সপ্তাহ দুই আগে দুদক প্রধানের একটি হতাশাব্যঞ্জক উচ্চারণ শুনলাম। তিনি সাংবাদিকদের অনুরোধ করলেন দুর্নীতির অভিযোগ সুনির্দিষ্ট করে লিখতে। না হলে ‘দুর্নীতির মহাসমুদ্রে কাকে ধরবেন’ এমন নৈরাশ্যই প্রকাশ পেল তার কণ্ঠে। তার সংকট আমরা অনুমান করতে পারি।
এত সব দুর্নীতির পাহাড় সরানো বা সমুদ্র সেচা তো সহজ নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থানের প্রতি আমাদের আস্থা রয়েছে। কিন্তু তিনি নানা রঙের নানা আকারের দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে কতক্ষণ যুদ্ধ করতে পারবেন এ নিয়ে মাঝে মাঝে সংশয় তৈরি হয়।
সব কিছুরই কোনো না কোনো উৎস থাকে। আমাদের মনে হয় এ দেশে দুর্নীতির বাড়বাড়ন্তের সঙ্গে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং রাজনৈতিক অঞ্চল থেকে দুর্নীতি কমাতে না পারলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ করে বিশেষ সাফল্য আসবে এমন মনে করার কারণ নেই। নির্বাচনে টাকার খেলা তো এখন প্রকাশ্যেই মানুষ দেখতে পায়। দুর্নীতির যোগসূত্র এখানে স্পষ্টভাবেই তৈরি হয়ে আছে।
১৯৫৪ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত জাতীয় পরিষদ এবং ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের স্মৃতিচারণ যারা করতে পারেন, তারা বলবেন নির্বাচনী ব্যয়ের সহজ সীমারেখা টানা যেত তখন। খরচের ক্ষেত্রগুলো কী ছিল? বাঁশের বেড়া দিয়ে নির্বাচনী প্রচার কেন্দ্র বানানো। এখানে বিড়ি, চা আর টোস্ট বিস্কুটের ব্যবস্থা রাখা।
সস্তায় ব্যানার-ফেস্টুন তৈরি করা। যে কর্মীবাহিনী চোঙা ফুঁকে নির্বাচনী মিছিল করবে, তাদের চা-নাস্তা আর সময় বিশেষে ভাত খাওয়ার বন্দোবস্ত করা। এর বাইরে অদৃশ্য কোনো খরচ যদি থেকেও থাকে তবে তা এতই ব্যতিক্রম যে পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থায় এর তেমন প্রভাব পড়ত না।
এ পর্বে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার থেকে শুরু করে জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্যরা সাধারণভাবে নিজেদের জনগণের নেতা বা সেবক ভাবতে অভ্যস্ত ছিলেন। নির্বাচনে যেটুকু ব্যয় হতো তা তাদের সাধারণ বাজেটের অন্তর্গত হিসেবেই মেনে নিতে অভ্যস্ত ছিলেন।
নির্বাচনে জেতার পর বাজেটের ক্ষতিপূরণ নিয়ে তাদের কোনো ভাবনা থাকত না। আর্থিক সামর্থ্যহীন জনপ্রিয় নেতারা তখন সহযোগিতা পেতেন। তাদের নির্বাচনী ব্যয় কিছুটা দল, কিছুটা সামর্থ্যবান এলাকাবাসীই বহন করত।
এ কারণে বিরাট নির্বাচনী ব্যয়ের দায় মাথায় বইতে হতো না বলে সুদে-আসলে টাকা উসলের দায়িত্বও বহন করতে হতো না। অধিকাংশ নেতা নিজেদের জননেতাই মনে করতেন। জনকল্যাণকে তারা ব্রত হিসেবে মানতেন।
স্বাধীনতার পর বিশেষ করে ১৯৭৫-এর পর থেকে জনপ্রতিনিধিত্বের দর্শনটা পাল্টে গেল। গণতন্ত্রের আকাক্সক্ষা নিয়ে যে দেশ স্বাধীন হল, সে দেশের গণতন্ত্রের চর্চাকারী ঐতিহ্যবাহী দলের অপরিণামদর্শী দুর্বল নেতৃত্ব বিরুদ্ধ স্রোতের মুখে ঐতিহ্য আর আদর্শ থেকে আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে পারলেন না।
প্রথমে সামরিক শাসন অতঃপর এর বেসামরিক লেবাস দেখে এরা হতাশ হয়ে পড়লেন। এ সময় থেকে আমাদের দেশের রাজনীতি হয়ে গেল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার নামাবরণে ক্ষমতায় পৌঁছার প্রতিযোগিতার রাজনীতি। গণতন্ত্র আর পূর্ণ অবয়ব নিয়ে দাঁড়াতে পারল না।
জেনারেলরা সেনা ছাউনি থেকে এসে প্রথমে ক্ষমতা দখল করলেন, পরে উর্দি খুলে নতুন দলের নাম আর দর্শন প্রচার করে বেসামরিক হয়ে গেলেন। রাজনীতির মাঠের সুবিধাবাদী এবং সুবিধা অন্বেষী মানুষগুলোকে দলে ভেড়াতে পারলেন সহজেই। তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত এর বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ল।
রাজনীতির নামে ছাত্রসমাজের একাংশের আদর্শের মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলা হল। পেশাজীবী সংগঠনগুলোর নৈতিকতার ভিত্তি গুঁড়িয়ে দেয়া হল। এর মধ্যে কথাসর্বস্ব হয়ে যাওয়া বামদলগুলোর মধ্যে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার মানসিক বল আর অবশিষ্ট ছিল না।
অন্যদিকে গড্ডলিকায় গা ভাসাল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া আওয়ামী লীগ। এখন বড় দলগুলোর একটাই মোক্ষ হল নির্বাচন নির্বাচন খেলার মধ্য দিয়ে কীভাবে একে অন্যকে ডিঙিয়ে ক্ষমতায় পৌঁছা যায়। একালের স্মার্ট নেতারা সেকেলে চিন্তা ও দর্শন থেকে বেরিয়ে এলেন।
ভোট কেন্দ্রে প্রভাব বিস্তার, ভীতির মুখে প্রকৃত ভোটারকে বিরোধী পক্ষের ভোটার বিবেচনায় গৃহবন্দি রাখা আর ভোটক্রয়কে অনেক সহজ পথ হিসেবে চিহ্নিত করলেন। ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’ বলে একটি নতুন শব্দ এরা উপহার দিলেন আমাদের অভিধানে।
আর এসব আয়োজনের মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় টেকার জন্য প্রয়োজন পড়তে থাকে টাকার। ক্ষমতায় পৌঁছার প্রতিযোগিতা যেখানে প্রবল, সেখানে টাকা খরচের প্রতিযোগিতাও ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
আর এমন বিপুল অর্থ জোগান দিতে নেতাকর্মী সমর্থকদের দেয় চাঁদা মরুভূমিতে বারি বিন্দুর মতো মিলিয়ে যেতে থাকে। ফলে সাধারণ চাঁদা নয়, চাঁদাবাজির দিকে যেতে হয়।
বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে আমাদের দেশে যেসব রাজনৈতিক দুর্নীতি দেখা যাচ্ছে এর বেশিরভাগের উৎসই হচ্ছে নির্বাচনে টাকার খেলা। এ ধরনের চাঁদাবাজিকে এতটাই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয় যে তা এই প্রতিযোগিতায় থাকা সব পক্ষের জন্য হয়ে পড়ে গা সওয়া।
সব পক্ষই যখন এক ঘাটের জল খায়, তখন এসব নিয়ে প্রশ্ন আর কে তুলবে! এর মধ্যে বড় দলগুলোর নির্বাচনে ব্যয়ের ক্ষেত্র অনেক সম্প্রসারিত হয়েছে। নির্বাচনী ফল নিজ দলের পক্ষে রাখার জন্য ক্ষমতায় থাকতেই দলীয় লোক বসাতে হবে উপযুক্ত জায়গাগুলোতে।
পুলিশ প্রশাসন ও স্থানীয় প্রশাসন ফিট রাখতে করণীয় সব করে যেতে হবে। এর জন্য বিপুল খরচের প্রয়োজন। এমন জটিল কার্যক্রম সফল করার জন্য বিপুল অর্থের চাঁদা যাদের ওপর আরোপ করা হয়, বিনিময়ে তাদের প্রভূত সুবিধা দিতে হয় রাষ্ট্রের ও প্রশাসনের ক্ষতি করে। এ কারণেই শত শত কোটি টাকার ঋণখেলাপিরা বহাল তবিয়তে মাথা উঁচু করে চলে, আবার নির্বাচনে দাঁড়িয়ে সংসদ সদস্যও হয়, প্রভাবের দাপটে মন্ত্রীও হতে পারে।
লাখ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে কোটি কোটি টাকা নিজ এবং পরিজনদের নামে ব্যাংকে তুলে রাখে। টেন্ডারবাজি-লাইসেন্সবাজিতে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতায় এগিয়ে থাকে। বিরোধী দলও চেষ্টা করে টাকা সংগ্রহে এগিয়ে থাকতে। কখনও টেক্কা দিতে চায় সরকারি ষড়যন্ত্রকে। নির্বাচন সামনে রেখে দলের আশীর্বাদ নিয়ে প্রার্থীরা ঝাঁপিয়ে পড়েন নির্বাচনী খরচ জোগাতে। ব্যবসায়ী ও আমলা জোগাড় করেন যে যার কায়দামতো।
বণিক বুদ্ধি মুনাফা খোঁজে। অর্থ দেয়ার বিনিময়ে ভবিষ্যতে তা বহুগুণে ফিরে পাওয়ার অঙ্গীকার আদায় করে নেয়। এমনও শোনা যায়, অনেক অর্থলগ্নিকারী বণিকগোষ্ঠী আছে যারা কোনো ঝুঁকিতে থাকতে চায় না। ক্ষমতার সিঁড়িতে পা রাখা দুই পক্ষকেই টাকা বিলিয়ে যায়। কারণ ক্ষমতায় যে-ই আসুক বণিকস্বার্থ ক্ষুণ্ণ করা যাবে না।
দুর্নীতির তো নানা রকমফের আছে। শুধু ফাইল আটকে ঘুষ খেলেই তো আর দুর্নীতি হয় না। ন্যায়-নীতি বিসর্জন দিয়ে উল্টো পথে হাঁটাটাও তো দুর্নীতি। যেমন জনপ্রতিনিধিদের জনগণের কাছেই থাকার কথা। এখন ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে এমপি পর্যন্ত সব জনপ্রতিনিধি নিজ অঞ্চলে খুব একটা থাকেন না।
নিজ এলাকার ভোটাররা তাদের প্রতিনিধিকে কাছে পায় না। কাছের শহরে বাড়ি করে বা রাজধানীতে তাদের ফ্ল্যাট বা বাড়িতে থাকতেই পছন্দ করেন তারা। কালেভদ্রে জনগণ তাদের দেখা পায়। কিন্তু অধিকাংশের ক্ষেত্রে নাগাল পাওয়া কঠিন। স্থানীয়ভাবে প্রায়ই জননেতাদের প্রতিনিধি এলাকায় থাকেন। তাদের মাধ্যমে নেতার সাক্ষাৎ পেতে হয়। কিন্তু নেতার চেয়ে প্রতিনিধিদের দাপট বেশি থাকে। তাদের ম্যানেজ করে নেতার দেখা পেতে হয়।
এভাবে নেতাদের গণবিচ্ছিন্ন হওয়ার সুযোগ রাষ্ট্রই করে দিয়েছে। আগে সংসদ চলাকালীন এমপি হোস্টেলে এসে থাকতেন ঢাকার বাইরের এমপিরা। অধিবেশন মুলতবি হলে যার যার এলাকায় ফিরে যেতেন। এখন ন্যাম ফ্ল্যাটে এমপি সাহেবদের অনেকের আবাসনের ব্যবস্থা করে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার ব্যবস্থা পাকা করা হয়েছে। এ ছাড়া অনেকেই ঢাকায় নিজ বাড়িতে বা ফ্ল্যাটেই থাকেন।
নির্বাচনের মাঠে কর্মীরাও এখন কমার্শিয়াল হয়ে গেছে, বা ওদের কমার্শিয়াল বানান হচ্ছে। চা-বিস্কুট আর বিড়ি খাওয়ালে এখন চলছে না। ভোট কেন্দ্র দখল বা এলাকায় প্রভাব বিস্তারের জন্য এখন রীতিমতো টাকা ছড়িয়ে ষণ্ডা পুষতে হচ্ছে। বিগত কোনো এক জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিক্রমপুর গিয়েছিলাম।
শুনে অবাক হলাম পেশিবহুল গুরুত্বপূর্ণ কর্মীদের পনেরো জনকে নাকি নির্বাচনে কাজ করার জন্য প্রার্থী পনেরোটি মোটরসাইকেল কিনে দিয়েছেন। আরেক পক্ষের প্রার্থী তার কর্মীদের দিয়েছেন একশ’টি মোবাইল ফোন।
নির্বাচনে এমন উন্মুক্ত টাকার খেলাই জন্ম দিচ্ছে রাজনৈতিক দুর্নীতির। কালো টাকাকে পরোক্ষ অনুমোদন দিতে হচ্ছে। সন্ত্রাসী পুষতে হচ্ছে। দুর্নীতিপরায়ণ আমলা আর অসাধু ব্যবসায়ীকে রাষ্ট্র আর দলের নীতিনির্ধারক বানিয়ে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু সদিচ্ছা থাকলে এসবের কি প্রয়োজন হতো? প্রার্থীরা যদি নির্বাচনী এলাকায় জনপ্রিয় নেতা হয়ে থাকেন, জনগণের কাছে থেকে নিজেকে যোগ্য বলে প্রমাণ করতে পারেন, তবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথটাকে তিনিই এগিয়ে দিতে পারবেন।
অমন প্রার্থীর জন্য টাকা ছড়াতে হয় না। পেশিশক্তি ভাড়া করতে হয় না। মোটরসাইকেল, মোবাইল ফোন আর টাকা ছড়িয়ে তরুণ সমাজের চরিত্র হনন করার প্রয়োজন পড়ে না। তবে এটুকু নিশ্চিত করতে হবে যে প্রকৃত ভোটার তার নিজের ভোটটি স্বাধীন বিবেচনায় দিতে পারবেন।
অবশ্য আমার এক রাজনৈতিক দল সংশ্লিষ্ট আত্মীয় এসব চিন্তাকে ভাবকল্পনা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তার মতে, বর্তমান সময়ে টাকা না উড়িয়ে নির্বাচনে জেতা সম্ভব নয়। এ সঙ্গে তিনি যোগ করেছিলেন, ‘যেখানে এখন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে দশ পনেরো লাখ টাকা বেরিয়ে যায় সেখানে সংসদ নির্বাচনে কোটি টাকা বেরিয়ে যাওয়া খুবই যৌক্তিক।’
এসব রাজনৈতিক দুর্নীতির সূত্র ধরেই প্রশাসনিক দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ার একটি ভিত্তি তৈরি হয়। তাই আমরা মনে করি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি তখনই কার্যকর হবে, যখন সততার সঙ্গে রাজনৈতিক দুর্নীতি কমিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে এবং তা বাস্তবায়নে সরকার জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করবে।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন