুল হক নুর ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী মাতৃসুলভ হৃদয় দিয়ে তাদের গণভবনে চা-চক্রে মিলিত করেছেন। যারা নুরকে দিনের পর দিন বিতর্কিত করার চেষ্টা করেছেন, সেখানে নুর তার চমৎকার বক্তব্যে পরিষ্কার করেছেন। তার রাজনীতির অতীত ছিল ছাত্রলীগের। তাকে অভিনন্দন জানিয়ে পরাজিত ভিপি প্রার্থী ও ছাত্রলীগ সভাপতি শোভন গণতন্ত্রের শোভা বাড়িয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের হঠকারী পথ না নিয়ে নির্বাচিত ভিপি নুরের উচিত তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করা। ডাকসুর যে পুনর্জন্ম ঘটেছে সেটিকে লালন, পরিচর্যা ও বিকশিত করার মাধ্যমে নেতৃত্ব সুসংহত করে সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন আদায় করে ছাত্ররাজনীতির বন্ধ্যত্ব কাটিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব তৈরির পথ সুগম করা। কারও ফাঁদে পা না দিয়ে বাস্তবতার নিরিখে নিজের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেওয়াই নুরের এখন চ্যালেঞ্জ।
এদিকে মঙ্গলবার সকাল আসতে না আসতে ঢাকায় আবার প্রগতি সরণিতে বেপরোয়া বাসচাপায় সড়ক হত্যার শিকার হয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবরার। ছাত্ররা আবার বিক্ষোভে রাস্তায় নেমেছে। সেই স্লোগান তুলেছে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। গেল বছর ২৯ জুলাই বেপরোয়া জাবালে নূরে চাপা পড়ে দুই ছাত্রছাত্রীর করুণ মৃত্যুতে গোটা দেশ কাঁপিয়ে দিয়েছিল বিক্ষোভে উত্তাল শিক্ষার্থীরা। নিরাপদ সড়কের দাবিতে তাদের সেই তীব্র আন্দোলন রাষ্ট্রকে জাগিয়েছিল। অনেক সিদ্ধান্ত হলো। কিন্তু আমরা কি বলতে পারব রাস্তা নিরাপদ করতে পেরেছি? লাইসেন্সবিহীন চালক, ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিষিদ্ধ করতে পেরেছি? মনিটরিং ও ব্যবস্থা গ্রহণ জোরদার করতে পেরেছি। নিহত আবরারও ছিল নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের কর্মী। নিরাপদ সড়ক দিতে পারেননি বলে জীবন দিতে হয়েছে তাকে। উত্তরের মেয়র বলেছেন, তার নামে ফুটওভার ব্রিজ দেবেন। নিরাপদ সড়ক ও বসবাস উপযোগী ঢাকা দিন মেয়রগণ। না হয় ফুঁসবে দেশ। মানুষের ক্ষোভের আগুনে পুড়বেন আপনারা।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন