উত্সব, লেহেঙ্গা সংস্কৃতি ও ফিরে আসার টান
01 July 2015, Wednesday
জীবন আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে, দিচ্ছে এবং দেবে। জীবনের নিয়মই তাই। সে থামতে জানে না। একসময় আমরা যা ভাবিনি বা ভাবতে জানতাম না এখন তা চাইলেই পাওয়া সম্ভব। দেশে দেশে কালে কালে পাল্টে যাওয়া জীবন জীবনধারাকেও দেয় নতুন রুপ নতুন আঙ্গিক। উত্সবও তার বাইরে না। একদা বাঙালির উত্সবের যে রুপ তার সাথে এখনকার চেহারা মিলে না। মেলানো যায় না। এটা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। এককালে মানুষ খাদি কাপড় পরিধান করতো। এককালে মানুষ কলমে কালি ভরে সে কলম দিয়ে লিখতো। এককালে মানুষ পায়ে হেঁটে কয়েক ক্রোশ গিয়ে কারো সাথে দেখা করতো। সেকালে আর একালে অনেক ব্যবধান। এখন তার ওগুলোর প্রয়োজন পড়ে না। আমরা বলি ডিজিটাল বলি কর্পোরেট যুগ। এযুগে যার যা ইচ্ছে কিনতে পারে যার যা খুশি চাইতে পারে যার যেমন মর্জি সেভাবে যোগাযোগও করতে পারে। এর ভেতর দিয়ে একদিকে যেমন বন্ধুত্বের নতুন দিগন্ত সম্পর্কের নতুন নতুন জায়গা গড়ে উঠছে তেমনি আমরা দেখছি ভাঙ্গন আর বোঝাপড়ার তিক্ততা। আজকাল খবরে দেখি ঘর ভাঙ্গার বিষাদমাখা গল্পের সিরিজ। যার অধিকাংশ কোন না কোন উত্তেজনা বা স্পৃহার শিকারে পড়ে ভাঙ্গনের পথে। এমন যদি হতো এগুলোর পেছনে আর্থিক অনটন বা সামাজিক বিশৃঙ্খলা ভয় কিংবা অপরাধ বা তেমন কিছু কাজ করছে তবে মেনে নিতাম। বরং আমাদের শ্রমজীবী কৃষক মেহনতি মানুষরাই ভালো আছেন। তাদের অনটন থাকলেও চিত্তে অসুখ নাই। তাদের মোবাইল থাকলেও সেটার দরকার পড়ে পাট, চাল, গমের দাম জানার জন্যে। খুব জোর আবহাওয়া আর স্ত্রী পুত্র বা কন্যার খবর নেয়া। অন্যদিকে মধ্যবিত্ত কিংবা স্বচ্ছল পরিবারগুলো যন্ত্রের কবলে পড়ে এখন আসলেই অসহায়। জীবন তাদের যত দিচ্ছে ঠিক ততই কেড়ে নিচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন মিডিয়ায় আমরা দেখছি নানা ধরনের আজে-বাজে সংবাদ। খেলোয়াড় শিল্পী সাংবাদিক নেতা অভিনেতা কেউ বাদ নেই। যারা সমাজের প্রতীক যাদের কথা লেখা আদর্শে মানুষ আসা খুঁজে বেড়ায় তাদের ঘরে ঘরে চলছে পরিবর্তিত জীবনের হামলা। ঘর ভাঙ্গছে পরিবার ভাঙ্গছে মানুষ হয়ে পড়ছে অসহায়।
সবচেয়ে বেশি বদলে গেছে বাজার। আহারের পাশাপাশি বসন আর সাজসজ্জার বাজারে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। আমাদের পাশের দেশের বাণিজ্য বুদ্ধি চিরকালই প্রখর। তারা এখন উভয় ঈদে আরো অধিক সক্রিয়। এক ঈদে নতুন ফ্যাশন ধরিয়ে দেয় তো অন্য ঈদে নতুন সাজে পুরনো গরু। এই ঈদে তাদের ভিনদেশি পোশাকের জেল্লায় আমাদের অবস্থা দেখার মত। খবরে দেখলাম বিদেশি নামে পরিচিত শার্টের দাম কয়েক হাজার টাকা। আমি বহুদেশে গিয়েছি এত দামের শার্ট আসলে অনেক দেশে নাই। খোদ আমেরিকার হাওয়াইতেও আমি এত দামের শার্ট দেখিনি। আমাদের যে কি হয়েছে বোঝা মুশকিল। দাম চড়িয়ে কিনতে পারলেই যেন প্রমাণ হয়ে যায় কে কত ধনী বা কার কত যোগ্যতা। এমন আগে কখনো ছিল না। যে যুগে মানুষ খদ্দের পরতো দেশি পাজামা-পাঞ্জাবি বা দেশি শাড়ি পরে ঈদ করতো সেযুগে ভালোবাসাই ছিল চালিকাশক্তি। সুবর্ন সে যুগে মানুষের ধারণা ও চিন্তায় ছিল মেধার আর বুদ্ধির ছাপ। এখনকার মত কেবল বিত্ত আর ধান্দায় পূর্ণ ছিল না জীবন। তাই আহার পোশাক বসন সবকিছুতেই আমরা ছিলাম পরিমিত। এখন কথায় কথায় এই দেশ ঐ দেশের বিরোধিতা করি বটে তখন আমাদের গায়ে চাপানো থাকে পাকি কুর্তা বা ভারতীয় লেহেঙ্গা। এর একটাও আমাদের সাথে যায় না।
অবাক হয়ে দেখি লেহেঙ্গা সংস্কৃতির জয়জয়কার। বাঙালি নারীর এমন লেহেঙ্গাপ্রীতি মানা যায়? এজাতীয় পোশাক আমাদের দেশের রুচি বা মেজাজের সাধে যায়-ই না। তবে প্রত্যেক পোশাকের একটা আলাদা দিক আছে। কোন কোন পোশাক কোন কোন মানুষকে মুহূর্তে অন্য ধরনের করে তোলে। লেহাঙ্গারও তার নিজস্বতা আছে। কিন্তু মুশকিল হল এটা এখন খাবারে ভারতীয় শর্মার মত পোশাকের ক্রেজ। যার জন্যে তার দাম নাকি ৫ লাখ টাকা।
এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। ফিরে আসতে হবে নিজের মাটি ও নিজের সংস্কৃতির টানে। ঈদের বেশকিছু দিক আমরা আমাদের মত করে নিয়েছি। সাহিত্য শিল্প গান বাজনায় যদি তা পারি পোশাকে বা আহারে পারবো না কেন? আমাদের জন্ম হয়েছে নতুন রক্তে নতুন এক পরিচয়ে। তাকে তুলে ধরতে হলে এজাতীয় সব নকলবাজি আর পরনির্ভরতা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হবে। তাতেই ঈদ হবে আমাদের নিজস্ব উত্সব, হবে কানায় কানায় বাঙালিয়ানা আর স্বকীয়তায় সমুজ্জ্বল।
সিডনি থেকে
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন