ভারত, পাকিস্তান কিংবা ধর্ম-সংক্রান্ত যে কোনো বিষয়ে বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমানদের আর বেহুঁশ হলে চলবে না। রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষায় মাথা ঠাণ্ডা রেখে সচেতনভাবে জীবন যাপন করতে হবে। নানা দিক থেকে উস্কানি আসছে। বিশেষ করে ধর্ম নিয়ে একাধিক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী দেশের কোটি কোটি মুসলমানকে উস্কানি দিয়ে চলেছে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে মাথা ঠাণ্ডা রেখে চলাফেরা করলেও কোনো কোনো উস্কানিতে পা দিয়ে গরীব হিন্দুদের ঘরবাড়িতে আক্রমণ করে বসেছে স্থানীয় মুসলমানরা। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যেতে হলে যুক্তি দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে চলতে হবে। কারও উস্কানিতে পা দিলে হবে না।
রংপুরে হিন্দুদের বাঁচাতে পুলিশ গুলি করেছে, মুসলিম তরুণ হাবিবুর রহমান মারা গেছে, আহত হয়েছে অনেক। উস্কানি দাতারা সংখ্যায় বেশি না, কিন্তু সে উস্কানিতে পা দেয়ার মানুষের সংখ্যা কম নয়। উস্কানি দুই দিক থেকে আসছে। স্বাধীনতা বিরোধী পাকিস্তান-পন্থী জামাত আর ভারতের বিজেপি-শিবসেনা জঙ্গি গোষ্ঠীর বাংলাদেশী সহযোগীরা সরাসরি এবং গোপনে ক্রমাগত উস্কানি দিয়ে যাচ্ছে। এদের ধর্মের লেবাস ভিন্ন হলেও এরা নিজেদের কর্মকাণ্ড দিয়ে একে অপরের উদ্দেশ্য পূরণে সহায়তা করে।
বাংলাদেশ নিয়ে নানা দিকে, নানা পর্যায়ে ষড়যন্ত্র চলছে। চিরশত্রু পাকিস্তান তো আগে থেকেই আছে। আঞ্চলিক রাজনীতি-অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পশ্চিম ও প্রাচ্যের কতিপয় বড় দেশের মনোযোগের কেন্দ্রে এখন বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে বাগে রাখতে চায় সবাই। ফলে ষড়যন্ত্র ডালপালা মেলছে। চলমান রোহিঙ্গা সংকট শুধুমাত্র ধর্মীয়, জাতিগত ও অর্থনৈতিক বিষয় নয়। এর সাথে জড়িয়ে আছে আঞ্চলিক ও বিশ্ব পরাশক্তিগুলোর আধিপত্য বিস্তারের খেলা। মানবিক কারণে দেশের জনগণের প্রত্যাশার সাথে তাল মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়েছেন। সারাবিশ্বে নন্দিত হয়েছেন শেখ হাসিনা, দেশের মানুষ বুকভরা ভালোবাসা আর দোয়া জানিয়েছেন শেখ হাসিনার প্রতি। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এও বলেছেন, রোহিঙ্গাদের অবশ্যই ফেরত যেতে হবে।
রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে সরকার যখন আপ্রাণ কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে সাফল্য পেতে শুরু করেছে, তখন চরম উদ্বেগের খবর জানিয়েছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কিছু সংবাদ মাধ্যম। বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া ভারতীয় রাজ্য আসামের স্থানীয় জনগোষ্ঠী বাঙালি মুসলমানদের ‘বাংলাদেশী’ আখ্যা দিয়ে বের করে দিতে উঠে পড়ে লেগেছে কট্টরপন্থী হিন্দুদের দল বিজেপি ও সমমনা আরএসএস, শিবসেনা ও বজরং পার্টির লোকেরা। বাঙালি মুসলমান মানেই বাংলাদেশী বলে ধরে নেয়া হচ্ছে। অথচ আসামে চলে যাওয়া বাংলাদেশীদের প্রায় সবাই হিন্দু সম্প্রদায়ের।
আসাম থেকে লাখ লাখ মুসলিমকে তাড়িয়ে সেখানে আরও একটি মিয়ানমার তৈরি করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন জমিয়ত উলেমা-ই-হিন্দের প্রবীণ নেতা মাওলানা সৈয়দ আর্শাদ মাদানি। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ সম্পর্কে আমাদের অনেকেই জানি না। ব্রিটিশ শাসনামলে ধর্মের ভিত্তিতে ভারতকে ভাগ করে ফেলার অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে সবার আগে সংগঠন হিসেবে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ রুখে দাঁড়িয়েছিল। আলাদা নয়, সম্মিলিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার দাবিতে ব্রিটিশ আমলে দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছে এই জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ।
বৈধ নাগরিকদের তালিকা থেকে রাজ্যের লাখ লাখ মুসলিম বাদ পড়তে পারেন, সেই আশংকা প্রকাশ করে দিল্লিতে এ সপ্তাহে একটি সেমিনার আয়োজন করেছিল 'দিল্লি অ্যাকশন কমিটি ফর আসাম'। সেখানে জমিয়ত নেতা মওলানা মাদানি বলেন, ‘৪০০ বছর ধরে যারা বংশপরম্পরায় আসামে বসবাস করছেন তাদের আপনি বাংলাদেশি বলে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন, তা আমরা কিছুতেই হতে দেব না। আমি পরিষ্কার বলতে চাই, তাহলে আগুন জ্বলে যাবে। ভারতীয় নয় বলে এই মুসলিমদের যদি আপনি বের করার চেষ্টা করেন, তাহলে তো বলব আসামের বিজেপি সরকার এটাকেও আর একটা মিয়ানমার বানানোর চেষ্টা করছে।’
ইঙ্গিত স্পষ্ট, আসাম সরকার বাঙালি মুসলমানদেরকে রাজ্য থেকে বের করে দিয়ে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিতে চায়। বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে নিয়মিত ভাবে বাঙালি মুসলমানদের বের করে দেয়ার হুমকি দিয়ে আসছে চরমপন্থি হিন্দুরা। সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের শিকার হয়ে আসামে মুসলমানদের হতাহতের ঘটনা বহু। ‘প্রতিকূল পরিস্থিতির’ কারণে যেসব বাংলাদেশি আসামে অবৈধভাবে এসেছেন, তাঁদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার ঘোষণা অনেক আগেই দিয়েছিলেন বিজেপি নেতা তরুণ গগৈ। অন্যদিকে আসামের ৪০ লাখ মুসলমানকে অবৈধ নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করাকে ষড়যন্ত্র আখ্যা দিয়ে সেখানকার কমিউনিটি নেতারা তৎপর আছেন। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নাগরিক নিবন্ধনের সময় বেঁধে দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। ২০১১ সালে আসামের আদমশুমারিতে দেখা যায়, রাজ্যে মুসলিম জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। ৩৪ দশমিক ২ শতাংশ লোক মুসলিম। এত বড় জনগোষ্ঠীকে আসামে ‘বাংলাদেশী খেদাও আন্দোলন’ আর মাধ্যমে বের করে দিতে চায় বিজেপি ও সমমনারা।
আসাম পাবলিক ওয়ার্কার্স নামে একটি সংগঠন প্রদেশের ভোটার তালিকা থেকে ৪১ লাখ ‘অবৈধ বাংলাদেশীর’ নাম বাদ দেয়ার দাবি জানিয়ে ‘জনস্বার্থে’ যে আবেদন করেছিল ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট তা গ্রহণ করেছে। বাদিপক্ষের অভিযোগ হচ্ছে আসামের ভোটার তালিকায় কমপক্ষে ৪১ লাখ বাংলাদেশীর নাম রয়েছে। চরমমাত্রার সাম্প্রদায়িকতা থেকে উৎসারিত এমন দাবি। যে হিন্দুরা বাংলাদেশ থেকে নানা সময়ে আসামে গিয়ে ঘর-বাড়ি করেছেন, তাদেরকে নাগরিকত্ব দেয়া হচ্ছে আর যে মুসলমান জনগোষ্ঠী আসামের লোকাল, তাদেরকে বলা হচ্ছে বাংলাদেশী! রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিজেপিসহ অন্যান্য চরমপন্থী হিন্দুত্ববাদী দলগুলোর এহেন কর্মকাণ্ডের পেছনে রাজনৈতিক অভিলাষ রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে নানা ছুতোয় হিন্দুদের ভাগিয়ে নিয়ে আসামে স্থান দিয়ে নিজেদের ভোটার বাড়াতে চায় এরা। মুসলমানদের বের করে দিয়ে হিন্দুত্ববাদের স্লোগানে নিজেদের একাধিপত্য নিশ্চিত করতে চায় বিজেপি, শিবসেনা, আরএসএস, হিন্দু মহাসভা, বজরং পার্টি ও সমমনা মৌলবাদী দলগুলো। এই জন্যই বাংলাদেশের হিন্দুদের জন্য সীমান্ত খোলা রয়েছে বলে মাঝে মাঝেই বিবৃতি দেয় ভারতের হিন্দু নেতারা। এবং তাদের হয়ে কাজ করে এমন একদল লোক বাংলাদেশের ভেতরেই সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে ভারতীয় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী।
ভারত এখন সব সম্ভবের দেশ। বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতের নানা রাজ্যে মুসলমান ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের উপর অত্যাচার-নির্যাতন এতটাই বেড়ে গেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক গবেষণা প্রতিবেদনে ভারতকে সহিংস রাষ্ট্রের তালিকায় বিশ্বের চার নম্বর স্থান দিয়েছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানা নিপীড়ন তো আছেই। সামান্য গুরুর মাংস খেলে বা গরুর মাংস খাওয়ার অভিযোগ দিয়ে দিনে দুপুরে জ্যান্ত মানুষ মেরে ফেলা হচ্ছে। ভারতকে ব্র্যান্ডিং করতে ‘ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া’ বলে একটি স্লোগান ব্যবহার করা হয়। ‘অবিশ্বাস্য’ ভারতে সত্যই এক অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটাতে চলেছে চরমপন্থি হিন্দু সংগঠন হিন্দু মহাসভা। মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছিল যে ব্যক্তি, সে নথুরাম বিনায়ক গডসের প্রতি ‘ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার’ বহিঃপ্রকাশ হিসেবে মন্দির বানাতে যাচ্ছে চরমপন্থি হিন্দুদের সংগঠন হিন্দু মহাসভা। মহাত্মা গান্ধীকে যারা এত ঘৃণা করতে পারে, অন্য ধর্মের মানুষ, বিশেষ করে মুসলমানদেরকে তাহলে কত ঘৃণা করতে পারে সেটা বলা কল্পনা করা সহজ কাজ নয়। প্রতিবেশী রাষ্ট্র সাফল্যে আমরা খুশি আর দুর্দশায় শুধু কষ্টই পেতে পারি। আমাদের করার কিছু নেই। তবে আমাদের স্বার্থ রক্ষায় নিজেদের করার আছে অনেক কিছু।
ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র হয়েছে দুটো-ভারত আর পাকিস্তান। পাকিস্তানকে যুদ্ধে পরাজিত করে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের শক্তিতে। তাই ইতিহাসের মানদণ্ডে আমরা বলতে পারি, মুসলমান কোথাও পাঠাতে হলে পাকিস্তানে পাঠানোর চেষ্টা করে দেখতে পারে ভারত। বাংলাদেশ শুধু মুসলিম বা হিন্দুর রাষ্ট্র নয়, এ রাস্ত্রর সকলের। বাংলাদেশের মুসলমানদের আবেগমুক্ত হয়ে সাবধান থাকতে হবে। মুসলমান মুসলমান বলে আবেগে উন্মাদ হয়ে গেলে চলবে না। বিশেষ করে হেফাজতে ইসলাম ও মাদ্রাসা কমিউনিটিকে অনেক সাবধান হতে হবে। ভারত বা পাকিস্তানের মুসলমান আর আমরা এক নই। এক হলে আমাদের বর্ডার থাকত না, ভাষা আলাদা হত না। পাকিস্তানের মুসলিম সেনাবাহিনী আমাদেরকেই কচুকাটা করেছিল। তাই আমাদের সতর্ক হতে হবে।
বিজেপির শক্ত নেটওয়ার্ক আছে বাংলাদেশেও। এরা প্রকাশ্যে বাংলাদেশে ‘ভারত মাতা কি জয়’ বলে। অন্যের উসকানিতে যে মুসলমান হিন্দুদের উপর আক্রমণ করে, সেও এই বিজেপির উদ্দেশ্য সাধন করে। তাই আমাদের দেশে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা যতটুকু আছে, তা দূর করার দায়িত্ব আমাদেরকে নিতে হবে। ভারত, পাকিস্তান, চীন, মিয়ানমার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, রাশিয়া তথা বিশ্বের নানা দেশকে সামাল দিয়েই আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে এগিয়ে যেতে হবে। নিশ্চয় রাজনীতিবিদ, সামরিক-বেসামরিক নীতি নির্ধারকরা জনগণকে সাথে নিয়ে সঠিক সব সিদ্ধান্ত নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালান করবেন। নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্বও অনেক। ধর্মকে ব্যক্তিজীবনে আপনি সবার উপরে স্থান দিয়ে চর্চা করেন, আপনার ইচ্ছা। কিন্তু যখনই রাষ্ট্র হিসেব করবেন, তখন প্রতিবেশী রাষ্ট্র, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ইত্যাদি নানা বিষয়কে মাথায় রেখে কাজ করতে হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্র দিয়ে গেছেন। এখন এ স্বাধীন রাষ্ট্র আমাদের রক্ষা করতে হবে।
শেখ আদনান ফাহাদ
লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
পাঠক মন্তব্য
Sir Nice nice very significant contemporary issue you have picked- up in your article. Thank you very much sir.
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন