যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার দাবি বিভিন্ন মহল থেকে দীর্ঘ দিন ধরেই তোলা হচ্ছে। কিন্তু জামায়াত নিষিদ্ধ হচ্ছে না। নিবন্ধনের শর্ত পূরণ করতে না পারায় নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে। জামায়াত এখন দলের নামে নির্বাচন করতে পারে না। তবে তারা স্বতন্ত্র পরিচয়ে নির্বাচন করে। জামায়াত বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক। এবার সংসদ নির্বাচন করেছে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে। একটি আসনেও জামায়াত জিততে পারেনি। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার একটি মামলা কোর্টে আছে। কোর্টের রায় খুব শিগগিরই যদি হয়ে যায় তাহলে জামায়াত দল হিসেবে নিষিদ্ধ হবে।
তার মানে জামায়াত নিষিদ্ধ হওয়া না-হওয়ার ব্যাপারটি আদালতের ওপর নির্ভর করছে। সরকার নির্বাহী আদেশবলে জামায়াত নিষিদ্ধ করবে না। জামায়াত নিয়ে দেশে এক ধরনের রাজনীতি চলছে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধিতা করেছিলো জামায়াত। এই দলের নেতা-কর্মীরা পাকিস্তানি সামরিক জান্তার প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেছেন। আলবদর, আলশামস, রাজাকার বাহিনী গঠনে ভূমিকা রেখেছেন। বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, নারী ধর্ষণ, লুটপাট ইত্যাদি মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডে জামায়াত নেতৃত্ব দিয়েছে। দেশ শত্রু মুক্ত হলে, স্বাধীন হলে জামায়াত গর্তে চলে যায়। দলের শীর্ষনেতা গোলাম আজম পালিয়ে পাকিস্তানে গিয়ে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা চালাতে থাকেন।
অথচ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতার কর্তৃত্ব নিজের কব্জায় নিয়ে জামায়াত নেতা গোলাম আযমকে দেশে ফেরার অনুমতি দেন। স্বাধীনতার পর ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর যে সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা ছিলো, সেটাও সামরিক ফরমান বলে তুলে দেন জিয়া। মুক্তিযুদ্ধে বিরোধী ভূমিকা পালন করার কারণে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর জামায়াত বাংলাদেশের রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে স্বাভাবিকভাবেই হারিয়ে গিয়েছিলো। জামায়াত নেতাদের কেউ কেউ বিদেশে পালিয়ে গিয়েছিলেন, অনেকে দেশের ভেতরেই গা ঢাকা দিয়েছিলেন। মসজিদ-মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে তাদের হয়তো কিছু গোপন তৎপরতা ছিলো, প্রকাশ্যে আসার সুযোগ তারা পায়নি। সে হিসেবে বলা যায়, জিয়াউর রহমান জামায়াতকে পুনর্জন্ম দিয়েছেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়েও জিয়া তার তথাকথিত সমন্বয়ের রাজনীতির নামে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করে দেশের যে ক্ষতি করেছেন তার কোনো মার্জনা হতে পারে না।
বিএনপির বদান্যতায় জামায়াত বাংলাদেশের রাজনীতিতে জায়গা পেয়েছে এবং বিএনপির পৃষ্ঠপোষকতাতেই জামায়াতের পক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে, – যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তারা সক্রিয় বিরোধিতা করেছিলো-ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার সুযোগপেয়েছিলো। বিএনপির প্রতি সেজন্যই জামায়াতের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। বিএনপি এবং জামায়াতের সম্পর্ক এখন এতোটাই মধুর যে তারা একে অপরকে ছাড়া চলতে পারে না, পারবে বলেও মনে হয় না।
জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের টানাপোড়ন নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে মাঝেমাঝেই কিছু খবর বের হয়। বাস্তবে এই দুই দলের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় ধরনের কোনো সমস্যা রয়েছে বলে অনেক পর্যবেক্ষকই মনে করেন না। যারা বিএনপির ভেতরের খবর রাখেন, তারা জানেন যে, বিএনপির নীতিনির্ধারকরা সব সময় মনে করেন, কৌশলগত কারণে কখনো কখনো সম্পর্কের ক্ষেত্রে শীতলতা বা কিছুটা দূরত্ব দেখা দিলেও জামায়াতকে চূড়ান্তভাবে রাগিয়ে দেয়া বা রুষ্ট করা ঠিক হবে না। বিএনপির কাঁধে সওয়ার হয়ে জামায়াতের যেমন লাভ হয়েছে, তেমনি জামায়াতের কাঁধে চেপেও বিএনপি লাভবান হয়েছে। জামায়াতের দশ শতাংশ ভোট ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির পক্ষে না গেলে ফলাফল কি হতো সে হিসাব আর কেউ না করলেও বিএনপি ঠিকই করেছে। এবার এতো কিছুর পরও যে জামায়াতকে ছাড়তে পারলো না বিএনপি, সেটাও ওই ভোটের হিসাব মাথায় রেখেই। ড. কামাল হোসেন যতো ভালো কথাই বলুন না কেন, বিএনপি জানে তার ভোট নেই। তার দলের কারো নির্বাচনী এলাকা নেই। জামায়াতের আছে।
বিএনপি এবং জামায়াত এখন কেউ কাউকে ছাড়ার অবস্থায় নেই। তারা এখন ‘সোনার হাতে সোনার কাঁকন, কে কার অলঙ্কার’। কেউ কেউ এমনও বলেন যে, বিএনপি যদি হয়, হার্ডওয়্যার, তাহলে জামায়াত হলো সফটওয়্যার। সফটওয়্যার ছাড়া হার্ডওয়্যার চলে?
আদালতের নির্দেশে সত্যি যদি জামায়াত নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়, তখনই কেবল বোঝা যাবে জামায়াত তখন প্রকৃতপক্ষে কার পেটে আশ্রয় পায়।
বিভুরঞ্জন সরকার
লেখক : গ্রুপ যুগ্ম সম্পাদক, আমাদের নতুন সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন