এস কে সিনহা : শেষ হয়েও হলো না শেষ
08 November 2017, Wednesday
ছুটিতে থাকা বাংলাদেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা আগামীকাল ১০ নভেম্বর শুক্রবার পর্যন্ত ছুটি বাড়িয়েছেন। এর আগে ২ নভেম্বরের আগ পর্যন্ত তার ছুটিতে থাকার কথা ছিল। আওয়ামী লীগের সাথে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলতে চায়, সিনহা আর স্বপদে ফিরবেন না। আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল এরই প্রতিধ্বনি করেন মাত্র। এ ব্যাপারে সরকারি দলের নেতাদের কারো কারো ভাষা অত্যন্ত রূঢ় এবং কঠোর। তারা বোঝাতে চান, চাপ সহ্য করতে না পেরে যে প্রক্রিয়ায় তাকে ছুটি নিয়ে বিদেশে চলে যেতে হয়েছে, একই কারণে ও প্রক্রিয়ায় তিনি বিদায় নিয়ে সরে দাঁড়াতে বাধ্য। সম্ভবত এর মোকাবেলায় এস কে সিনহা পদত্যাগ করে তার অবস্থান ও প্রতিবাদটা ইতিহাস করে রাখতে চান। যদিও আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি সময় ক্ষেপণ করতে পারেন। কাউকে বিব্রত না করে নিজেও বিব্রত না হয়ে অবসরকালীন ছুটিতে চলে যেতে পারতেন।
বর্তমান সরকারপন্থী মানসিকতাসম্পন্ন বা একই ধরনের রাজনৈতিক ভাবাদর্শে বিশ্বাসী আইনজীবীরা চাচ্ছেন সাপ মরুক, লাঠিও না ভাঙুক। অর্থাৎ এস কে সিনহাকে জোর করে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়ার আর প্রয়োজন নেই। সরকার এবং রাষ্ট্রশক্তির নানা অদৃশ্য চাপ মোকাবেলা করে তিনি আর মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারবেন না। তাই নানা বাহানায় ছুটি বাড়িয়ে তিনিই বিদায় হয়ে যাবেন পত্রপাঠ ছাড়াই। কারণ তার স্বাভাবিক বিদায়ের মেয়াদটা তাতেই বরফের মতো গলে যাবে। তাই সরকারকে নতুন দায় নেয়ার গরজ বোধ করতে হবে না। আওয়ামী লীগ প্রমাণ করতে চায়- তারা পারে এবং এ দেশে তাদের কথাই শেষ কথা। তা ছাড়া তারা এতটাই সক্ষম যে, তাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে কারো পক্ষে টেকা সম্ভব নয়। এ দৃষ্টান্তটুকুও রাখতে চায়, সরকারের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুললে কারো পরিণতি সুখকর হওয়ার নয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন ভিন্ন কথা। এস কে সিনহা পদত্যাগ করা মানে সরকারের বিজয় নয়, সুদূরপ্রসারী পরাজয়। বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপের যেসব কথা সিনহা বলেছেন, সরকার সাক্ষীসাবুদ ছাড়াই সেগুলো বেদবাক্য বানিয়ে দিচ্ছে।
এ ছাড়া সরকার চাইছে চলতি মাসের মধ্যেই ষোড়শ সংশোধনী-বিষয়ক রায়ের বাতিল চেয়ে রিভিউ করার সব আয়োজন সম্পন্ন করতে। সম্ভবত সরকার এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত চায় না, রিভিউর টার্গেট হলো- প্রাথমিকভাবে প্রক্রিয়াগত সুযোগের মাধ্যমে রায়টা স্থগিত হয়ে যাক। তবে একটা প্রবল মত হচ্ছে, পুরো রায় বাতিল চাইলে আপিল বিভাগকে ইউটার্ন নিতে হয়। তা সচরাচর হয় না। রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে রিভিউ চাইলে কিছু শব্দ ও বাক্যগত পরিবর্তন সম্ভব হতেও পারে। কারণ আপিল বিভাগ সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি আঁচ করতে পারে বলে একধরনের সমন্বয়চিন্তাকে মাথায় নিতেও পারে।
এই ইস্যুতে বিতর্কটা যখন তুঙ্গে উঠেছিল, তখন এস কে সিনহার বরাতে একটা খবর বেরিয়েছিলÑ ভুল বোঝাবুঝি অপনোদনের স্বার্থে কিছু শব্দগত পরিবর্তন সম্ভব, যদিও আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে রায়ের পর্যবেক্ষণে আপত্তিকর কিছু নেই। অ্যাটর্নি জেনারেলের উপস্থাপিত যুক্তিগুলো খণ্ডন করতে গিয়ে পর্যবেক্ষণে কিছু বিষয় উঠে এসেছে, যা বাস্তব। পুরো রায়টা বাতিল করে দিলে জনগণ যে বার্তাটা পাবে সেটা আপিল বিভাগ অনুমান করতে পারে না, তা তো নয়। তার ওপর আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য ও ভূমিকা প্রায় ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এমন কি রাষ্ট্রপতিও আলোচনার ঊর্ধ্বে থাকছেন না।
ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে আইনাঙ্গনে ইতোমধ্যে তোলপাড় হয়ে গেছে। মেরুকরণটাও হয়েছে পক্ষে-বিপক্ষে। রাজনীতিবিদেরা হয়তো আপিলের রায় নিয়ে উচ্চবাচ্য করবেন না। কিন্তু আইনাঙ্গনে তোলপাড় করা ঘটনাটা হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে না। এর সাথে রাজনীতির সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকবে না। তাই সরকারপন্থী আইনজীবীরা রিভিউ চান, কিন্তু এ নিয়ে টানটান উত্তেজনার জন্ম দিয়ে জাতীয় নির্বাচনের আগে বড় ধরনের বিতর্কের মাধ্যমে আরো বড় ক্ষতির সম্মুখীন হতে চান না।
সাধারণত মানুষ টিকে থাকে রক্ত কিংবা আদর্শের উত্তরাধিকারের কার্যকর তৎপরতার মাধ্যমে। এস কে সিনহার রক্তের উত্তরাধিকার বলতে কিছু নেই। আদর্শের উত্তরাধিকারও নেই। তার পক্ষে যত সব সিমপ্যাথি, সবটুকু ষোড়শ সংশোধনীকেন্দ্রিক এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পক্ষেও নির্বাহী বিভাগের অনাকাক্সিক্ষত হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে। তিনি মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছেন, এই ইস্যুতে তার তিক্ত সত্য উচ্চারণের কারণেই। এই সমর্থন ও সিমপ্যাথি অনেকটা নেগেটিভ ভোটের মতো। যেমন মানুষ পছন্দের প্রার্থী না পেলে সবচেয়ে অপছন্দের প্রার্থীর বিজয় ঠেকানোর জন্য ওই প্রার্থীর মোকাবেলায় সম্ভাব্য নিকটতম প্রার্থীকে ভোটটা দিয়ে মনের ক্ষোভ প্রশমন করে। এটা অনেক ‘সময় ঠেকানোর’ রাজনীতির মতো। এই জাতি কখনো কখনো নৌকা ঠেকাতে ধানের শীষ বাছাই করেছে। আবার ধানের শীষকে হারিয়ে দিতে নৌকায় সিল মেরেছে।
এস কে সিনহা নিয়ে আমাদের অনুরাগ বিরাগ কোনোটাই নেই। বরং তার কোনো কোনো অভিমত ও রায় নিয়ে দুঃখবোধ লালনের সুযোগ আছে। তার পরও রায় নিয়ে প্রশ্ন তোলা মানে, আইন-আদালতের প্রতি অশ্রদ্ধা পোষণ করা। সেটা আমাদের মতে, গর্হিত কাজ। মানুষের দেয়া রায় শতভাগ নিরপেক্ষ হয় না। এর একটি কারণ হলো, মানবিক সীমাবদ্ধতা। দ্বিতীয় কারণ প্রচলিত আইনের ফাঁকফোকর, তদন্তের দুর্বলতা এবং সাক্ষীর সততার প্রশ্নও থেকে যায়। এই সীমাবদ্ধতার জন্যই আদালতে আখেরাতের প্রয়োজনটা শুধু বিশ্বাসের বিষয় নয়, যুক্তিরও একটি গ্রাহ্য বিষয়।
আমরা কোনোভাবেই বিচার বিভাগের ভাবমর্যাদা এবং স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পক্ষে সমর্থন জোগাতে পারি না। কিন্তু সরকার যখন বিচার বিভাগ নিয়ে টানাহেঁচড়া করে, তখন আমরা নাগরিক হিসেবে সংক্ষুব্ধ হই। বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়াকে দায়িত্ব ভাবি।
রাজনৈতিক সরকারগুলো ঢালাও প্রতিশ্রুতির বাইরে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে বেশি ভাবতে আগ্রহী হয়নি। ‘এক-এগারো’র সরকার উদ্যোগ নেয়; মাসদার হোসেন মামলার রায় অনুসরণের দায় বোধ করে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো সম্পন্ন করে। তাও ১০ বছর হতে চলল। এখনো নি¤œ আদালতের শৃঙ্খলা বিধান নিয়ে একটি উদ্যোগ নির্বাহী বিভাগের সময়ক্ষেপণ নীতির কারণে ঠেকে আছে। এক-এগারো সরকার বিচার-আচার নিয়ে কম কারসাজি করেনি। কিন্তু বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে তৎকালীন উপদেষ্টাদের সদিচ্ছা অস্বীকার করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
উচ্চ আদালতপাড়ায় প্রধান বিচারপতির ইস্যু এখনো উত্তাপ ছড়াচ্ছে। এর জের চলবে অনেক দিন। রেফারেন্স হবে বহু ক্ষেত্রে। এর মধ্যে উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগের একটি প্রক্রিয়া শুরুর কথা জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী। সম্ভবত দ্রুত বিচারক সঙ্কট কাটানোর লক্ষ্যে তিনি বিচারক নিয়োগের কথাটি জাতিকে অবহিত করেছেন। মামলাজট কাটাতে নতুন বিচারক নিয়োগ দেয়া ছাড়া উপায়ও নেই। অথচ বিচারক নিয়োগের জন্য এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়নি। ফলে যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তখন তাদের বিবেচনায় বিচারক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। তাতে দলীয় ভাবনা ও রাজনৈতিক আনুগত্যের বিষয়টিতে প্রাধান্য দিতে গিয়ে সততা, যোগ্যতা, মেধা ও বিচারিক সক্ষমতা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। সে কারণে সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগে স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হলে একটি সর্বজনীন ও গ্রহণযোগ্য নীতিমালা প্রণয়নের গুরুত্ব কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগে সংবিধানের আলোকে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করার দাবি দীর্ঘ দিনের। এটাও মানা জরুরি যে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা ছাড়াও আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হলে সুপ্রিম কোর্টে মেধাবী ও বিচারিক সক্ষমতার অধিকারী, সৎব্যক্তিত্ব ও নৈতিক মানে উন্নত আইনজ্ঞকে নিয়োগ দেয়া উচিত। তা ছাড়া ১০ বছরেও বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের কোনো সুফল মেলেনি। বরং রাষ্ট্রের অন্য দু’টি বিভাগের অনাকাক্সিক্ষত প্রভাবের কারণে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নতুন করে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে রয়েছে। উল্লেখ্য ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করা হয়েছিলÑ একমাত্র লক্ষ্য ছিল, বিচারক ও বিচার বিভাগ যাতে সব ধরনের প্রভাবমুক্ত থেকে জন-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকেও এ ধরনের দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। উল্লেখ্য হাইকোর্ট একটি রিট পিটিশনে গত ১৩ এপ্রিল দেয়া রায়ে বিচারকদের বর্তমান নিয়োগপ্রক্রিয়া আরো স্বচ্ছ, কার্যকর ও বস্তুনিষ্ঠ করার প্রয়োজনে সাতটি যোগ্যতা নির্ণায়ক শর্ত উল্লেখ করেছেন। এর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে সংবিধানের ৯৫(২) অনুচ্ছেদ অনুসৃতির দায়ও পূরণ করা সম্ভব।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির অনুযোগ হচ্ছে, আইনমন্ত্রী সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগে নতুন বিচারপতি নিয়োগের ঘোষণা দিয়েছেন; কিন্তু তিনি বিচারক নিয়োগের নীতিমালা কিংবা নিয়োগের ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের নির্দেশনা সম্পর্কে কিছুই বলেননি।
শেষ কথা হচ্ছে, প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার কোনো ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আগ্রহ দেখানোর দায় আমাদের নেই। সবটুকু দায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে নগ্নহস্তক্ষেপের প্রতিবাদ জানানোর জন্য। এখনো সিনহার সাথে আমাদের বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিকতার সম্পর্ক নিবিড়। রাষ্ট্রপতি ক’দফা অভিযোগ তুললেন, সেটা সময় বিবেচনায় একেবারে গৌণ। জাতিকে এতটা নির্বোধ ভাবলে একজনকে ঠেকাতে গিয়ে নিজেরাই ঠেকে যাওয়ার কারণ সৃষ্টি হবে না- সে নিশ্চয়তা কে দেবে? তা ছাড়া এস কে সিনহা ইস্যু যে দিকে যাচ্ছে তাতে তার পদত্যাগেই এই ইস্যুর নিষ্পত্তি হবে না। শেষ হয়েও শেষ না হওয়ার একটা রেশ ও পথ খোলা থেকে যাবে!
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন