‘এ আকাশকে সাক্ষী রেখে/ এ বাতাসকে সাক্ষী রেখে/ তোমাকে বেসেছি ভালো/ তুমি মোর নয়নের আলো।’ এটি বাংলা সিনেমার একটি জনপ্রিয় গান। এই কিসিমের গান নারী জাতির যতটুকু উপকার করেছে, অপকার করেছে তার চেয়ে অনেক বেশি। এ রকম আকাশ-বাতাস বা চাঁদ-সুরুজকে সাক্ষী রেখে কত মেয়ের যে সর্বস্ব লুট হয়েছে- তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
শুধু প্রেমের জগতে নয়, রাজনীতির জগতেও এই চাঁদ-সুরুজের ব্যবহার রয়েছে। নর-নারীর প্রেম-ভালোবাসার মতো আমাদের গণতন্ত্রেরও চাঁদ-সুরুজ হলেন বৃহত্তম গণতন্ত্রের দাবিদার একটি দেশ। সেই চাঁদ-সুরুজকে সাক্ষী রেখে বা তার ওপর ভরসা করে এ দেশে নতুন গণতন্ত্র শুরু হয়েছে। ‘নেত্রী যত দিন বাঁচবেন, তত দিন প্রধানমন্ত্রী থাকবেন’- এমন সুখবর দিয়েছেন আওয়ামী লীগের একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ঠাকুর ঘরে কে- তা জানতে না চাইলেও কাদের সাহেব জানিয়েছেন, ‘এই চাঁদ-সুরুজ আগে কখনোই কলা খায়নি, ভবিষ্যতেও কোনো কলা খাবে না।’
সুজাতা সিংরা এভাবে কলা খেয়ে ধরা না খেলেও শনির হেরফেরে ধরা খেয়েছেন গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি। ঝিলিক নামের একটি মেয়ে তার সন্তানের পিতা হিসেবে ভিসির নাম বলেছেন। ২১ মিনিটের ভিডিওতে তার সেই করুণ কাহিনী তুলে ধরেছেন কিছু অনলাইন সাংবাদিক। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সেই মেয়ে পুনরায় সংবাদ সম্মেলন করে সেই অভিযোগ প্রত্যাহারও করে নিয়েছেন।
দেশের অনেক মানির মান এভাবে রক্ষা পেলেও আস্থার জায়গাটি মনে হয় ফেরত আসবে না। এখানে মিথ্যা অভিযোগ তোলার জন্য হয় মেয়েটার শাস্তি হওয়া দরকার, নতুবা অভিযুক্ত ব্যক্তির। এই মহামান্য ব্যক্তিকে অপবাদ থেকে বাঁচানোর জন্য শিশুর ডিএনএ টেস্ট করা প্রয়োজন। তা না হলে বেনিফিট অব ডাউট ওই মেয়ের পক্ষেই যাবে। বিষয়টি সঠিকভাবে অনুসন্ধান না করলে এই সমাজ সত্যি একদিন জঙ্গলে পরিণত হতে পারে।
মেয়েটি তার প্রথম ভিডিওতে জানিয়েছিলেন, ভিসি সাহেব তাকে মাস্টার রোলে চাকরি দিয়েছিলেন। তারপর আকাশ-বাতাস বা চাঁদ-সুরুজকে সাক্ষী রেখে বলেছিলেন ‘তুমিও এতিম, আমিও এতিম, তুমি আমার কষ্ট বুঝবে- আমি তোমার কষ্ট বুঝব।’
এ দুই এতিম তারপর ভিসির বাংলোতে ‘একান্তে’ অনেক সময় কাটান। এক এতিমের কষ্ট অন্য এতিম ঠিকঠাকমতো বোঝাতেই এক বছর আগে তিন নম্বর এতিমটির জন্ম হয়েছে। মায়ের দাবি ছিল, তার সন্তানের পিতা ভিসি। এরপর ওই মেয়ে আরো অনেক কথা জানিয়েছেন।
পেটের সন্তান নষ্ট করার জন্য সম্ভাব্য সব উপায় ব্যবহার করে তাকে চাপ দেয়া হয়েছে। তাতে অসফল হওয়ায় মাঝখানে মা ও সন্তানকে এক বছরের ভরণপোষণ দিতে বাধ্য হয়েছেন কথিত পিতা। মাঝখানে ফাঁক বুঝে চুরির অপবাদ দিয়ে ভিসির বাংলো থেকে বের করে দিয়েছেন। তখনই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে বিষয়টি দেশবাসীর গোচরে আসে।
একটা গোঁজামিল দিয়ে এমন উপাখ্যান বন্ধ করা গেলেও তিন বছর আগে বৃষ্টি নামের এক মেয়ের ক্ষেত্রে তা করা যায়নি। ১৯ বছরের ঝিলিকের মতো ২২ বছরের সেই বৃষ্টি এতিম বা অসহায় ছিলেন না। তিনি ছিলেন কাফরুল থানা ছাত্রলীগের ছাত্রীবিষয়ক সম্পাদিকা। ওই ঘটনার নায়ক ছিলেন মিরপুরের একটি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি।
এই মহামান্যও হয়তো বা একই স্বরে শিকারকে বলেছিলেন, তুমিও লীগ আমিও লীগ, তুমি আমার কষ্ট বুঝবে- আমি তোমার কষ্ট বুঝব। এই অতিমাত্রায় বোঝাবুঝির কারণেই যা ঘটার তা ঘটে যায়। ছাত্রলীগের বাঘা নেত্রী হয়েও এই হতভাগিনী বৃষ্টি চাঁদ-সুরুজের পরিণতি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি।
‘শিক্ষা, প্রগতি ও শান্তি’র পতাকাবাহী সংগঠনটির ওই পাতিনেতা আকাশের চাঁদ-সুরুজকে সাক্ষী রেখে মেয়েটির সব সম্পদের দখল নিয়ে নেন। তারপর চাঁদ-সুরুজের মতো নীরব সাক্ষীর নীরবতায় আসল চেহারা দেখান সেই সোনার ছেলে। তবে একা নয়- পুরো দলই বলতে গেলে একই চেহারা প্রদর্শন করে এই ভাগ্যহত মেয়েটির প্রতি। অসহায় বৃষ্টি কেন্দ্রীয় নেতা-নেত্রীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে এর প্রতিকার চেয়েছিলেন। ‘আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে/মনে পড়ল তোমায়...’ এ ধরনের রোমান্টিক গান শুনে নস্টালজিক হলেও বাস্তবের এই বৃষ্টির কান্না কাউকে স্পর্শ করতে পারেনি। তাকে সাহায্য করতে কেউ এগিয়ে আসেননি।
অস্তমিত সূর্যকে সাক্ষী রেখে নেয়া অনেক শপথ- ‘কোনো রাজাকারের বাচ্চাকে কোনো দিন বিয়ে করব না’, এই তপ্তবাক্যগুলো নতুন করে দিব্যজ্ঞান খুলে দেয় গর্তে পড়ার পর এই মেয়েদের। তখন বুঝতে পারে, দেশের মানুষকে এই কিসিমের শপথ পড়িয়ে কেন নিজের মেয়ের জন্য রাজাকারের পরিবারের ছেলেকে বেছে নেন! দেখা যাচ্ছে ‘রাজাকারের বাচ্চা’ গালি দিয়ে শুধু নেত্রীরা তাদের বিগড়ে যাওয়া মেজাজ ঠিক করলেও নিজের রাজকন্যাদের পাণি গ্রহণে এদের ব্যবহার করা হয়।
সারা দেশের অজস্র বৃষ্টির কান্না আমাদের কানে পৌঁছে না। এ ধরনের বেশির ভাগ ঘটনার পেছনে যে নামটি ভেসে আসে, তা হলো ছাত্রলীগ বা যুবলীগ। এমনকি ওলামা লীগের নামটিও এই তালিকা থেকে বাদ পড়েনি। উত্তরবঙ্গের এক মাদরাসার সুপারিনটেন্ডেন্টের কাহিনী এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। ‘পুলিশ লীগ’ও এই মহৎকর্মের তালিকা থেকে বাদ পড়েনি। ডিআইজি পদবির এক কর্মকর্তাও একই কিসিমের অপরাধে অভিযুক্ত হয়েছেন। এক মহিলা সাংবাদিককে ৬৪টি টুকরো করার হুমকি দেয়া হয়েছে। এই বাঘা অফিসারের হুমকি শুনে যে কারো অন্তরাত্মা কেঁপে উঠবে। এ দেশের ঝিলিকরা চার দিকে বিপদের ঝিলিক দেখছেন।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পুরো দেশই এসব শক্তিশালী পুরুষের কাছে রাজা-বাদশাহদের হেরেমের মতো হয়ে পড়েছে। এদের পৌরুষের উত্তাপে শুধু দেশের অবলা নারীরাই নন, সেই উত্তাপে দগ্ধ হচ্ছে সারা দেশ। চট্টগ্রামের এক অধ্যক্ষকে জনৈক ছাত্রনেতা মারধর করেছেন। পাশে পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখেছে। সেই একই নেতা আবার এক কোচিং মালিককে রজনীকান্ত স্টাইলে সিগারেট পান করতে করতে উত্তম-মধ্যম দিয়েছেন। সেই ভিডিওটিও পুরো জাতি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছে।
এগুলো নিয়ে একটু চিন্তাভাবনা করলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন মনে উদয় হয়, একই আলো-বাতাসে থাকলেও এবং গতরে একই ধরনের শিহরণ থাকলেও শুধু ‘লীগ’ নামক শব্দটি বেশি শোনা যাচ্ছে কেন?
ঢাবির প্রাক্তন ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আন্দোলনরত ছাত্রদের বলেছেন, পুরো সিস্টেমকে বিবেচনায় না নিয়ে বা সমস্যার রুট কজ অ্যানালাইসিস না করে কোটা সংস্কারের মতো বিক্ষিপ্ত কোনো দাবি কখনোই বাস্তবায়ন হবে না।
কোনো দল নয়- বরং একটি সিস্টেমই এশা, জনি, তুফান, বদরুল কিংবা ডিআইজি মিজানদের তৈরি করে থাকে। যে কেউ যেকোনো সময় এদের শিকার হতে পারেন। সারা দিন ‘জয় বাংলা’ জপলেও হয়তো বা কাজে লাগবে না।
একটি বিষয়ের প্রতি সমাজচিন্তকদের দৃষ্টি আকর্ষিত হবে বলে আশা করছি। ওই ঘটনায় সভাপতির হাতে নিগৃহীত হয়েছিলেন একই দলের সম্পাদিকা। এখানে জেন্ডার ফ্যাক্টর কাজ করলেও সুফিয়া কামাল হলের সভাপতির হাতে নিগৃহীত হয়েছেন একই সংগঠনের একই জেন্ডারের অন্য এক নেত্রী। অর্থাৎ প্রচ্ছন্ন বা প্রকাশ্য ফ্যাসিবাদে সব স্তরের সভা‘পতি’ই বাদবাকিদের পতি বা যম হয়ে পড়েন। নর্থ কোরিয়ায় দুই নম্বর ক্ষমতাধর ব্যক্তি সেখানকার সর্বেসর্বা এক নম্বরের ক্রোধ বা আক্রোশের শিকার হয়েছেন। সম্পর্কটা ছিল অনেকটা খুব ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার। এ রকম একজন শক্তিশালী স্বজনকেও ক্ষুধার্ত কুকুর দিয়ে ভক্ষণ করানো হয়েছে। এটাই ফ্যাসিবাদের চিরাচরিত চেহারা। এই মতবাদকে নিয়ে ভয়ের কারণ এখানেই। উন্নয়নের ভেলকি দেখিয়ে আমাদের সেদিকেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
সুফিয়া কামাল হলের অপরাপর ছাত্রীদের লক্ষ করে এশার ভয়ঙ্কর হুমকি দস্যুরানী ফুলন দেবীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে অধ্যয়নরত এক বাঙালি মেয়ের মুখে পুরুষালী স্ল্যাং শব্দটি (চুলের হিন্দি উচ্চারণ) অন্য অনেকের মতো আমারও প্রথম শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। ওই হলের প্রভোস্ট ভার্সিটির শিক্ষক হয়েও কম যাননি। তিনিও দস্যুরানী স্টাইলে হলের মেয়েদের শাসিয়েছেন। দুই হাজার ছাত্রীর ছাত্রত্ব বাতিল ও রাষ্ট্রের গোয়েন্দা বাহিনী দিয়ে ধরিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এক বিখ্যাত কবি অভিহিত করেছিলেন ‘ডাকাতদের গ্রাম’ হিসেবে। এখন মনে হচ্ছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মহিলা হলগুলো ‘দস্যুরানীদের আস্তানা’য় পরিণত হয়েছে।
কোটা সংস্কারের আন্দোলন করতে গিয়ে দেশের সবচেয়ে সুস্থ ছাত্রসমাজকে মধ্যরাতে কাউন্সেলিংয়ের জন্য পাঠানো হয়। কিন্তু সমাজে সবচেয়ে অসুস্থ সুফিয়া কামাল হলের প্রভোস্ট কাম-যুবলীগ নেত্রী কিংবা ঢাবির বর্তমান ভিসির মতো ব্যক্তিত্বহীন লোকদের কাউন্সেলিংয়ের দরকার বেশি। বর্তমান সমাজ ও দেশকে সুস্থ করতে হলে এর বিকল্প নেই। এদের কাউন্সেলিংয়ে পাঠানোর মতো কঠিন কাজের দায়িত্ব অবশ্যই সচেতন নাগরিকদের নিতে হবে।
২.
বিপদে পড়েছে তার রেখে যাওয়া এই দেশটি। বৃষ্টির নাগরের মতোই চাঁদ-সুরুজকে সাক্ষী মেনে অবৈধ পন্থায় ক্ষমতা দখল করেছে সরকার। ঘরে ঘরে চাকরি এবং ১০ টাকা কেজি চাল খাওয়ানোর স্বপ্ন দেখানো হয়েছে। ওবামার নির্বাচনী ওয়াদা চেঞ্জকে নকল করে এ দেশেও পরিবর্তনের প্রলোভন দেখানো হয়েছে। পড়শিকে ট্রানজিট দিলে দেশটি সিঙ্গাপুর হয়ে যাবে, এমন সুখস্বপ্ন দেখানো হয়েছে। সুখস্বপ্নে কাতর দেশবাসী বলেছে, বলো বলো/ আরো বলো/ লাগছে মন্দ নয় ...।
এখন বাজিকরদের কাছে দেশের মানুষ অসহায়। আজ আমজনতার আম আর ছালা দুটোই গেছে। দেশের সার্বভৌমত্ব এবং অর্থনীতি উভয়ই বিপন্ন। অনেকেই প্রশ্ন করেন, এ অবস্থা থেকে উদ্ধার পাওয়ার উপায় কী? উপায় একটাই- উন্নয়নের ভেলকি সম্পর্কে নিজে জানা এবং অপরকে জানানো।
আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন স্বাধীনতার পেছনে অবদানের জন্য বীরশ্রেষ্ঠ, বীর উত্তম, বীরবিক্রম এবং বীর প্রতীক উপাধি দেয়া হয়েছিল। আজ দেশের সেই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিসর্জনের জন্যও বিপরীত ঘরানার উপাধি দেয়ার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
সেই উপাধিগুলো হতে পারে দালাল শ্রেষ্ঠ, দালাল উত্তম, দালালবিক্রম ও দালাল প্রতীক। একইভাবে জনগণের সম্পদ লুট এবং তাতে সহযোগিতার জন্যও লুটেরা শ্রেষ্ঠ, লুটেরা উত্তম, লুটেরাবিক্রম ও লুটেরা প্রতীক উপাধি দেয়া জরুরি। এ কাজটি ছাড়া জনগণের সামনে অন্য কোনো উপায় নেই।
বাজিকরদের মহালুটপাটকে নানা কিসিমের হাস্যকর ও প্রশ্নবিদ্ধ বিদেশী স্বীকৃতি দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। তন্মধ্যে অন্যতম ভেলকি হলো- ‘উন্নয়নশীল’ দেশের তকমা। ১৬-১৭ কোটি মানুষের সম্পদ শোষণ করে জমা হচ্ছে কয়েক লাখ লুটেরা বা সুবিধাভোগীর কাছে। কিন্তু মাথাপিছু আয় সবার উন্নতি হিসেবে প্রদর্শিত হচ্ছে। ২০১৬-১৭ সালে আমাদের মাথাপিছু গড় আয় দেখানো হয়েছে এক হাজার ৬১০ ডলার। যারা এ সংখ্যাটি বাস্তবের চেয়ে একটু বেশি দেখাতে উৎসুক, তারা কায়দা করে জনসংখ্যা একটু কম দেখালেই কাজটি সহজ হয়ে পড়ে। যা হোক, সবার সমীপে একটা হিসাব দিয়ে আজকের লেখার ইতি টানছি। হিসাবটি ভালো করে খেয়াল করুন।
২০০৭ সালে গাড়ি চুরির দায়ে অভিযুক্ত জনৈক ভাগ্যবান ব্যক্তি ২০১৭ সালের মধ্যেই পাঁচ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ পেয়েছেন। এই আলাদিনের চেরাগ পেতে তাকে সহযোগিতা করেছেন মৌলবাদী অর্থনীতির বিরুদ্ধে এক প্রগতিবাজ জেহাদি। ওই ভদ্রলোক গত ১০ বছরে প্রতি বছর সম্পদ আহরণ করেছেন ৫০০ কোটি টাকা, যা ডলারে কনভার্ট করলে হয় প্রায় ছয় কোটি ডলার। ওই হিসাবে তিনি একাই ৩৭ হাজার মানুষের প্রত্যেকের আয় এক হাজার ৬১০ ডলারে উন্নীত করে ফেলেছেন। এ ধরনের লুটেরা শ্রেষ্ঠের সংখ্যা যদি দেশে ৫০ জন হয়, তাহলে ৩৭ হাজার জন দ্ধ ৫০ = ১৮ লাখ ৫০ হাজার জন একদম জিরো ইনকাম ব্যক্তির বার্ষিক আয় কাজির কিতাবে এক হাজার ৬১০ ডলার করে ভেসে উঠেছে।
পরের ধাপের লুটেরা, যাদের বলতে পারি লুটেরা উত্তম; তাদের সংখ্যা ধরে নেই ১০ গুণ বা ৫০০। তাদের গড় লুট বছরে ৫০ কোটি টাকা, যা ডলারে হয় ৬০ লাখ ডলার। ফলে ওপরের হিসাব মতে, প্রতিজন ‘লুটেরা উত্তম’-এর লুট করা সম্পদ দিয়ে তিন হাজার ৭০০ জন কপর্দকহীন মানুষের আয় এক হাজার ৬১০ ডলার দেখানো যাবে। ফলে ৫০০ জন লুটেরা উত্তমের সম্পদ দিয়ে তিন হাজার ৭০০ দ্ধ ৫০০ = ১৮ লাখ ৫০ হাজার জন সম্পূর্ণ ফকিরের আয় এক হাজার ৬১০ ডলার দেখানো সম্ভব।
তেমনিভাবে লুটেরাবিক্রমের সংখ্যা হবে সারা দেশে পাঁচ হাজার। ধরে নেই, তাদের মাথাপিছু লুটের পরিমাণ বছরে পাঁচ কোটি টাকা বা ছয় লাখ ডলার। তাদের মাধ্যমে একই হিসাবে ৩৭০ দ্ধ ৫ হাজার = ১৮ লাখ ৫০ হাজার জন কপর্দকশূন্য মানুষকে উন্নয়নশীল দেশের মানে টেনে তোলা যায়।
পরের ধাপে আসে লুটেরা প্রতীক। এদের সংখ্যা একটু বেশি হয়ে থাকে। এরা মূলত সরকারি-বেসরকারি লুটেরা বাহিনীর মাঠপর্যায়ের কর্মী। ধরে নেই এদের সংখ্যা পাঁচ লাখ এবং লুটপাটের পরিমাণ প্রতি বছরে ৫০ লাখ টাকা বা ৬০ হাজার ডলার। এই পাঁচ লাখ লুটেরা প্রতীক ৩৭ দ্ধ ৫ লাখ = এক কোটি ৮৫ লাখ জন কপর্দকহীন মানুষের আয় এক হাজার ৬১০ ডলার করে তুলেছে।
অর্থাৎ লুটেরা শ্রেষ্ঠ, লুটেরা উত্তম, লুটেরাবিক্রম এবং লুটেরা প্রতীক- এই চার কিসিমের লুটেরা মিলে ১৮ লাখ ৫০ হাজার + ১৮ লাখ ৫০ হাজার + ১৮ লাখ ৫০ হাজার + এক কোটি ৮৫ লাখ = দুই কোটি ৪৫ লাখ ৫০ হাজার জন। অর্থাৎ প্রায় আড়াই কোটি শূন্য ডলার উপার্জনকারীর জন্য এক হাজার ৬১০ ডলার অর্জনকারীর ‘সম্মান’ এনে দিতে পারে।
বাস্তবে কোনো মানুষের আয় শূন্য হয় না। কিছু না কিছু আয় ফকিরেরও হয়। সেই হিসাবে, অতি দরিদ্র পর্যায়ের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের আয়কে উন্নয়নশীল ক্যাটাগরিতে পৌঁছে দিতে পারে ওই চার কিসিমের লুটেরারা। দেশের পাঁচ কোটি বেকার বা অর্ধ বেকারের আয়ের সাথেও হিসাবটি মিলে যায়। একেই বলা হয়, ‘খাচ্ছে আবদুুল, মোটা হচ্ছে রোস্তম’-এর অর্থনীতি। যেসব জ্ঞানপাপী প্রকৃত অবস্থা থেকে জনগণের দৃষ্টি ফিরিয়ে উন্নয়নের ভেলকি দেখাচ্ছে, তারা মূলত এই লুটতন্ত্রের সরাসরি বেনিফিশিয়ারি।
২০০৪ সালে যে দেশটিকে দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান ব্যাঘ্র (ঊসবৎমরহম ঞরমবৎ) বলা হয়েছিল, সে দেশটিকে ২০১৮ সালে উন্নয়নশীল দেশের ক্যাটাগরিতে ফেলায় (এটি ঘোষণা করা হবে ২০২৪ সালে) আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তোলা হয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের দুর্বল গণতন্ত্রের দেশগুলোর মধ্যে ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের একটা মেকানিজম আবিষ্কার করায় এই সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল। এটি এককভাবে কোনো দলের অর্জন নয়। এটি এই জাতির সার্বিক বা সমষ্টিগত অর্জন। সেই অপার সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে জাতিকে উন্নয়নের মুলা দেখানো হচ্ছে।
যুবসমাজকে শুধু নিজেদের চাকরির কথা ভাবলেই হবে না, দেশ ও জাতিকে রক্ষার চিন্তাও করতে হবে। পরেরটি নিয়ে ভাবলেই প্রথমটি ধরা দেবে। অন্যথায়, উন্নয়নের ভেলকি দেখে দেখে শুধু যৌবন নয়, জীবনও অতিবাহিত হয়ে যাবে।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন