নিরাপত্তা ও বিশ্ব রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টিতে ২০১৪ সালেই পৃথিবীতে স্নায়ুযুদ্ধকালীন ভূরাজনীতি ফিরে এসেছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ইউক্রেনে আক্রমণাত্মক হস্তক্ষেপ এবং ক্রিমিয়া দখলের প্রতিক্রিয়ায় ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে রাশিয়ার ওপর ব্যাপক অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয়েছে। ফলে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে রুশ সম্পর্কের অবনতি ক্রেমলিনকে উঠতি পরাশক্তি চীনের দিকে হাত বাড়াতে বাধ্য করেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠেছে, অতীতে রুশ-চীন সম্পর্কের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের বিপরীতে একটি রুশ-চীন মৈত্রী সম্পর্ক কি আদৌ গড়ে ওঠা সম্ভব? যদিও সাদামাটা দৃষ্টিতে এতে অসম্ভবের কিছু নেই বলেই প্রতীয়মান। প্রথাগত শক্তির ভারসাম্য তত্ত্ব এ কথাই বলে। শক্তির উপাদানগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্য ও আপেক্ষিক শ্রেষ্ঠত্বে সমতা আনতে পারে একটি সম্ভাব্য রুশ-চীন স্ট্র্যাটেজিক অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা। যদিও সেটাকে আমরা মৈত্রী বন্ধন বলতে অপারগ।
এ ধারণাকে যৌক্তিক প্রতীয়মান করতে পঞ্চাশের দশকের রুশ-চীন কৌশলগত অংশীদারিত্বের ঐতিহাসিক নজিরের প্রসঙ্গ আনা যেতে পারে। সে সময়ে অর্থাৎ বিগত শতকের পঞ্চাশের দশকে এমন একটি কৌশলগত অংশীদারিত্ব রাশিয়া ও চীনকে যৌথভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মোকাবেলায় দাঁড় করিয়েছিল। কিন্তু ১৯৭২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন যখন চীনের বন্ধ দরোজা উন্মুক্ত করতে পদক্ষেপ নিলেন এবং মার্কিন-চীন সম্পর্কে একটি নতুন মাত্রা সংযোজিত হল- তখন স্বাভাবিকভাবেই তা রুশ-চীন কৌশলগত অংশীদারিত্বে ইতি টেনেছিল। চীন-মার্কিন নৈকট্য অবশ্য তখন এ ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নের অপ্রতিরোধ্য উত্থান বিধ্বংসী হয়ে উঠবে অল্প সময়ের ব্যবধানেই। তাই ক্রেমলিনের ক্রমবর্ধমান শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা প্রতিরোধ করাকে উভয়েই নৈতিক দায়িত্ব ভেবেছিল।
তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বেশ কিছু সময় রুশ বিরোধিতাকে বাহুল্য মনে করেছিল চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই। ওয়াশিংটন ইতিহাসের সমাপ্তি তত্ত্বের গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিলে চীনও সোভিয়েত-উত্তর ইয়েলৎসিনের রাশিয়াকে তার বিপরীতে একটি ধ্বংসোন্মুখ শক্তি হিসেবে দেখে আসছিল। চীন ও বাকি বিশ্ব কোনোভাবেই রুশ শক্তির পুনরুত্থানের আভাস আঁচ করেনি। কিন্তু কেজিবির কুশীলব এবং ইয়েলৎসিনেরই আবিষ্কার ভ­াদিমির পুতিন রুশ রাজনীতির মূলমঞ্চে উঠে আসেন।
বিশ্বের প্রথম মহাকাশ জয়ী দেশ রুশ ফেডারেশন বা রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের অনেক আগে পিটার, ক্যাথরিন দ্য গ্রেট প্রমুখের শাসনামলে বিশাল সাম্রাজ্যের গোড়া পত্তন করেছিল। ছিল দেশটির ঈর্ষণীয় শিল্প-সাহিত্য স্থাপত্য। সোভিয়েত আমলের শাসকদের নীতিনির্ধারণে বিপথগামিতার কারণে রুশ বিপ্লবের এক শতাব্দী কম সময়ের মধ্যে সোভিয়েত ব্যবস্থা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশটি বিখণ্ডিত হয়। পুতিন নিজে সোভিয়েত ব্যবস্থাবিরোধী হয়েও সোভিয়েত আমলে অর্জিত রাশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বগুলো ধরে রাখতে চান জাতীয়তাবাদের এক নতুন সংস্করণের মধ্য দিয়ে।
বিশ্ব ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠত্ব ও অপরিহার্যতা স্বীকার করেও পুতিন বর্তমান ক্ষমতার বিন্যাসে রাশিয়ার আনুপাতিক অবস্থান নিশ্চিত করতে চান। এটাই পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে রাশিয়ার দ্বন্দ্বের কারণ। এক্ষেত্রে ভারসাম্য আনতে উঠতি শক্তি চীনের দিকে হাত বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় রাশিয়ার। পরাশক্তি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমা শক্তির সোভিয়েত শক্তিকে ঠেকানোর প্রয়োজনীয়তাও ফুরিয়ে যায় এবং চীন-মার্কিন সমঝোতারও পরিসমাপ্তি ঘটে। অতঃপর ক্ষমতাবিন্যাস ও বাস্তবতার আলোকে নতুন করে রুশ-চীন সৌহার্দ্য ও নৈকট্যের সূত্রপাত হয়। ২০০১ সাল থেকে আবার চীন-রাশিয়া সহযোগিতা শুরু হয় এবং উভয়ের প্রতিপক্ষের অবস্থানে ঠেলে দেয়া হয় একক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন ও রাশিয়া জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পরস্পরকে সমর্থন দিয়ে এসেছে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে একই ধরনের অবস্থান গ্রহণ করেছে।
২০০১ সালে এ বৃহৎ শক্তি দুটি বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। সম্প্রতি দুই দেশই জাতিসংঘ ইন্টারনেট বিধিমালা প্রণয়নে একই অবস্থানে ছিল। চীন ও রাশিয়া কূটনৈতিক বিধিনিষেধের কাঠামোর মধ্যে থেকেই ব্রিকস রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং সাংহাই সহযোগিতা সংগঠনে তাদের ভূমিকা ও তৎপরতা সাফল্যের সঙ্গে সমন্বয় করেছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে রুশ নেতা পুতিন ও চীনা প্রেসিডেন্ট জিনপিং চমৎকার বন্ধুসুলভ একটি রসায়নের উদ্ভব ঘটাতে পেরেছেন। এর ভিত রচনা করেছে সম্ভবত উভয় দেশে বর্তমানে বিরাজমান উদার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যা পশ্চিমা ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির সঙ্গে মারাত্মকভাবে সাংঘর্ষিক নয়। মতাদর্শগত ভিন্নতা সত্ত্বেও উভয় দেশই, বিশেষ করে চীন এটা উপলব্ধি করে যে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অর্থনীতি দিয়ে পশ্চিমা ধনতন্ত্রের অব্যাহত শ্রেষ্ঠত্বকে মোকাবেলা করা যাবে না। ফলে বিশ্ব ব্যবস্থায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা মৈত্রীর প্রভাব ও প্রাধান্যকে বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। তাই চীন অনেক আগেই দেং শিয়াও পিংয়ের প্রজ্ঞাকে পুঁজি করে চীনা অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির ধারা প্রবর্তন করে, যা এখনও অব্যাহত আছে। রাশিয়াও তার বিশাল জ্বালানি সম্পদের বদৌলতে স্থবির রুশ অর্থনীতিতে প্রাণসঞ্চার করেছে। রাশিয়া ও চীন তাদের নবলব্ধ অর্থনৈতিক শক্তি নিয়ে পরস্পরের সহযোগিতা করে নিজেদের ইতিমধ্যেই অর্জিত অর্থনৈতিক সাফল্যকে সর্বাধিক অনুকূল অবস্থায় নিয়ে যেতে সচেষ্ট। গত বছর মে মাসে ক্রিমিয়া দখলে নেয়ার অব্যবহিত পরই মস্কো চীন-রাশিয়া অর্থনৈতিক সহযোগিতার অংশ হিসেবে ৪০০ বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের বার্ষিক ৩৮ বিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস বেইজিংকে সরবরাহের ঘোষণা দেয়। উল্লেখ্য, এ গ্যাস সরবরাহ ৩০ বছর সময়কালের জন্য বিন্যস্ত করা হবে। অবশ্য এ গ্যাস সরবরাহের জন্য রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান গাজপ্রম এবং চীনের ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনকে চীনের হাইলং জিয়াং প্রদেশ পর্যন্ত আড়াই হাজার মাইল দৈর্ঘ্যরে গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ করতে হবে। যদিও এই পাইপলাইনের পেছনে ব্যয়ের পরিমাণ এখনও অজ্ঞাত, তবে অনুমান করা হয় এতে রাশিয়া চীনকে মোটা অংকের আর্থিক রেয়াত দিয়েছে।
এছাড়াও গত নভেম্বরে গাজপ্রম একটি চুক্তির খসড়া প্রকাশ করেছে, যার শর্তানুযায়ী রাশিয়া সাইবেরিয়া থেকে অন্য একটি পাইপলাইনে ৩০ বছরের জন্য চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ সিন জিয়াংয়ে ৩০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস সরবরাহ করবে। যদি এ সরবরাহগুলো চূড়ান্ত হয় এবং চীনে রাশিয়ার পক্ষ থেকে প্রায় ৬৮ বিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত হয়, তাহলে তা হবে রাশিয়ার সর্ববৃহৎ জ্বালানি ক্রেতা জার্মানির প্রাপ্য গ্যাসেরও অধিক। ফলে পশ্চিমা বিশ্বের ওপর রুশ নির্ভরতা বিপুলভাবে হ্রাস পাবে। এতে করে রাশিয়া ও চীনের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র বিস্তৃত হবে এবং সম্পর্কও নিবিড় হবে।
তবে চীন-রাশিয়ার সম্পর্কে এমন পারস্পরিক লেনদেনও কিন্তু নিষ্কণ্টক নয়। চীনকে বিপুল পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ সত্ত্বেও চীনের সঙ্গে রাশিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্কে বিরাজমান রুশ ঘাটতি পূরণে তা যথেষ্ট হবে না। কারণ চীন রাশিয়াকে পাঠাচ্ছে তৈরি পণ্য। পক্ষান্তরে রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্কের অবনতিতে রাশিয়া পশ্চিমা বিশ্বের প্রযুক্তি সুবিধাও হারিয়েছে। আসলে রাশিয়া-চীন মৈত্রী সহযোগিতা বা সমঝোতার সমস্যা আরও ব্যাপক ও গভীর। চীনের বিপুল জনসংখ্যা, বলিষ্ঠ অর্থনীতি ও সামরিক শক্তির আকার ইতিমধ্যেই জনবিরল রাশিয়াকে অস্বস্তিতে রেখেছে। জ্বালানি সম্পদের প্রাচুর্য একশ্রেণীর রুশ নাগরিককে সচ্ছলতা দিলেও দেশটির জাতিগোষ্ঠীগত বিভাজন বেশ জটিল। সম্ভবত এ কারণেই রাশিয়া ২০০৯ সালে বেশিসংখ্যক প্রতিপক্ষ ঘায়েলের লক্ষ্যে সামরিক বাহিনীর জন্য নতুন ডকট্রিন প্রণয়ন করে। বিশেষ করে এই প্রথম রাশিয়া তার পরমাণু শক্তির জন্য প্রথম নিক্ষেপণের সক্ষমতা নিশ্চিত করেছে।
এই অসাদৃশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয় না যে রাশিয়া চীনের সঙ্গে একটি নিবিড় সামরিক সমঝোতায় যেতে চাইবে। তবে পরস্পরের জন্য লাভজনক বিবেচিত ক্ষেত্রগুলোতে কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডের সমন্বয় সাধন হলে উভয়েরই তাতে আপত্তি থাকবে না। কিন্তু সেই পরিমাণ সমঝোতা সচরাচর ট্যাকটিক্যাল পর্যায়েই হয়ে থাকে, স্ট্র্যাটেজিক পর্যায়ে নয়। চীন রাশিয়ার সঙ্গে কতটা সহযোগিতা করতে পারবে সেক্ষেত্রেও একটা সীমাবদ্ধতা আছে। তাছাড়া চীনের উন্নয়ন কৌশলে রয়েছে বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে একীভূত হওয়ার প্রয়াস এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ও প্রযুক্তিতে প্রবেশের অভিপ্রায় ও প্রচেষ্টা। চীনের বর্তমান কমিউনিস্ট ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা বহির্বিশ্বে এবং দেশের অভ্যন্তরে নির্ভর করবে ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধির ওপর। চীন তার উচ্চ প্রবৃদ্ধি বহাল রাখার কৌশলকে একটি কর্তৃত্ববাদী রুশ মৈত্রীর দ্বারা ঝুঁকিতে ফেলতে চাইবে না। অতীতে চীন-সোভিয়েত মৈত্রী তখনকার চীনের দুর্বলতার কারণেই সম্ভব হয়েছিল। এখন আর চীনের সেই অবস্থা নেই। তাই চীন ও রাশিয়ার মধ্যে এতটা মৈত্রী গড়ে ওঠার সম্ভাবনা নেই, যা পশ্চিমা বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে।
এম আবদুল হাফিজ : নিরাপত্তা বিশ্লেষক, কলাম লেখক