ফাগুন শুধু প্রকৃতি, তরুণ-তরুণীদের হৃদয়েই আগুন জ্বালায় না, ফাগুন অগ্নিকাণ্ডেরও মাস। এবার ফাগুনের দ্বিতীয় দিনেই লেগেছে সবচেয়ে ভয়াবহ আগুন। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডে ভয়ঙ্কর মানবিক বিপর্যয় ঘটতে পারতো। কারণ হাসপাতালটিতে প্রায় ১২০০ রোগী ভর্তি ছিল। এরমধ্যে আইসিইউতে থাকা অন্তত ১০ জন রোগী ছিলেন ভেন্টিলেশনে। কয়েক মিনিট ভেন্টিলেশনের বাইরে থাকলে যাদের জীবন সংশয় হতে পারতো।
হাসপাতালে ছিল অপারেশনের রোগী এবং নারী ও শিশুরাও। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হতে পারতো, আগুন নিচতলায় লাগলেও তা দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় শিশু ওয়ার্ডে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু যতটা ভয়ঙ্কর আগুন, ক্ষতি সে তুলনায় সামান্য। সম্পদের ক্ষতি নিশ্চয়ই পরে পরিমাপ করা হবে। তবে হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
সবচেয়ে বেশি আগুন লাগে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে। তাই বৈদ্যুতিক লাইন নিয়মিত চেক করতে হবে। আগুন নেভানোর জন্য পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা রাখতে হবে। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢোকার মত জায়গা রাখতে হবে। আর রানা প্লাজা বা সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ঘটনার মত মানুষের বিপদে সুশৃঙ্খলভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
১২০০ রোগীকেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিরাপদে সরিয়ে নেয়া গেছে এবং সবাইকে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের সময়ও জরুরি বিভাগ চালু ছিল। শুধু কিছু সময়ের জন্য জরুরি বিভাগ সামনের মাঠে সরিয়ে নিতে হয়েছিল। হাসপাতাল চালু করা হয় রাত দেড়টায়, অগ্নিকাণ্ডের মাত্র আট ঘণ্টা পর। দুর্ঘটনার একদিন পর শনিবার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে গিয়ে বোঝারই উপায় ছিল না, এত বড় ঝড় বয়ে গেছে হাসপাতালটির ওপর দিয়ে। শিশু ওয়ার্ড ছাড়া বাকি সব স্বাভাবিক। জরুরি বিভাগ ও বহির্বিভাগে যথারীতি ভিড়।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের এই ম্যাজিক নিয়ে কথা বলবো। তবে তার আগে বলি, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে যে ওয়েক আপ কল আমরা পেয়েছি, তাতে সতর্ক হওয়ার আগেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে চট্টগ্রামে। শনিবার রাতে চট্টগ্রামের চাক্তাইয়ে এক বস্তিতে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ৯টি তাজা প্রাণ। শুকনো মৌসুমে অগ্নিকাণ্ড নতুন নয়। এই দুর্যোগ ঠেকানোর একটাই উপায়, সাবধানতা। সে আলোচনায় পরে আসছি। তার আগে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের অগ্নিকাণ্ড নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
অগ্নিকাণ্ড একটি ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা। আগুনের লেলিহান শিখা মুহূর্তেই গ্রাস করে নেয় মানুষের জীবন-সম্পদ। কিন্তু অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হলো হাসপাতালে আগুন। অন্য আগুনে লোকজন নিজের চেষ্টায় প্রাণ বাঁচাতে পারে। কিন্তু হাসপাতালে যারা থাকেন, তারা অন্যের সাহায্য ছাড়া মুভ করতে পারেন না।
বিশেষ করে আইসিইউ, অপারেশনের রোগী এবং শিশু। তাই সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের আগুন আমাদের জন্য বড় শিক্ষা। কিভাবে অগ্নিকাণ্ডের মত বড় বিপর্যয় সামাল দিতে হয়, তার বড় শিক্ষা হয়ে থাকবে এ দুর্ঘটনা। এ দুর্ঘটনায় সবচেয়ে শিক্ষা মানবিকতা। মানুষ মানুষের জন্য, এটা সবচেয়ে বেশি টের পাই বিপদে পড়লে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ যে বিশ্বের সেরা, সেটা আগে অনেকবার দেখেছি, আবার দেখলাম সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। এর আগে দেখেছি রানা প্লাজায়। মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রানা প্লাজা বা সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে যা ঘটেছে, উন্নত বিশ্বের কোথাও সেটা ঘটা সম্ভব নয়। কারণ নতুন করে কারো জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে কেউ দেবে না। একমাত্র বাংলাদেশেই সেটা সম্ভব।
জীবনের মায়া না করে সবাই আগুনে ঝাঁপ দেয়, ধসে পড়া ভবনে ঢুকে পড়ে। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের অগ্নিকাণ্ডের খবর পাওয়ার সাথে সাথে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী, পাশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মীরা ছুটে এসেছে। মানুষ সুশৃঙ্খলভাবে হাতে হাতে রোগীদের বের করে এনেছে। বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স মালিকরা তাদের সর্বোচ্চ সামর্থ্য নিয়ে ছুটে এসেছে। বিনা পয়সায় রোগীদের বহন করেছে।
ধন্যবাদ পাবে ফায়ার সার্ভিস। তারা দ্রুততম সময়ে ছুটে এসেছে, উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তবে সবচেয়ে বড় ধন্যবাদটা পাবে অবশ্যই ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল, কুর্মিটোলা হাসপাতাল, মুগদা হাসপাতালসহ আশেপাশের সব হাসপাতালের সব কর্মীরা নিরলস পরিশ্রম করেছেন।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের একজন রোগীরও কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু রোগীদের বাঁচাতে গিয়ে আহত হয়েছেন ডাক্তারদের অনেকে। এই যে আমরা সুযোগ পেলেই ডাক্তারদের চৌদ্দগোষ্ঠি উদ্ধার করি, চেম্বার থেকে বেরিয়েই কসাই বলে গাল দেই; বিপদে পড়লে ডাক্তাররাই কিন্ত আমাদের পাশে থাকেন, চিকিৎসা দেন, প্রাণ বাঁচান।
মানছি সব ডাক্তার ভালো নয়। যেমন সব পুলিশ ভালো নয়, সব সাংবাদিক ভালো নয়। তবে কিছু ডাক্তারের বিচ্ছিন্ন তৎপরতা দিয়ে পুরো ডাক্তার সমাজকে গালি দেয়া কোনো কাজের কথা নয়। দেশে ভালো ডাক্তারের সংখ্যাই বেশি বলেই আমরা এখনও বেঁচে বর্তে আছি। তারা নিজেদের সময়, পরিবারের সময় উৎসর্গ করেন অসুস্থ মানুষের জন্য।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের আগুন আমাদের অনেকগুলো জিনিস সম্পর্কে সাবধান করে দিয়েছে। আমরা চাই না, কোথাও আগুন লাগুক। তবে হাসপাতালের ব্যাপারে আমাদের বাড়তি সতর্ক থাকতে হবে। শুকনো মৌসুমে আগুনের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। অপ্রয়োজনে চুলা জ্বালিয়ে রাখা যাবে না। সিগারেট খেয়ে যেখানে সেখানে ফেলা যাবে না।
সবচেয়ে বেশি আগুন লাগে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে। তাই বৈদ্যুতিক লাইন নিয়মিত চেক করতে হবে। আগুন নেভানোর জন্য পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা রাখতে হবে। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢোকার মত জায়গা রাখতে হবে। আর রানা প্লাজা বা সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ঘটনার মত মানুষের বিপদে সুশৃঙ্খলভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
প্রথম চেষ্টা হলো মানুষের জীবন বাঁচাতে হবে। বিপদ আসবেই, তবে সেটা মোকাবেলা করতে হবে ঠাণ্ডা মাথায়। 'বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা। বিপদে আমি না যেন করি ভয়...'।
প্রভাষ আমিন , হেড অব এটিএননিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন