ধর্ম নিয়ে আলোচনা কঠিন ‘ধর্ম’ নিয়ে আলোচনা করা কঠিন। প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে আধুনিকতা ‘ধর্ম’ নামক নামচিহ্নের মধ্য দিয়ে যে ধারণাকে সার্বজনীন বলে প্রতিষ্ঠিত করেছে, আমাদের চিন্তার ওপর তার আধিপত্য প্রবল ও প্রকট। কোনো একটি ধারণাকে সার্বজনীন গণ্য করলে পর্যালোচনামূলক চিন্তার জন্য সেটা বিশাল প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।
যিনি এ ক্ষেত্রে চিন্তার প্রতিবন্ধিকতায় ভোগেন তার সঙ্গে ধর্ম নিয়ে কথোপকথন ও পর্যালোচনা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। বিশ্বাসীদের নিয়েই যে এই মুশকিলে পড়তে হয় তা না, তবে আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সবচেয়ে বেশি মুশকিল হয় যারা নিজেদের আধুনিক ও প্রগতিশীল গণ্য করেন তাদের সঙ্গে।
এর প্রধান কারণ বোধহয় বাংলাদেশে আধুনিকেরা ধর্মকে সেকুলারিজমের বিপরীত একটি বর্গ ছাড়া অধিক কিছু ভাবতে পারেন না। সেকুলারিজম ছহি, ধর্ম প্রতিক্রিয়াশীল- এই বাইনারির বাইরে গিয়ে ধর্ম নিয়ে কোনো মুক্তচিন্তা কিংবা চিন্তাশীল আলোচনা বাংলাদেশের আধুনিক ও প্রগতিশীলদের মধ্যে আমরা দেখি না। তারা প্রাণপণ প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন ধর্ম যুক্তিহীন কুসংস্কার। বাংলাদেশের জনগণকে মুক্তি দিতে হলে যুক্তিহীনতা ও অন্ধ কুসংস্কারের জগৎ থেকে জনগণকে মুক্ত করতে হবে।
বিশ্বাসীদের নিয়েও বিস্তর মুশকিল আছে, সেটা কোনো অংশে আধুনিকদের তুলনায় কম নয়। তবে তাদের সমস্যা ভিন্ন। বিশ্বাসীদের মুশকিল তুলনামূলকভাবে জটিল। এ কারণে যে, ‘বিশ্বাস’ ও বিশ্বাসের চর্চা একালে আধুনিক সমাজ ও আধুনিকতার পরিমণ্ডলেই ঘটছে। ফলে বিশ্বাস হিসেবে যা বিশ্বাসী নিজে ও অন্যরা অনুমান করে, সেটা অধিকাংশ সময় আধুনিকতারই আরেকটি রূপ মাত্র। ফলে দুই তরফের কোনোটির সঙ্গেই আলোচনা সহজ নয়।
তারপরও সমাজে ধর্ম সম্পর্কে কথোপকথন দরকার। সেটা অর্থপূর্ণভাবে শুরু করতে হলে ‘ধর্ম’ সম্পর্কে আমাদের অনুমানকে প্রশ্ন করে সম্ভবত আমরা শুরু করতে পারি। সেদিক থেকে ধর্ম সম্পর্কে আমাদের যে ধারণা আমরা সার্বজনীন মনে করি, তা যে আসলে সার্বজনীন নয় সেই প্রাথমিক বোঝাবুঝি থেকে শুরু করা দরকার।
‘ধর্ম’ বা ‘রিলিজিয়ন’ ইউরোপীয় সমাজের ইতিহাসের মধ্যে গড়ে ওঠা ধারণা। সেই বিশেষ ধারণাকেই নির্বিচারে আমরা মান্য করে চলেছি। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এই সহজ কথাটাও বোঝানো কঠিন। বোঝানোর একটি সহজ সূত্র হচ্ছে আমাদের ভাষায় ‘ধর্ম’ কথাটির অর্থ তাৎপর্য এবং দ্যোতনার প্রতি মনোযোগী হওয়া।
যেমন, বাংলায় ‘পানির ধর্ম আছে’ বললে বাক্যটির একটি অর্থ হয়, যা আমাদের ভাষার ইতিহাস ও প্রায়োগিক ব্যবহারের মধ্যে নিহিত। কিন্তু ইংরেজিতে 'Water has religion' বাক্যটির কোনো মানে হয় না। সেখানে ‘রিলিজিয়ন’ নামচিহ্নের অন্তর্নিহিত অর্থ ও ধারণা ইউরোপীয় ইতিহাসের মধ্যে তৈরি। এই সহজ জায়গাটি বুঝলে বাংলা ভাষায় ধর্ম কিংবা আরবি ‘দ্বিন’ শব্দটির ধারণা কোথায় কীভাবে ইউরোপীয় ‘রিলিজিয়ন’ ধারণা থেকে আলাদা সেই অনুসন্ধানের তাগিদ আমরা তৈরি করতে পারি।
অন্যদিকে আধুনিকতা যেভাবে ‘মানুষ’ নামক নামচিহ্নের মধ্য দিয়ে এক অভূতপূর্ব ও অবিশ্বাস্য বিমূর্ত মানুষের ধারণা তৈরি করেছে সেদিকে নজর দিলে ধর্ম নিয়ে পর্যালোচনার প্রতিবন্ধকতার আরেকটি দিক আমরা বুঝতে পারব। ‘বিমূর্ত’ কথাটা গুরুত্বপূর্ণ। মানুষেরই ধর্ম আছে, মানুষই ধর্ম চর্চা করে।
ধর্মকে কুসংস্কার বলি, আজগুবি কল্পনা বলি, নানান আখ্যান, মিথ, উপকথা, কেচ্ছা, কাহিনীতে যুক্তিহীন বিশ্বাস বলি- এ সবই মানুষের স্বাভাবিক চরিত্র। সংস্কার, কল্পনা, কামনা, বাসনা ছাড়া মানুষ নাই। কিন্তু মানুষের এই স্বভাব বাদ দিয়ে ‘বিমূর্ত’ মানুষের ধারণা অবাস্তব।
আমরা আকাশ নিয়ে কথা বললে আকাশের রঙ বাদ দিয়ে স্রেফ শূন্যতাকে আকাশ ভাবি না, বৃক্ষের সবুজ বাদ দিয়ে বৃক্ষ নাই, তেমনি মানুষের সহজাত স্বভাব বাদ দিয়ে বিমূর্ত ব্যক্তি বা বিমূর্ত মানুষ নামক কিছু নাই। মানুষ সবসময়ই কোনো না কোনো ঐতিহাসিক অবস্থার মানুষ, ইতিহাসের তৈরি জিনিস। সেই ঐতিহাসিক মানুষের ইতিহাস একই সঙ্গে ধর্মেরও ইতিহাস। মানুষের বাইরে কোনো ধর্ম নাই।
বিমূর্ত মানুষের ধারণা আধুনিকতার মধ্যে কী ধরনের বিপদ ঘটায়? পাশ্চাত্যে জার্মান দার্শনিক ফ্রিডরিখ নিটশে এর বিপদ ভালোই টের পেয়েছিলেন। ‘দ্য বার্থ অফ ট্রাজেডি’তে তাকে হাহাকার করতে শুনি, ‘এই তো আমাদের বর্তমান আধুনিক যুগ, এক ধরনের সক্রেটিয় চিন্তার পরিণতি, যা মানুষের সব আখ্যান ও উপকথার বিনাশ সাধনে তৎপর।
মানুষকে তার উপকথা-কেচ্ছা-কাহিনীর বেশভূষা থেকে এখনকার সময় উদম করে ছেড়ে দিয়েছে। মানুষ তার অতীতের ওপর দাঁড়িয়ে অতীতের জন্য ক্ষুধার্ত, ফলে পাগলা হয়ে সেই সুদূর অতীতে গিয়েও শেকড় খোঁজার জন্য খোঁড়াখুঁড়ি করতে বাধ্য হচ্ছে। যদি উপকথা-কেচ্ছা-কাহিনীর বাসগৃহ, গল্পের গ্রাম কিংবা জরায়ুর মতো মিথের জগৎ হারিয়ে ফেলার ট্রাজেডি ছাড়া আমাদের এই ঐতিহাসিক ক্ষুধার তাৎপর্য কী! কী অর্থ অন্যান্য সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইবার? জ্ঞানবিজ্ঞান ভোগের বাসনার...?’ ইত্যাদি।
কল্পনা, কেচ্ছা, কামনা, বাসনা, ইচ্ছা, আকাক্সক্ষা বাদ দিয়ে মানুষকে বিমূর্ত যুক্তিসর্বস্ব রোবট কল্পনা অবাস্তব বটে; কিন্তু এই উলঙ্গ মানুষের ধারণার উদ্ভব ও আধিপত্য না ঘটলে ধর্মকে যেভাবে আমরা এখন কুসংস্কার ও অন্ধত্ব ভেবে খোদ মানুষকে চিন্তার জগতে উদম করে ছাড়ি- এই কুচর্চা সম্ভব হতো না।
ধর্ম আমাদের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ও পর্যালোচনার বিষয় হয়ে উঠত। ধর্ম বনাম সেকুলারিজম, ধর্ম বনাম নাস্তিকতা, কিংবা ধর্ম বনাম ধর্মনিরপেক্ষতার বায়নারি বকোয়াজগিরি বাদ দিয়ে আমরা মানুষকে ইতিহাস ও তার স্বভাব দিয়ে বোঝার পর্বে প্রবেশ করতে পারতাম।
‘কোরবানি’ নিয়ে বাহাস
বাংলাদেশে কোরবানি নিয়ে একটি বাহাস জারি আছে। ২০১৫ সালে ‘‘ইসলামের কোরবানি, ‘মনের পশু’ তত্ত্ব ও খ্রিস্ট ধর্ম’’ শিরোনামে এ বিষয়ে কিছু আলোচনা আমি করেছি। এখানে তার পুনরাবৃত্তি করব না, কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয় শুধু উল্লেখ করব।
বাহাসটি ‘মনের পশু’ বনাম কোরবানির পশুর তর্ক হিসেবে খ্যাত। ঈদুল আজহায় মুসলমানদের গরু কোরবানি দেয়া, না দেয়ার বিষয়টি গুরুতর রাজনৈতিক বিষয়। ইংরেজ ঔপনিবেশিক আমলে মুসলমানদের কোরবানি দিতে দেয়া হতো না। এই অধিকার লড়াই করে অর্জন করতে হয়েছে।
সেই লড়াই একই সঙ্গে ব্রিটিশ প্রবর্তিত জমিদারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অংশ ছিল। কোরবানির বিষয়টির সঙ্গে উপমহাদেশের ইতিহাস জড়িত, এটা অনেকেই মনে রাখেন না, কিংবা জানেন না। বিষয়টি কী পরিমাণ রাজনৈতিক সেটা এখন ভারতে নরেন্দ্র মোদি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘের গরু রক্ষার রাজনীতির অবস্থা বিচার করলে বোঝা যায়।
উত্তরপ্রদেশের এক গ্রামে নিছকই একটি গুজবকে কেন্দ্র করে শতাধিক মানুষ এখলাক নামে একজনের হত্যার ঘটনায় ভারতের রাজনীতি দীর্ঘকাল গরম হয়ে আছে। নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তা শুধু গরু এত তাড়াতাড়ি এতটা নিচে নামিয়ে আনবে সেটা আগাম অনুমান করা যায়নি। নীচু লোকের আক্রমণে এখলাক নিহত হন।
সাবেক মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ অভিযোগ করেছেন, বিজেপি গরুর রাজনীতি হাতিয়ার করে দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করছে। এটা ঠিক নয়। বহু হিন্দু আছে যারা গরু খায়। গরু খাওয়ার অপরাধে কাউকে পিটিয়ে মারা অন্যায়। অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও রাহুল গান্ধীও গরু খাওয়ার জন্য মুসলমানদের পিটিয়ে মারা নিয়ে কথা বলেছেন।
বিরোধী দলগুলো প্রচার শুরু করে দিয়েছে, গরুর রাজনীতির মধ্য দিয়ে ভারতে রাজনীতির নতুন মেরুকরণ ঘটছে। ভারতের ১৮ কোটি মুসলমান ছাড়াও বহু অমুসলিম গরুর মাংস খেয়ে থাকেন। ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মাংস রফতানিকারক দেশ।
ভারতের গো হত্যার রাজনীতি আর বাংলাদেশে গরু জবাই কিংবা কোরবানির তর্ক এক নয়, বলাই বাহুল্য। কিন্তু যখন বলা হয়, পশু কোরবানি নয়, আপনার মনের পশু কোরবানি করুন’ তখন সৎ উদ্দেশ্যে বললেও তা রাজনৈতিক হয়ে ওঠে। অনেককে তা ক্ষিপ্ত করে তুলতে পারে।
পরমের সন্তুষ্টির জন্য পশু উৎসর্গ নতুন কিছু নয়, এতে ইসলামেরও একচেটিয়া নাই। ইসলামবিরোধী প্রপাগান্ডার অংশ হিসেবে কোরবানিকে নিছকই পশু হত্যা হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টাও নতুন নয়। কোরবানির সঙ্গে হজরত ইব্রাহিমের (আ.) ঘটনার উপাখ্যান জড়িত, যা ইসলামের খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
মানুষকে তার উপাখ্যান বা মিথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিমূর্তভাবে ভাবলে কোরবানিকে নিছকই আল্লাহর নামে পশু উৎসর্গের অধিক ভাবা সম্ভব নয়। এই বিপদের সম্ভাবনার কথা আগেই উল্লেখ করেছি। তবে সেকুলারিজম, নাস্তিকতা ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধকে ন্যায্যতা দেয়ার জন্য ইসলামের এই গুরুত্বপূর্ণ বিধানকে নিন্দিত করে তোলার চেষ্টা সম্প্রতি খুবই প্রকট হয়েছে।
একে প্রকট করে তোলার মধ্য দিয়ে মুসলমানদের হিংসা, হিংস্রতা এবং প্রাণীর প্রতি নির্দয়তা সহজেই প্রমাণ করা যায়। যেহেতু কোরবানি শব্দটি বিশেষভাবে মুসলমানদের ধর্মচর্চার সঙ্গে যুক্ত, সেইভাবেই তার বিশেষ প্রচার চলে। তাই আমরা বুঝতে পারি না ধারণাগতভাবে যাকে মানুষ ‘পরম’ জ্ঞান করে, তাকে সন্তুষ্ট করার বিভিন্ন ধর্মীয় চর্চা নতুন কিছু নয়। ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষ তাদের সামাজিক ঐক্য দৃঢ় করার দরকারেই তা উদ্ভাবন করেছে। এখানে মুসলমানদের কোনো একচেটিয়া নাই।
ধর্মের ইতিহাসের দিক থেকে বিচার করলে প্রথমেই বোঝা দরকার পরমের সন্তুষ্টির জন্য প্রাণী উৎসর্গ করার বিধানের বিরোধিতা করা একান্তই একটি খ্রিস্টীয় চিন্তা। তাই এর বিরোধিতা করতে গিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা, প্রাণীপ্রেম, অহিংসবাদ, নৈতিকতার বাগাড়ম্বর প্রদর্শন খুবই বিরক্তিকর। খ্রিস্টধর্ম একটি মহান ধর্ম।
ফলে খ্রিস্টীয় চিন্তার বশবর্তী হয়ে কেউ ধর্ম চর্চার অংশ হিসেবে প্রাণী উৎসর্গ করার বিরোধিতা করতেই পারেন। কারণ খ্রিস্টধর্মের চোখে এটা ‘পাগানিজম’- বর্বরদের চর্চা। বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, জাতি বা জনগোষ্ঠী অসভ্য ও পশ্চাৎপদ। তারা ধর্ম কী জানে না। দাবি করা হয়, খ্রিস্টধর্মই একমাত্র সত্যিকারের ধর্ম।
যিশু নিজেকে নিজে ক্রুশে ‘কোরবানি’ দিয়েছেন। পাগান বা বর্বরদের বিপরীতে খ্রিস্টধর্মের মাহাত্ম্য প্রমাণের জন্যই পশু কোরবানি খ্রিস্টধর্ম নিষিদ্ধ করেছে। যারা কোরবানির বিরোধিতা করেন, তারা খ্রিস্টান না হতে পারেন, কিন্তু সাধারণত তারা যে যুক্তি দিয়ে থাকেন, সেটা একান্তই খ্রিস্টধর্মেরই যুক্তি।
খ্রিস্টধর্মের যুক্তি হচ্ছে, চূড়ান্ত কোরবানির উদাহরণ যেহেতু প্রদর্শিত হয়েছে, তাহলে আর কোনো কোরবানির দরকার নাই। যারা মহান যিশুর উদাহরণ দেখে উজ্জীবিত তাদের উচিত প্রভুরপ্রেমের জগতে আশ্রয় লাভ করা। কিন্তু এই সততা একইসঙ্গে বর্ণবাদ, ঔপনিবেশিকতা ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি ঘৃণারও ভিত্তি।
এর দ্বারা কারা সভ্য আর কারা অসভ্য, অপরিষ্কার ও হননযোগ্য, তাও নির্ধারিত হয়। সাদারাই একমাত্র সভ্য এবং তারা খ্রিস্টান। বর্ণবাদী হোয়াইট সুপ্রিমেসির মানদণ্ড হয়ে দাঁড়ায় খ্রিস্টধর্ম। যারা পশু কোরবানিকে বর্বর মনে করেন এবং ভাবেন যে, এটা ধর্মনিরপেক্ষ নৈতিক অবস্থান- আসলে ব্যাপারটা অত সিম্পল নয়। তারা আসলে নিজেদেরই অজান্তে হোয়াইট সুপ্রিমেসি ও বর্ণবাদের জয়গানই গাইছেন। কিন্তু নিজের চেহারা লুকিয়ে।
ইসলাম ও ‘কোরবানি’
ইসলাম হজরত ঈসা আলাইহে ওয়া সাল্লামের কোরবানিকে মনেপ্রাণে মান্য করে। তিনি আল্লাহর রাসূল এবং তাকে রাসূল হিসেবে মানা ইসলামে মোমিন হিসেবে বাধ্যতামূলক। দ্বিতীয়ত, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তার নিজেকে নিজে আল্লাহর পথে কোরবানি দেয়া ইসলামের চূড়ান্ত একটি আদশর্, যার সঙ্গে ‘জিহাদ’-এর ধারণা যুক্ত।
অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজেকে কোরবানি দিতে সদা প্রস্তুত থাকা। হজরত ঈসার (আ.) মধ্যে এই বিশুদ্ধ জিহাদি ও প্রেমমূর্তির সম্মিলন ঘটেছে বলে তিনি ‘রুহুল্লাহ’। তার মধ্য দিয়ে নাফসানিয়াতের বিরুদ্ধে রুহানিয়াতের বিজয় ঘটেছে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের পথে মানুষ রুহানিয়াতের পরম যে রূপ প্রদর্শন করতে পারে এটা তার নজির।
আল্লাহ তাকে নিজের কাছে তুলে নিয়েছেন। আখেরি নবীর আগে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চূড়ান্ত রূপ হজরত ঈসার (আ.) মধ্যেই দেখা যায়। মানুষের পক্ষে এই হাল বা স্বভাব অর্জন সম্ভব, কারণ দুনিয়ায় মানুষকে আল্লাহ তাঁর খলিফা হিসেবেই, রুহানিয়াতের শক্তিসম্পন্ন করেই পাঠিয়েছেন। ফলে শুধু মৃত্যুর পর বেহেশতের লোভে, কিংবা ব্যক্তিগত স্বার্থের বশবর্তী হয়ে নয়, বরং জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের মুক্তি এবং আল্লাহর সৃষ্টি প্রতিটি প্রাণের হেফাজত ও সুরক্ষার জন্য ইসলাম জিহাদের কথা বলে।
হজরত মোহাম্মদ (সা.) শুধু মুসলমানদের মুক্তির জন্য আসেননি, তিনি সব মানুষের জন্যই এসেছেন। শুধু মানুষও নয়, পশু-পাখি-কীট-পতঙ্গসহ আল্লাহর সব সৃষ্টির রহমত হিসেবেই তার আবির্ভাব ঘটেছে। এটা পরিষ্কার বোঝা দরকার, খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে হজরত ঈসাকে (আ.) নিয়ে কোনো ঝগড়া নাই।
তবে বিরোধ তো অবশ্যই অন্য ক্ষেত্রে আছে। খ্রিস্টধর্ম হজরত ঈসাকে আল্লাহর পুত্র বানিয়ে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে রুহানিয়াতের বিকাশের সম্ভাবনা কার্যত অস্বীকার করে। খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে ইসলামের বিরোধের এটাই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এতে দাবি করা হয়, আল্লাহর পুত্র না হলে ইহলৌকিক মানুষের পক্ষে এরকম রুহানিয়াতের শক্তি অর্জন অসম্ভব।
অন্যদিকে আল্লাহর কোনো ছেলেমেয়ে নাই, সেই ধারণার বিপরীতে দাঁড়িয়ে খ্রিস্টধর্ম একত্ববাদের আদি রাসূল হজরত ইব্রাহিম (আ.) বা আব্রাহামেরও বিরোধিতা করে। যিশুকে আল্লাহর পুত্র বলার মধ্য দিয়ে ইসলামের প্রধান আপত্তি হল, এটা শেরেকি। গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে, খ্রিস্টধর্ম হজরত ইব্রাহিমের একত্ববাদের শিক্ষা থেকে সরে গেছে।
তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগের জায়গা রাজনৈতিক দিক থেকেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হল খ্রিস্টধর্ম সভ্য/বর্বর, সাদা/কালোসহ মানুষের মধ্যে মানুষের বিভাজন তৈরি করে। যিনি আল্লাহ সন্তুষ্টির জন্য নিজেকে ক্রুশে কোরবানি দিয়েছেন তিনি সাদা যিশু, তার চোখ নীল এবং চুল সোনালি।
কিন্তু হজরত ঈসা (আ.) তো আরব দেশের মানুষ ছিলেন। তার চোখ নীল, চামড়া সাদা আর চুল সোনালি হবে কেন? অভিযোগ হচ্ছে, খ্রিস্টধর্ম প্রমাণ করতে চায় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজেকে কোরবানি এক্মাত্র সাদা মানুষরাই করতে পারে, বর্বররা নয়।
আমরা এসব আপত্তি ও অভিযোগ নিয়ে তর্ক করতে পারি, কিন্তু দুটো ধর্ম যিশুকে মেনেও তার তাৎপর্য বিচার করতে গিয়ে কোথায় পরস্পর পৃথক হয়ে যায় সেদিকে নজর রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
এবার আসা যাক আখেরি নবী কেন হজরত ঈসার (আ.) পরম আত্মোৎসর্গের নজির থাকা সত্ত্বেও কোরবানির প্রচলন করলেন। এর কারণ হচ্ছেন হজরত ইব্রাহিম (আ.)। আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধান যদি রুহানিয়াতের পথ হয়ে থাকে তাহলে হজরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর আদেশ পালন করতে গিয়ে তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসকে কোরবানি করতে চেয়েছিলেন।
কোরবানির এই নজির যেন আমরা ভুলে না যাই। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়’, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’- এই সত্য তিনিই সবচেয়ে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছিলেন। ইসলামপন্থীরা রাসূলের উম্মত, কিন্তু একইসঙ্গে তারা ‘মিল্লাতে ইব্রাহিম’-এর অন্তর্ভুক্ত।
শেরেকির বিরুদ্ধে লড়তে হলে হজরত ইব্রাহিমের (আ.) শিক্ষা কোনোভাবেই ভুলে যাওয়া যাবে না। হজরত মুসা (আ.) ও হজরত ঈসার (আ.) আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে যারা হজরত ইব্রাহিমের (আ.) একত্ববাদ থেকে সরে গিয়েছে, অথচ বড় গলায় আবার হজরত ইব্রাহিমকে (আ.) তাদের পূর্বপুরুষ বলে দাবি করে, তাদের সুপথে আনার জন্যই হজরত ইবাহিম খলিলুল্লাহকে স্মরণ ইসলামে মোমিনদের জন্য বাধ্যতামূলক। আল্লাহর আদেশ পালন করতে গিয়ে হজরত ইব্রাহিম (আ.) নিজের পুত্রসন্তানকে কোরবানি করতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই ঘটনার স্মরণে কোরবানি দেয়া ওয়াজিব।
অন্য যে কোনো ধর্মের ইতিহাসের মতো ইসলামের ইতিহাসও সরল পথে এগোয়নি। তার অনেক মোড়, বাঁক, দ্বন্দ্ব আছে, আছে নানান মত ও মাজহাব। দুনিয়ার সব মানুষকে একদিন একত্রিত করতে হবে- রক্ত, গোত্র, আভিজাত্য, গোষ্ঠী, ভূখণ্ড, নৃতাত্ত্বিক কিংবা ভাষা বা সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদ অতিক্রম করে মানুষ একদিন ঐক্যবদ্ধ হবে- ইসলাম এই স্বপ্ন দেখেছিল বলে তার আবির্ভাব ও বিকাশ ঘটেছিল দ্রুত। হজরত ইব্রাহিম (আ.) সেই স্বপ্নের দ্রষ্টা।
যে কারণে জেরুসালেমের দিক থেকে রুকু ইব্রাহিম খলিলুল্লার স্মৃতি মক্কার দিকে ফিরে যায়। আখেরি নবীর রুকু বদলের এই ইতিহাসের তাৎপর্য বুঝতে হবে। আখেরি নবী ভেবেছিলেন, ইব্রাহিমের মধ্য দিয়ে তিনি সেই সময়ের সব একত্ববাদী ধর্মকে ঐক্যবদ্ধ করবেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.) সেদিক থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ। তার সম্মানেই তাই কোরবানির ঈদ পালন ওয়াজিব করা হয়েছে।
কোনো বিষয়কে আংশিক বা একদেশদর্শীভাবে বিচার করা মোটেও ঠিক নয়। অর্থাৎ কোরবানি দেয়ার দরকার কী? ‘মনের পশু’কে কোরবানি দিলেই তো হয়- যারা এসব পপুলিস্ট কথাবার্তা বলেন তারা আসলে নীতিগত ও কৌশলগত উভয় দিক থেকেই মারাত্মক ভুল করেন। তাদের আবদার থেকে বোঝা যায় ধর্ম ও ধর্মতত্ত্বের ইতিহাস সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই নাই। দ্বিতীয়ত, তারা আসলে খ্রিস্টীয় তত্ত্বই ধোপদুরস্ত ধর্মনিরপেক্ষতার ভান ধরে প্রচার করছেন।
তারা নিজেরাই তা জানেন কিনা সন্দেহ। তাদের বক্তব্যের অর্থ একালে দাঁড়ায় এরকম যে, তাদের মনের পশুর তত্ত্ব না মানলে অন্যরা ধর্মচর্চার দিক থেকে বর্বর ও অসভ্য। ইসলামের পর্যালোচনা করুন, কিন্তু না বুঝে বা না জেনে নয়। প্রপাগান্ডার শিকার হবেন না।
শেষে এই কথাটি বলে রাখি : ইসলামের দিক থেকে কোরবানি একইসঙ্গে রাজনৈতিক। কারণ হজরত ইব্রাহিমকে (আ.) স্মরণ করার মধ্য দিয়ে মিল্লাতে ইব্রাহিমের গৌরব স্মরণ করাও বটে। যার অর্থ বিভিন্ন ধর্ম ও বিশ্বাসের মানুষকে একই মানবিক আলিঙ্গনে বাঁধা। মানুষের উম্মাহ কায়েম।
মুসলমান শুধু রাসূলের উম্মত নয়, মিল্লাতে ইব্রাহিমের দাবিদার, এই সত্য থেকে তারা কতটা সরে গিয়েছে সেটাই বরং এখন বিতর্কের বিষয়।
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন