প্রবাসে একটুকরো পজেটিভ বাংলাদেশ
05 September 2015, Saturday
বহুদিন পর এমন একটা অনুষ্ঠানে গেলাম যাকে আমি হঠাত্ আলোর ঝলকানি বা জানলা গলা রোদ্দুর বলতেই পারি। সপ্তাহান্তে দূর-দূরান্তের অনুষ্ঠানে গাড়ি চালিয়ে যাওয়া এখন আর ঠিক শরীরে সয় না। তাছাড়া ক্লান্তিকর একঘেয়ে দেশীয় রাজনীতি কপচানো বা শোনার ধৈর্যও আর নেই। এখনো সে ধারার বাইরে আসতে পারিনি আমরা। বিদেশে দেশীয় রাজনৈতিক দলের দলাদলি আর শাখার ভিড়ে তাই নিজেকে বেমানান মনে হয়। আয়োজকদের অন্যতম আল নোমান শামীম আমার তরুণ বন্ধু। অনুজাধিক এই ছেলেটি মাঝে মাঝে চমকে দেয়। তার একটা নিজস্ব বিশ্বাস বা আস্থার জায়গা আছে। দেশের রাজনীতির মূল ধারায় সে কাজ করে। কিন্তু সে ধারার সবকিছু আমার পছন্দের নয়। তবে এবারের আয়োজনটি ছিল একেবারে ভিন্ন ধরনের।
আজকে সবদিক থেকে এগুতে চাওয়া দেশের সামনে যে সম্ভাবনা তার পেছনে প্রবাসীদের অবদান কম নয়। রিজার্ভ মুদ্রার যোগানদার দেশের জন্য রক্তজল করে টাকা পাঠানো এদের কথা আমরা খুব একটা মনে করি না। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব আর সতীর্থদের ধারণা য পলায়তি স জীবতি। এরা চলে গিয়ে বেঁচে গেছে। ভালো আছে আনন্দে আছে। কিন্তু আমি যেদিকে দেখতে পাই না সেদিকের ঘাসগুলো মনোরম সবুজ এমন ধারণার মত কেউই প্রবাসীদের দুঃখ-কষ্টগুলো তেমন করে দেখতে পায় না।
প্রবাসীরা যেহেতু মানসিকভাবে সবসময় দেশের সংস্পর্শে থাকেন অথচ শারীরিকভাবে দূরে, তাই তাদের প্রেমও দিনে দিনে গভীরতর হয়ে ওঠে। অদর্শনের এই প্রেম মায়ের প্রতি সন্তানের কর্তব্যের মত পবিত্র। সে জায়গাটাকে তুলে ধরে সে রাতে যারা বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানালেন তারা সবাই প্রণিধানযোগ্য মানুষ। কেউ এনজিও কর্তা, কেউ বিনিয়োগকারী, কেউ দেশে এগুলোর দেখ-ভাল করেন, কেউবা ব্যাংকার। কিন্তু কেউ কোন দলের নন। এই বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছে। কারণ বিনিয়োগ বা দেশে টাকা পাঠানোর বেলায় কি কি করা দরকার বা কোন চ্যানেলে টাকা গেলে তা হক বা ন্যায্য সেটা আর গুরুত্ব পেতো না। শুরু হয়ে যেতো স্বপ্ন দেখার গল্প বলার প্রতিযোগিতা। কে কোন আমলে বিনিয়োগ স্বপ্ন দেখেছিলেন সে খোশগল্প আর হল ভাঙ্গা চিত্কারে দিশেহারা প্রবাসী বাঙালি ভাবতো আর ট্যাকা পাঠাইয়া কাম নাই দেশে।
না তেমন কিছুই হয়নি সে সন্ধ্যায়। বরং আমাদের অবাক করে দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক উপহার দিলেন বস্তুনিষ্ঠ ধারণা। আমরা পর্দায় দেখলাম কেমন ঢাকা কেমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে চাইছি আমরা। চোখ বুঁজে না চোখ খুলে পর্দায় এমন স্বপ্ন দেখানোর মানুষগুলো থাকলে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকতে পারবে না। এবং পিছিয়ে থাকেনি বলেই আজ এসব সম্ভব হচ্ছে। আমাদের যৌবনে বা এই সেদিনও এমন ধারণার প্রচার সম্ভব ছিল না। বাংলাদেশকে একটি পিছিয়ে পড়া দুর্গত দেশ ভাবতেই আনন্দ পেতো বিদেশিরা। এখন আর তা বলার সাহস নেই। সেদিন উপস্থিত এখানকার লেবার দলের এমপি প্রাক্তন মন্ত্রী বর্তমান মেয়র সবাই একবাক্যে সিডনি তথা এদেশে বসবাসরত বাংলাদেশিদের প্রশংসা করলেন। এ প্রশংসা কোন ফাঁপানো বেলুন ছিল না। এরা যা বলেন তা যুক্তিতর্কের ভিত্তিতে বলেন। ক্রমবর্ধমান বাজার বাংলাদেশিদের ব্যবসা-বাণিজ্য আর দেশে টাকা পাঠনোর বেলায় এদেশের ব্যাংকিং চ্যানেলগুলোর কথা বলার ভেতর প্রচ্ছন্ন স্বীকৃতি আর ভালোবাসার আভাস ছিল। তাদের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরা বলতে চাই— বাংলাদেশিরা অভিবাসী দেশগুলোর নিয়ম ও আইন পালন করেই নিজের দেশের পাশে দাঁড়ায় এবং দাঁড়াতে চায়।
বিনিয়োগ আর টাকা পাঠানোর বেলায় হুন্ডি প্রথার বিরোধিতা এবং ঠিক আইনে চলার পরামর্শ ছিল জরুরি। অহেতুক ঝুঁকি আর দেশের লোকসান বা ভাবমূর্তি নষ্ট করে এসব করার কোন প্রয়োজন নেই। জানি না কিভাবে কার মাথায় এই আয়োজনটির ধারণা এসেছিল তবে এটুকু বুঝলাম এই প্রক্রিয়া চালমান। এবং তা দেশে দেশে বিস্তার লাভ করছে। জনাব শাকিলের উপস্থাপনা আর তথ্যনির্ভর বক্তব্যে আমরা দিকনির্দেশনা দেখেছি। এটা মানতে হবে সম্ভাবনার জায়গাগুলো এখন যদি ঠিক করে নেয়া না যায় আমাদেরকে সময়ও মার্জনা করবে না। অনেক বছর পর আমাদের সামনে অগ্রযাত্রার সুযোগ এসেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই বলেন এবং তাঁর আন্তরিকতাও প্রশ্নাতীত। কিন্তু দেশের আর সবগুলো সমস্যার মত প্রবাসীদের সমস্যাও প্রকট। যারা বিমানবন্দরে হয়রানির শিকার তারা সমাজে অনিরাপদ, তাদের বাণিজ্য লগ্নি, তাদের কষ্টার্জিত টাকাও অনেক সময় নিরাপত্তার অভাবে দিশেহারা। অথচ সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে বসে আছে। দেশ বসে আছে নতুন সময়ে।
পশ্চিমে সূর্য প্রায় অস্তাচলে। পুবে তার উদীয়মানতা টের পাই আমরা। বাংলাদেশেও তার আভাস আছে। আমাদের অর্থনীতির আকাশে আজ যে নতুন দিগন্তরেখা তার অনিবার্য সারথী প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য এমন সম্ভাবনাময় একটি আয়োজন ছিল জরুরি। রাতে একা গাড়ি চালিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে মনে হচ্ছিল অনেকদিন পর বিদেশে একটুকরো পজেটিভ বাংলাদেশ দেখলাম। রক্ত হত্যা মৃত্যু আর কলহের বাইরে যার অস্তিত্ব আমাদের বাঁচার জন্যেই জরুরি।
(সিডনি থেকে)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন