জি. মুনীর
বাংলাদেশের সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ চলতি বছরের জানুয়ারিতে এসে দাঁড়িয়েছে ৫৫ হাজার ৯৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। গত কয়েক দিন আগে অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিত সংসদে এমনটিই জানিয়েছেন। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে সরকারি ব্যাংকগুলোর এই ঋণের অর্থ আটকা পড়ে আছে। তবে বরাবরের মতো এবারো সংসদে অর্থমন্ত্রী বললেন, খেলাপি ঋণ আদায়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালত আইন ২০০৩-এর আওতায় মামলা দায়ের করা হচ্ছে।
অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যের কার্যকারিতা নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষসহ এ খাতের তথ্যাবিজ্ঞজনেরা আস্থা রাখতে পারছেন না। কারণ- দেশের মানুষের অজানা নয়, বাংলাদেশের সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে ও একই সাথে কিছু বেসরকারি ব্যাংকেও কী ভয়াবহ ধরনের দুর্নীতি আর লুটপাট চলেছে এবং এখনো চলছে। এমন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে শত শত কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে, যাদের নামঠিকানাও এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক ব্যাংকে মূলধন পর্যন্ত খেয়ে ফেলা হয়েছে। অনেক ব্যাংক আমানতকারীদের আমানতের টাকা পর্যন্ত ফেরত দিতে পারছে না। সরকারি ব্যাংকগুলো এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি শিকার হয়েছে লুটপাট আর দুর্নীতির। আজ কয় বছর ধরেই সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি মেটাতে হাজার হাজার কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে জনগণের করের টাকায়। এবারো এসব ব্যাংকের পক্ষ থেকে মূলধন ঘাটতি মেটাতে সরকারের কাছে হাজার হাজার কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। অনুমান করি, যথারীতি তা দেয়াও হবে বাজেট বরাদ্দের মাধ্যমে। সবচেয়ে উদ্বেগের কারণ, এসব অনিয়ম আর দুর্নীতির সাথে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, বরং ক্ষেত্রবিশেষে পুরস্কৃত করা হয়েছে। শীর্ষ ঋণখেলাপিদের কাছে হাজার হাজার কোটি টাকা আটকা পড়ে থাকলেও তাদের নাম পর্যন্ত প্রকাশ করা হচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেছেন, সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরনের ব্যাংকে ঋণ বিতরণে গত ছয় বছরে ব্যাপক হারে অনিয়ম আর দুর্নীতি চলেছে। দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে। ঋণগ্রহীতারা আরো বেশি হারে ঋণখেলাপি হওয়ার প্রবণতা প্রদর্শন করে চলেছে। বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, সুশাসনের অভাবেই এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালা উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বিপুল খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতের ও অর্থনীতির জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া তথ্য মতে, ব্যাংক খাতে ২০১১ সালে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা। বিগত ছয় বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫৫ হাজার ৯৫ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। শীর্ষ ২৫ ঋণখেলাপির হাতে আটকে আছে ৯ হাজার কোটিরও বেশি টাকা।
বাংলাদেশের সরকারি কিংবা বেসরকারি ব্যাংকই বলি, গোটা ব্যাংক খাতকে ক্ষমতাসীনেরা অনিয়ম আর দুর্নীতির মাধ্যমে ধ্বংসের দুয়ারে এনে দাঁড় করিয়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরে ব্যাংক খাতের দুর্নীতি আর লুটপাট নিয়ে থেকে থেকে পত্রপত্রিকায় যেসব খরাখবর প্রকাশিত হয়েছে, তার বর্ণনা সংক্ষেপে তুলে ধরতে গেলে এক মহাগ্রন্থ রচিত হয়ে যাবে। সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ- সরকার এসব দুর্নীতি আর লুটপাট বন্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা তো নেয়ইনি, বরং লুটেরা-দুর্নীতিবাজদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। অধিকন্তু এতদিন গ্রাহকদের সুদৃঢ় আস্থার ওপর ভর করে ভালোভাবে সুনামের সাথে বরাবর ব্যাংক ব্যবসায় চালিয়ে আসা এ দেশের বৃহত্তম রেসরকারি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের ওপর এবার নজর পড়েছে ক্ষমতাসীনদের। অভিযোগ উচ্চারিত হচ্ছে- এই ব্যাংকটিকে ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ায় নানামুখী অপতৎপরতায় নেমেছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক বরাবর সবচেয়ে বড় ও লাভজনক ব্যাংক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে ১৯৮৩ সালে এর সূচনা লাভের পর থেকে। সামগ্রিক দিক বিবেচনায় এটি এ দেশের বেস্ট পারফর্মিং ব্যাংক। কিন্তু এই ব্যাংকটির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে সরকারের নানা অপতৎপরতার ফলে।
পাঠক সাধারণ হয়তো লক্ষ করে থাকবেন, গত ৬ এপ্রিল দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ইসলামী ব্যাংক সম্পর্কিত একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। দৈনিক ইত্তেফাক এই খবরটি প্রকাশ করে ‘ইসলামী ব্যাংকের শীর্ষ পাঁচ শীর্ষ কর্মকর্তাকে অপসারণ’ শিরোনামে। খবরটিতে বলা হয় : ‘ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা কমিটির শীর্ষ পাঁচজন কর্মকর্তাকে অপসারণ করা হয়েছে। তবে ব্যাংকের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে এরা সবাই পদত্যাগ করেছেন। তবে একযোগে শীর্ষ পাঁচ কর্মকর্তার ব্যাংক থেকে এভাবে চলে যাওয়াকে ভালো চোখে দেখছে না কেউই। ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক।’
খবরটিতে আরো উল্লেখ করা হয়- ‘ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের এই পাঁচ কর্মকর্তা হলেন : অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) মো: শামসুজ্জামান, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) হাবিবুর রহমান ভুঁইয়া এফসিএ, ডিএমডি আবদুস সাদেক ভুঁইয়া, ডিএমডি মোহাম্মদ মোহন মিয়া ও সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট (এসইভিপি) আমিনুল ইসলাম। ’
ইত্তেফাক একটি সূত্রের কথা উল্লেখ করে এই খবরে বলেছে- ‘একটি সূত্র জানিয়েছে, বোর্ড চাপ সৃষ্টি করে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছে। এসইভিপি ছাড়া বাকি সবার মেয়াদ ছিল এক বছর। জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরাস্তু খান ইত্তেফাককে বলেছেন, পাঁচজনেরই পদত্যাগপত্র পেয়েছি। তবে এটি অস্বাভাবিক কিছু নয়, নিয়মিত ঘটনা। এ ব্যাংকে ১৩ হাজার লোক কাজ করে। এর মধ্যে কয়েকজন পদত্যাগ করতেই পারে। তিনি বলেন, যারা পদত্যাগ করেছেন তাদের বেশির ভাগই শারীরিকভাবে অসুস্থ। নতুন ম্যানেজমেন্ট, নতুন এমডি এসেছে, কিছু পরির্তন তো আসতেই পারে।’
ইত্তেফাকে প্রকাশিত এই খবরটি ও অন্যান্য জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এ সম্পর্কিত খবরটি যারা পড়েছেন তাদের মনে নিশ্চিতভাবেই এই পাঁচজন শীর্ষ কর্মকর্তার অপসারণের বা পদত্যাগের বিষয়টি নিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম নিয়েছে। তারা নিশ্চয় ভেবেছেন : এসব কর্মকর্তা কী স্বেচ্ছায় চলে গেছেন, না কোনো ধরনের চাপের মুখে এরা সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন? এ বিষয়টির পেছনে কি সরকারের কোনো ধরনের রাজনৈতিক ক্রিয়াপ্রক্রিয়া কাজ করেছে? এই রিপোর্টটি ইত্তেফাকের যে সাংবাদিক তৈরি করেছেন, তিনিও সম্ভবত আরাস্তু খানের বক্তব্যের ওপর পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারেননি। তাই তিনি খবরটির শিরোনামে এসব কর্মকর্তার চলে যাওয়াকে ‘পদত্যাগ’ হিসেবে উল্লেখ না করে ‘অপসারণ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তা ছাড়া সাধারণ বুদ্ধিবিবেক খরচ করলেও প্রশ্ন জাগে,এই পাঁচ শীর্ষ কর্মকর্তার বেশির ভাগই একযোগে অসুস্থ হয়ে পড়াটাও কি কোনো স্বাভাবিক ঘটনা? কোনো মতেই তা নয়। বরং এ ঘটনা সরকারের এ ব্যাপারে লুকোচুরির আভাসই সুস্পষ্ট।
তা ছাড়া এর আগেও ইসলামী ব্যাংকে সরকারের অযাচিত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অপপ্রয়াস নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে আলোচনা সমালোচনা চলতে দেখা গেছে। অনেকের হয়তো মনে আছে সরকারের অঙুলি হেলনে গত বছরের ৫ জানুয়ারি ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের এক পরিবর্তন সাধন করে ব্যাংকটির বোর্ড সভায় পরিবর্তন আনা হয়। অভিযোগ উঠেছে, ওই দিন রাজধানীর পাঁচতারা হোটেলে বোর্ডসভার নামে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বোর্ডের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালককে চাপ দিয়ে পদত্যাগ করানো হয় এবং নতুন কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়া হয়। তখন কথা ওঠে, ওই অপসারণ ও নিয়োগে ব্যাংক কোম্পানি আইন ও ইসলামী ব্যাংকের সংবিধি অথবা দেশের প্রচলিত আইনের কোনোটিই অনুসরণ করা হয়নি।
এরও পর ডেইলি স্টারের ২০১৭ সালের ২৮ মে’র এক খবরে জানানো হয়- ইসলামী ব্যাংকের দু’জন স্বতন্ত্র পরিচালকÑ ভাইস চেয়ারম্যান সৈয়দ আহসানুল আলম এবং রিস্ক ম্যানেজমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান আবদুল মাবুদ বোর্ড থেকে গত ২৫ মে পদত্যাগ করেন। এর দু’দিন আগে তাদের নির্বাহী পদ থেকে অপসারণ করা হয়। এ সময় সাতজন পরিচালকের একটি গ্রুপ হুমকি দেয়, তাদের কারো একজনকে পদত্যাগে বাধ্য করা হলে, তারা একযোগে পদত্যাগ করবেন। তখন ওই দু’জন পরিচালকের পদত্যাগের বিষয়টি ব্যবসায়ী মহল, আমানতকারী ও ব্যাংক মহলে সামগ্রিকভাবে এক ধরনের উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। কিন্তু তখন বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হয়েও বাংলাদেশ ব্যাংক এ ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করে। তখন বেসরকারি থিংকট্যাংক সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এ ব্যাপারে বাংলাদেশে ব্যাংকের সুস্পষ্ট বিবৃতি দাবি করে। তখন ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত মুখ্য ভূমিকা পালন করা।
এদিকে গত ২৪ এপ্রিল ডেইলি স্টারের আরাস্তু খানের পদত্যাগের নেপথ্যে; শীর্ষক এক অনলাইন খবরে জানায়- ‘ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের ২১ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করতে অস্বীকৃতি ও বড় একটি ঋণ অনুমোদন না দেয়ায় ব্যাংকটির চেয়ারম্যান আরাস্তু খানকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। তিন বছরের জন্য নিয়োগ পাওয়ার পর মাত্র এক বছরের মাথায় গত ১৭ এপ্রিল তাকে পদত্যাগ করতে হয়। দ্য ডেইলি স্টারের এক অনুসন্ধানে চেয়ারম্যানের পদত্যাগের পেছনে এ দু’টি কারণ উঠে আসে।’
ডেইলি স্টার এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে আরো জানায়- ‘অনুসন্ধানে জানা গেছে, কয়েক মাস আগে ইসলামী ব্যাংকের একজন কর্মকর্তার একটি তালিকা দিয়ে তাদের বরখাস্ত করতে বলা হয়। এর মধ্যে ব্যাংকটির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে শুরু করে একাধিক উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক, নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট ও মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তা ছিলেন। তাদেরএকটি রাজনৈতিক দলের সমর্থক আখ্যা দিয়ে বরখাস্ত করতে বলা হয়েছিল। এ তালিকায় থাকা ২১ জনের মধ্যে পাঁচজন শীর্ষ কর্মকর্তা, যাদের একজন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক, তিনজন উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও একজন জ্যেষ্ঠ নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্টকে গত ৩ এপ্রিল পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। এর দু’দিন পর চাপের মুখে ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদ তাদের পদত্যাগপত্রগুলো গ্রহণ করে।
এর পরও বাকি ১৬ জনকে বরখাস্ত করতে চেয়ারম্যান আরাস্তু খানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছিল। কিন্তু উচ্চপর্যায়ে এতজনকে এক সাথে বরখাস্ত করা হলে দক্ষ জনবলের বিশাল জনশূন্যতা সৃষ্টি হবে জানিয়ে তিনি তখন দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। এই সুযোগটিই কাজে লাগান ব্যাংকটির একজন প্রভাবশালী পরিচালক। তিনি সরকারের একটি অংশের মধ্যে প্রচার করেন যে, ইসলামী ব্যাংককে জামায়াত-শিবিরের প্রভাবমুক্ত করতে আরাস্তু খান অসহযোগিতা করছেন। এ অবস্থায় আরাস্তু খানকে পদত্যাগ করতে বলা হলে তিনি ১৭ এপ্রিল পদত্যাগপত্র জমা দেন। ব্যাংকের পর্ষদ পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে সাথে সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ব্যাংকটির আরেকজন পরিচালক নাজমুল হাসানকে চেয়ারম্যান পদে স্থলাভিষিক্ত করেন। আরমাডা স্পিনিং মিলসের প্রতিনিধি হিসেবে তাকে চেয়ারম্যান করা হয়। এর আগে আরাস্তু খান প্রতিষ্ঠানটির প্রতিনিধি ছিলেন।
এদিকে দৈনিক প্রথম আলো গত ২৫ এপ্রিলের এক খবরে জানায়- দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক এখন চরম আর্থিক সঙ্কটে পড়েছে। মালিকানা বদল হয়েছে গত বছরের জানুয়ারিতে। এরই মধ্যে অব্যবস্থাপনা ও পারস্পরিক দ্বন্দ্বের কারণে নানা সঙ্কটে পড়েছে ব্যাংকটি। এর আগে সরকারি খাতের সবচেয়ে ভালো ব্যাংক বেসিক ব্যাংকের একই হাল হয়েছে। সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের কারণে বর্তমান সরকারের সময়েই ব্যাংকটি তীব্র সঙ্কটে পড়ে আছে। এবার ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা বদলের পর এই প্রথম বড় ধরনের আর্থিক সঙ্কটে পড়ল ব্যাংকটি। টাকার অভাবে ব্যাংকটি এর ঋণ দেয়ার কর্মসূচি ছোট করে এনেছে। একসময় আমানতকারীরা ছুটতেন ইসলামী ব্যাংকের পেছনে। এখন দেশের সবচেয়ে বড় এ ব্যাংক নিজেই ছুটছে আমানতের পেছনে। মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তনের ১৬ মাসের মধ্যে ব্যাংকটির এই সঙ্কট দেশের বিশিষ্ট ব্যাংকার, আমানতকারী ও বিনিয়োগকারীদের চিন্তার মধ্যে ফেলেছে। কেননা, দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক সঙ্কটে পড়লে এর প্রভাব পড়ে দেশের পুরো আর্থিক খাতের ওপর। মূলত গ্রাহকদের আস্থায় চিড়, অব্যবস্থাপনা, একটি নির্দিষ্ট গ্রুপের কাছে রাতারাতি পুরো ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়া এবং কয়েকজন পরিচালকের অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে এই সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমে বলেছেন, ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসার পর থেকে অনেকের কাছে বিষয়টি ধোঁয়াটে মনে হয়েছে। বিনিয়োগ-আমানত অনুপাতটি ৯২ শতাংশে নিয়ে যাওয়া ঠিক হয়নি। যেকোনোভাবেই হোক, আমানতকারীদের কাছে একটি বার্তা পৌঁছেছে যে, ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ এখন একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতে। এটি দূর করতে হবে।
ইসলামী ব্যাংকের দেয়া তথ্যমতে জানা গেছে- পরিবর্তনের আগে এই ব্যাংকে ১০ হাজার কোটি টাকার মতো বিনিয়োগযোগ্য তহবিল ছিল। কিন্তু মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা পরিবর্তনের পর তারা যে আমানত সংগ্রহ করেছে তার চেয়ে ঋণ দিয়েছে অনেক বেশি। সঙ্কটের কারণ সেটিই।
অপর দিকে গত বছরের ১৬ অক্টোবর ডেইলি স্টার এক খবরে জানায়, ইসলামী ব্যাংকের নতুন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ আগ্রাসীভাবে ঋণ বিতরণ করছে। ফলে এর ঋণ-আমানত অনুপাত বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত বিপজ্জনক ৯০ শতাংশের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। খবরটিতে বলা হয়, নতুন ব্যবস্থাপনা ব্যাংকটির পরিচালনার দায়িত্ব নেয় গত বছরের গোড়ার দিকে। এর পরবর্তী সাত মাস ব্যাংকটির ঋণ-আমানত অনুপাত ৩.৫৪ শতাংশ বেড়ে ৮৯.৪ শতাংশ পয়েন্টে গিয়ে দাঁড়ায় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে- গত বছরের প্রথম ছয় মাসে এর খেলাপি ঋণ ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ৭.৪ শতাংশ বেড়ে ৬২ হাজার ৯২৪ কোটিতে পৌঁছে। আর এই সময়ে আমানত ৩.১৭ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ৬৮ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ঋণ-আমানত অনুপাতটি ব্যবহার হয় একটি ব্যাংকের তারল্য বিবেচনা করার জন্য এবং মোট ঋণের পরিমাণকে মোট আমানতের পরিমাণ দিয়ে ভাগ করে এই হার বের করা হয়। নতুন ব্যবস্থাপনার এই আগ্রাসী ঋণ বিতরণ বাংলাদেশ ব্যাংককেও শঙ্কিত করে। ফলে গত বছরের মাঝামাঝি বাংলাদেশ এ ব্যাপারে ইসলামী ব্যাংককে চিঠি দিয়ে সতর্ক করে। নতুন ব্যবস্থাপনার অধীনে ২০১৭ সালের প্রথম ছয় মাসে ইসলামী ব্যাংকের মুনাফা ৫২.৭৩ শতাংশ কমে মুনাফা দাঁড়িয়েছে ১৬১ কোটি ২৭ লাখ টাকা। অথচ এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও লাভজনক বেসকারি ব্যাংক। ফলে আমনতকারী ও ব্যাংকারেরা ইসলামী ব্যাংকের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাদের সংশয়, ক্ষমতাসীনেরা এ ধরনের একটি শক্তিশালী ব্যাংক প্রতিষ্ঠানকে অন্যান্য ব্যাংকের মতো ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে? বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশের বিবেকবান মানুষ ও ব্যাংকটির আমানতকারীরা চায় বাংলাদেশ ব্যাংক এই ব্যাংকটিকে বাঁচাতে এগিয়ে আসবে। দেশের ব্যাংকার ও ব্যাংকের আমনতকারীদের বাঁচানোর স্বার্থে এ পদক্ষেপ নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন