ওইদিন প্রধান দ্বন্দ্বটি ঠিকমতো বোঝা যায়নি
07 November 2017, Tuesday
আজ ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর। এই ঐতিহাসিক দিনটিকে ঘিরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে পরস্পরবিরোধী মূল্যায়ন আমরা দেখতে পাই। কারও দৃষ্টিতে এই দিনটি জাতীয় ‘বিপ্লব ও সংহতি’ দিবস। আবার কারোর দৃষ্টিতে এই দিনটি হল সৈনিক হত্যা দিবস।
জাতীয় জীবনের অনেক ঘটনাবলী সম্পর্কে আমাদের এ বিভক্ত জাতি যেভাবে একমত পোষণ করতে পারে না, ঠিক একইভাবে ৭ নভেম্বরও বিতর্ক থেকে রক্ষা পায়নি। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন তারা এই দিবসটি জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করেছে।
তারা এই দিবসটিকে জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করে এ যুক্তিতে যে, ৭ নভেম্বর সিপাহি জনতার যে অভ্যুত্থান ঘটেছিল তার মূলে ছিল জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রেরণা। মার্কসবাদীরা ইতিহাসের বিশ্লেষণ করেন দ্বান্দ্বিক, বস্তুবাদী ব্যাখ্যার মাধ্যমে।
এ ব্যাখ্যার মূল কথা হল, সমাজে সবসময় শ্রেণীদ্বন্দ্ব অব্যাহত থাকে। সামাজিক বিকাশের স্তরের ওপর নির্ভর করে শ্রেণীদ্বন্দ্ব বিভিন্নরূপে প্রকাশ লাভ করে। জাতীয় দ্বন্দ্বও এক ধরনের শ্রেণীদ্বন্দ্ব। এ দ্বন্দ্বে একদিকে থাকে জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার বিরোধী শ্রেণী এবং বৈদেশিক আগ্রাসী শক্তি। বৈদেশিক আগ্রাসন পরিস্ফুট হয় কখনও সরাসরি ঔপনিবেশিক শাসনের মধ্য দিয়ে।
আবার কখনও কখনও সরাসরি দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা না করেও একটি জাতিকে নানা উপায়ে নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলবন্দি করার মাধ্যমে এর প্রকাশ ঘটে।
জাতির বৃহত্তর অংশ যদি অনুভব করে বিদেশি আগ্রাসী শক্তি তার অগ্রযাত্রার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে দেখা দিয়েছে, তখন জাতীয় দ্বন্দ্বই প্রধান হয়ে যায়। এ অবস্থায় জাতিকে জাতীয় মুক্তি অথবা জাতীয় প্রতিরোধের লড়াইকে বেছে নিতে হয়। পৃথিবীর অনেক দেশে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
১৯৭১-এ বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল পাকিস্তানের একটি অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ। অভ্যন্তরীণ উপনিবেশের তত্ত্বটি দাঁড় করেছিলেন একজন পাকিস্তানি সমাজতাত্ত্বিক। তার নাম হামজা আলাভি।
তিনি ব্রিটেনের খ্যাতনামা ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। সে সময় পূর্ববাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান এবং স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশ হয়ে পড়েছিল পাকিস্তানেরই একটি অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ।
পূর্ববাংলার সম্পদ নানা প্রক্রিয়ায় চালান হয়ে যেত পশ্চিম পাকিস্তানে। এ সম্পদ করায়ত্ত করেই পাকিস্তানে গড়ে উঠেছিল বৃহৎ ২২ পরিবার।
অথচ ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টিতে পূর্ববাংলাবাসীর অবদান ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের তুলনায় অনেক বেশি। নানা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত এবং রাষ্ট্রীয় নীতিকে ব্যবহার করে পূর্ববাংলাকে পরিণত করা হয়েছিল অভ্যন্তরীণ উপনিবেশে।
অর্থাৎ একটি রাষ্ট্রের একটি অঞ্চল যখন অন্যান্য অঞ্চল দ্বারা শাসিত ও শোষিত হয় তখনই সৃষ্টি হয় অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ। এ ধরনের উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে চরম রক্তক্ষয়ী লড়াই হয়েছিল ১৯৭১-এ। ওই সময় পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ও তাদের এ দেশীয় দোসররা আমাদের শত্রুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল।
আমাদের যুগপৎ লড়াই করতে হয়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে। তখন জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য জাতীয় দ্বন্দ্বই মুখ্য ছিল। তবে এ দ্বন্দ্বের শ্রেণীরূপটি প্রতিভাত হয় পাকিস্তানি শাসক শ্রেণী এবং তাদের দোসরদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। সে সময় দেশের অভ্যন্তরে যে ধনিক শ্রেণী এবং জোতদাররাও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিল, তারাও ছিল আমাদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের মিত্র।
৭ নভেম্বরকে যারা সৈনিক হত্যা দিবস রূপে চিহ্নিত করেন, তাদের দৃষ্টিতে ৭ নভেম্বর ছিল একটি খুনোখুনির তাণ্ডব। এ কথা সত্য যে, ৭ নভেম্বরে সৈনিকদের হাতে কিছু সামরিক অফিসার এবং কিছু অসামরিক ব্যক্তিও নিহত হয়েছিলেন। রক্তপাতের এ ঘটনাগুলো ছিল একটি বিশাল রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের বিচ্যুতির দিক। এ বিচ্যুতিও ঘটতে পেরেছিল দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ভুল ব্যাখ্যার ফলে।
যারা এ পথে সৈনিকদের পরিচালিত করতে চেয়েছিল, তারা পুরো পরিস্থিতিটিকে বিশাল শ্রেণীদ্বন্দ্ব হিসেবে দেখতে চেয়েছিল। তারা সামরিক বাহিনীর এমন একটি রূপান্তর কামনা করেছিলেন, যে বাহিনীতে অফিসার নামক কিছু থাকবে না। কিন্তু এ দৃষ্টিভঙ্গি দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না।
সে সময়ে বাংলাদেশের জনগণের মনোজগতে যে প্রশ্নটি দারুণভাবে নাড়া দিয়েছিল সেটি হল, জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন। পাকিস্তান থেকে মুক্ত হওয়ার পর বাংলাদেশে ভিন্ন এক রকমের জাতীয় দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল। এ দ্বন্দ্ব ছিল ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে।
এর ফলে শ্রেণীদ্বন্দ্বের রাজনীতি হালে পানি পায়নি। যদিও যারা সে সময় শ্রেণীদ্বন্দ্বকে মুখ্য বলে বিবেচনা করছিলেন, তারাও ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে নানা রকম স্লোগান দিয়েছেন।
কিন্তু ৭ নভেম্বরে এসে দেখা গেল জাতীয় দ্বন্দ্ব নয়, শ্রেণীদ্বন্দ্বই তাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার। ফলে ঘটেছিল চরম বিভ্রান্তি এবং এই গোষ্ঠীর রাজনীতির পরাজয়ের শর্তও তৈরি হয়েছিল। একইরকম না হলেও ভিন্ন আদলে বিভ্রান্তিতে আক্রান্ত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় নকশালপন্থী নামে পরিচিতি অর্জনকারী কতিপয় ‘বিপ্লবী’ গ্রুপ। এই শক্তিটিকেও তাদের রাজনৈতিক বিভ্রান্তির জন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছে। তারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, রাজনীতিতে দ্বন্দ্ব বিশ্লেষণ করে সময়োপযোগী রণধ্বনি দিতে না পারলে রাজনৈতিক আত্মহননের শিকার হতে হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রগতিশীলদের ভুল পদক্ষেপ প্রগতিবাদী আন্দোলনকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
৭ নভেম্বরের আগে ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। তিনি খন্দকার মোশতাকের কাছ থেকে কিভাবে ক্ষমতা আইনের আবরণ রক্ষা করে গ্রহণ করবেন, সেই আলোচনা ও দরকষাকষিতে ৩ থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত ব্যস্ত ছিলেন।
এর ফলে দেশবাসী প্রমাদ গুনল। তারা দেখতে পেল দেশ একটি সরকারবিহীন অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে। তারা আরও শঙ্কিত হল এই ভেবে যে, এই অবস্থা বিদেশি আগ্রাসনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে।
সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে অন্তরীণ করা হল। অথচ জেনারেল জিয়াউর রহমান সৈনিকদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তারা তাকে একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই জানত। তার অন্তরীণ অবস্থা সৈনিকরা বিদেশি শক্তির ক্রীড়নকদের কাজ হিসেবে গণ্য করেছিল।
এই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীতে জাসদের ফ্যাকশন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারা সৈনিকদের মধ্যে নানারকম প্রচার-প্রচারণা চালাতে শুরু করে। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা সৈনিকদের দাবি হিসেবে ১২ দফা দাবিও প্রচার করে। এ রকম টালমাটাল পরিস্থিতিতে সৈনিকরা জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করে এবং তাকে তাদের দিশারির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে।
৬ নভেম্বর মধ্যরাতে সিপাহিরা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে কামানের গোলা ছুড়ে অভ্যুত্থানের সূচনা করে। তারা ‘জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিতে দিতে ট্যাংক ও সৈন্যবাহী ট্রাক নিয়ে ঢাকার রাজপথে নেমে পড়ে। তারা নানা ধরনের অস্ত্রও বহন করছিল এবং সেগুলো থেকে অনবরত গুলি ছুড়ছিল।
সাধারণ মানুষ সৈনিকদের সঙ্গে মিছিলে অংশগ্রহণ করেছে। এজন্যই এই অভ্যুত্থানকে সৈনিক-জনতার অভ্যুত্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
সৈনিকরা ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ স্লোগানও দিচ্ছিল। এই অভ্যুত্থানের অবশ্যম্ভাবী পরিণতিস্বরূপ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফও নিহত হন।
শোনা যায়, জেনারেল জিয়া খালেদ মোশাররফের প্রাণরক্ষার জন্য খুবই চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু উত্তেজিত সৈনিকদের হাত থেকে তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। এই অভ্যুত্থানের আরেকটি অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ছিল- জেনারেল জিয়ার স্কন্ধে দেশের দায়িত্ব অর্পিত হওয়া।
অনেকে জেনারেল জিয়াকে ক্ষমতার জবরদখলকারী হিসেবে চিহ্নিত করেন। কিন্তু বাস্তবতা হল ক্ষমতা নেয়ার জন্য তিনি নিজ থেকে কিছু করেননি। ইতিহাস যখন রচিত হচ্ছিল তখন তিনি ছিলেন অন্তরীণ। এ কারণেই তাকে ক্ষমতার জবরদখলকারী হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। ক্ষমতা তার ওপর অর্পণ করা হয়েছিল।
এছাড়া দেশ ওই সময় বলতে গেলে নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েছিল। এ রকম একটি অবস্থায় যিনি সৈনিকদের মধ্যে বিপুলভাবে জনপ্রিয় এবং যিনি ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান জানিয়েছিলেন চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে, যার ফলে তার নাম বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পরিচিত হয়ে উঠেছিল, জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের জন্য অধিকতর উপযুক্ত আর কে ছিলেন?
৭ নভেম্বরের ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে আরেকটি নাম বড় হয়ে দেখা দেয়, তিনি হলেন কর্নেল আবু তাহের। তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। তার দেশপ্রেম নিয়েও সন্দেহের অবকাশ নেই। তিনি বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার প্রাণপুরুষ ছিলেন।
কিন্তু সময় থেকে অনেক অগ্রবর্তী চিন্তাভাবনা ছিল তার। তিনি যাদের সঙ্গে রাজনৈতিক সংসর্গ বজায় রাখতেন তাদের ভ্রান্তিবিলাসের কারণে তার মতো একজন বীরযোদ্ধার অনভিপ্রেত মৃত্যু ইতিহাসের জটিল গ্রন্থিগুলোকে আরও জটিল করে তুলেছে। ঐতিহাসিকরা একদিন এই গ্রন্থিগুলো উন্মোচন করবেন। সেই অপেক্ষায় থাকাই শ্রেয়।
৭ নভেম্বরের ঘটনাবলী জাতির জন্য কিছুটা হলেও বিপদের সৃষ্টি করেছিল। সৈনিকদের মধ্যে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সেনাবাহিনীর মূল কাঠামোকে ভেঙে ফেলার পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। এই দুর্যোগে জেনারেল জিয়ার অদম্য সাহস ও দেশপ্রেম সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে এবং কমান্ড স্ট্রাকচার পুনর্গঠিত করতে বিপুল অবদান রেখেছিল।
সেদিন যদি সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না হতো, তাহলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীবিহীন অবস্থার মধ্যে পড়ে যেত এবং আধিপত্যবাদের ছোবলে পড়ে বাংলাদেশ হতো ক্ষতবিক্ষত। এর মধ্যেই নিহিত আছে সংকটকালীন পুরুষ জেনারেল জিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব। ৭ নভেম্বরের পরে দেশে ১৯ বার ক্যুর প্রচেষ্টা হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। কিন্তু জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বগুণে শেষটি ছাড়া অপর সবক’টি ক্যু প্রচেষ্টা থেকে দেশ বেঁচে যায়।
কিন্তু চট্টগ্রামে হওয়া সর্বশেষ ক্যু প্রচেষ্টায় জেনারেল জিয়া শাহাদতবরণ করেন। জেনারেল জিয়ার লিগেসি আজও অব্যাহত। দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছে তার নামটি অত্যন্ত প্রিয়।
ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন