জয় হোক বাঙালি নারী শক্তির
26 August 2015, Wednesday
সমাজ বাস্তবতার এমন কঠিন দৃশ্য বজায় রেখে নারী নির্যাতন প্রতিরোধের দিবস পালন হাস্যকর। আমাদের সমাজ ও জীবনে পুরুষতন্ত্রের যে কি কঠিন দাপট তার দিকটা না ভাবলে সমাধান মিলবে না। একবার খাবার টেবিলে আমার এক পুরুষ আত্মীয়র কাণ্ড দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তিনি তার স্ত্রী আমরা সবাই ডিনারে। ভদ্রলোক একটু পর পর তার স্ত্রীকে এটা দাও ওটা দাও বলে ব্যস্ত করে রাখছিলেন যে ভদ্রমহিলা ভালো করে খেতেই পারছিলেন না। তার সামনে গ্লাস পাশে অর্ধহাত দূরে পানির জগ তবু স্ত্রীকেই পানি ঢেলে দিতে হচ্ছিল গ্লাসে। এক পর্যায়ে আমি আর স্থির থাকতে না পেরে প্রশ্ন করেছিলাম কেন তিনি নিজে তা করছেন না, কেন তার স্ত্রীকেই তা করতে হবে? আমাকে বিস্মিত করে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন : কেন নয়? আমি তাকে বিয়ে করেছি কেন তবে? বৌয়ের কাজ হলো পতিসেবা। এই ভদ্রলোক লেখাপড়া জানা এবং কখনো পত্নীর সাথে তেমন কোন দুর্ব্যবহার বা হাতাহাতি করার মানুষ নন। তারপরও এই যে ধারণা এটাই তার মত মানুষের বিশ্বাস। এমন মানুষ এমন বাঙালি আমাদের সমাজে ভুরিভুরি। আমি নিজেকে দিয়েই বিবেচনা করি দেশে থাকতে বাসন-কোসন মাজা বা সাফ করার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। জল গড়িয়ে খেতে জানতাম না। জানলেও খেতাম না। ভাবতাম ওগুলো মেয়েদের কাজ। আর এখন প্রতিসন্ধ্যায় একগাদা বাসন-কোসন পরিষ্কার করা আমার নৈতিক দায়িত্বের পর্যায়ে। যে অর্থে এনজয় বলে সেভাবেই কাজটা আমার আপন হয়ে উঠেছে। ওঠার পেছনে যে কেবল কাজের মানুষের আকাল তা নয় কিন্তু সমাজের একটা ভূমিকাও আছে এতে। এটা এমন সমাজ যেখানে কাজ আপন বৈশিষ্ট্যে শ্রেণিহীন। আমার এক লেখক ও অর্থনীতিবিদ বন্ধু এদেশের নাগরিকত্ব নেয়ার কালে ইন্টারভিউতে বলেছিল তার বৌ কিছু করে না। বৌটি যদিও অত্যন্ত মেধাবী তখন ছিলেন গর্ভবতী। স্বামী কাজ করে বৌ পেটে বাচ্চা আর এক কন্যা তখন মাত্র স্কুলে যায়। বেচারি সারাদিন ঘরদোর নিয়েই ব্যস্ত। প্রশ্নকর্তা স্বামীর এই উত্তরের জন্য তার নাগরিকত্ব পাবার দিনটিই পিছিয়ে দিয়েছিলেন। সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন যে এদেশের কাজ ও কাজের স্পিরিট বিষয়ে স্বামীর কোন ধারণাই নেই। এবং তিনি খাতা-কলমে হিসাব করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন মূলত স্ত্রী বেচারি স্বামীর চেয়ে বেশি কাজ করেন এবং তিনিই মোর প্রোডাক্টিভ বা কর্মযোগী। এমন দেশে কাজ তাই সবার জন্য আরাধ্য হবে এটাই স্বাভাবিক।
আমাদের দেশকেই বলা হয় সুজলা সুফলা শ্যামলা। যে দেশের শ্যামল রং রমণীর সুনাম শুনে আমরা বড় হয়েছি যে দেশের সব মানুষই আসলে কালো সে দেশে এমন বর্ণবাদ? স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যাদের কৃষ্ণকলি বলে বিখ্যাত করে গিয়েছেন তাদের এমন জীবন বিসর্জন মানা কঠিন। সুন্দরের সংজ্ঞা না জানা মানুষগুলোর জন্য করুণা হয়। সাঁওতাল মেয়ের সৌন্দর্য দেখেনি তারা। জানে না কোন কৃষ্ণমেঘের ফাঁকে কোন কালো মেয়ের চোখে বুকে কোমর বা নিতম্বে বিদ্যুত্ খেলে যায়। সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন আফ্রিকা কবিতায়, কলো মানুষেরা কী কাণ্ডই না করে চলেছে সেখানে। বাংলাদেশে এখনো সাদা বা পাকা কুমড়োর মত লাল ড্যাবডেবে হবার বিজ্ঞাপন দেয়ার রেওয়াজ আছে। সমাজে সংসারে সর্বত্র মেয়েদের ফর্সা বানানোর এক আজগুবি প্রক্রিয়া চলে।
চারদিকে এত উত্তেজনা এত মারামারি এত বড় বড় ঘটনা এগুলো কারো চোখেই পড়ে না। আমার পড়লো। আমি নিশ্চিত জানি আমার কন্যা সন্তান হলে সে তার মায়ের মত শ্যামলা বা কৃষ্ণবর্ণের হতো। এও জানি তার সৌন্দর্য হতো তার জননীর মত আকর্ষণীয়। কিন্তু তাকেও কি এই পরিণতি বরণ করতে হতো কোন কারণে? আমি কি তখন গাইতে পারতাম:
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি.........
নারী নির্যাতন আসলে একটি সামাজিক ব্যাধি। পারিবারিক রোগ। মনোদৈহিক বিকার। এর প্রতিকার দিবস পালন নেই। আছে সমাজ ভাবনা আর আত্মশুদ্ধিতে। মজার ব্যাপার এই এমন পুরুষসিংহের কথিত দেশে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলীয় নেতা এমনকি বিএনপি নেত্রীও নারী। এটা আশার এটা প্রমাণ করে আমাদের পুরুষরা যত কথাই বলুক ঘরে বাইরে মা জননীরাই শক্তিশালী। কাজেই সমাধানও আসতে পারে সে পথে। যে আমার কন্যা সেই কারো জায়া আবার কারো জননী। এভাবনাকে মনে রেখে বিচার বিবেচনা করলেই মুক্তি মিলতে পারে। জয় হোক বাঙালি নারীশক্তির।
সিডনি থেকে
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন