সাহিত্য ও দর্শনের সঙ্গে একটি জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক খুবই নিবিড়। কিন্তু এই নিবিড় সম্পর্কের কায়কারবার প্রায়ই অদৃশ্যে ঘটে। অর্থাৎ কীভাবে ঘটছে সেটা হাতেনাতে ধরিয়ে না দিলে, কিংবা সজ্ঞানে বুঝতে না চাইলে ধরা পড়ে না। দর্শন এক কিম্ভূত ব্যাপার। বিজ্ঞান কিংবা সাহিত্যের মতো সুনির্দিষ্ট কোনো বিষয় নিয়ে দর্শন চর্চা করে না; দর্শন বরং সক্রিয় ও সপ্রাণ চিন্তার খোলা ময়দানের মতো। সেখানে সক্রিয় ও সপ্রাণ চিন্তা বিদ্যমান বিষয়াদির পর্যালোচনা যেমন করে, তেমনি নিজের জন্য নিজে নতুন বিষয় প্রয়োজনে কিংবা চিন্তা প্রক্রিয়ার নিজস্ব তাগিদে ধার্য করে নিতে পারে। সর্বোপরি নিজের চিন্তা নিজেই পর্যালোচনা করতে পারা- এখানে দর্শনের অর্থাৎ সপ্রাণ ও সক্রিয় চিন্তার গৌরব নিহিত।
প্রতিটি শাস্ত্র বা বিজ্ঞানের গোড়ায় চিন্তার নানান অনুমান কাজ করে। সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর ও সিদ্ধান্ত নেয়ার বিশেষ পদ্ধতিও থাকে। যেমন, উদ্ভিদবিজ্ঞানের একটি প্রাথমিক কাজ হচ্ছে গাছপালা শনাক্ত করা এবং তাদের শ্রেণীকরণ। এই শনাক্তকরণ আর শ্রেণীকরণের পদ্ধতি দিয়ে জ্যামিতির চর্চা চলে না। পদার্থবিজ্ঞানের গতিবিদ্যা নিরূপণ কিংবা বস্তুর গতির ব্যাখ্যা করা যায় না। গ্রহবিজ্ঞান দূরের গ্রহ-নক্ষত্রের কক্ষপথ হিসাব কষে, আঁকে, তার ভিত্তিতে সৌরজগতে পৃথিবীর অবস্থান সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। সেই পদ্ধতি দিয়ে ‘তুমি আজ কত দূরে, তুমি আজ কত দূরে...’ গানটি বিলাপ করে গাইলেও বিরহের দূরত্ব মাপা সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথের ‘তুমি কি কেবলি ছবি, শুধু পটে লিখা...’ গানটি সারারাত দূর নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে কান্নাকাটি করে গাইলে খারাপ হবে না। কিন্তু তাতে সুদূর নীহারিকায় যারা আকাশের নীড়ে ভিড় করে আছে সেই অবধি পৌঁছানো যাবে না। তার জন্য মহাকাশ যাত্রীবাহী মহাকাশযান আবিষ্কারের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। যেসব আঁধারের যাত্রী গ্রহ হয়ে, তারা হয়ে, রবি হয়ে দিনরাত্রি আলো হাতে চলেছে তো চলেছে তাদের আঁধার, আলো কিংবা গতিপথ সম্পর্কেও কিছুই জানা যাবে না। রবীন্দ্রনাথের গানে পৃথিবী থেকে নক্ষত্রের দূরত্ব কমবে কি? কমবে না। গ্রহ-নক্ষত্র সম্পর্কে গ্রহ বিজ্ঞান ছাড়া আমাদের জ্ঞানার্জনের অন্য কোনো সুবিধা নাই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে আমরা তাই বলে বাদ দেব না। কারণ তিনি সাহিত্য।
সাহিত্যের সঙ্গে এখানে দর্শনের মিল আছে। দর্শনের কোনো বিষয় নাই, আগেই তৈরি থাকা সুনির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে চিন্তা বা চর্চা দর্শনের কাজ নয়। সাহিত্যিক যে কোনো বিষয় নিয়ে লিখতে পারেন, এই অর্থে সাহিত্যের কোনো আগাম নির্ধারিত বিষয় নাই। তর্ক করা যায়, কল্পনা সাহিত্যের বিষয়। কিন্তু দর্শনের আগাম তৈরি বিষয় নাই বলার অর্থ এই নয় যে, সাহিত্যের মতো দর্শনের কাজ কল্পনা চর্চা করা। দর্শনে কল্পনা নাই বলা যাবে না। সক্রিয় ও সপ্রাণ চিন্তা মানে কল্পনা, ইচ্ছা, সংকল্প, বাসনা, বুদ্ধি ইত্যাদি মানবীয় বৃত্তিচর্চার সংক্ষিপ্ত ডাকনাম। চিন্তা মানে বুদ্ধির চর্চা, বুদ্ধির ব্যবহার, এটা আধুনিককালের সংকীর্ণ সংজ্ঞা।
আজকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন নামে একটা বিভাগ আছে। ফলে এ ধারণা অনেকেরই বদ্ধমূল যে দর্শনও বুঝি বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে পাঠ করার মতো পাঠ্যবস্তু। তার বিষয় বুঝি সাহিত্য, উদ্ভিদবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, অর্থশাস্ত্র, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইত্যাদি চর্চার জন্য আগাম তৈরি করে রাখা আরেকটি বিষয় মাত্র, যার সঙ্গে অন্যান্য বিষয়ের কোনো সম্পর্ক নাই। দর্শন বুঝি আলাদা একটি শাস্ত্র, অন্যান্য বিষয়ের মতোই স্বতন্ত্র একটি বিষয়। আসলে তা কিন্তু মোটেও নয়। যে কোনো বিষয়ই দর্শনের বিষয় হতে পারে। ঠিক। যে কারণে একসময় পদার্থবিজ্ঞান, গণিত, জ্যামিতি, উদ্ভিদবিজ্ঞান, রসায়ন শাস্ত্র ইত্যাদি ‘দর্শন’ নামেই অভিহিত হতো।
কিন্তু দর্শনের আরেকটি দিকও আছে, সেখানেই বোধহয় দর্শনের স্বাতন্ত্র্য ভালোভাবে বোঝা যায়। সেটা হল, যে কোনো বিষয়ই যেমন দর্শনের পর্যালোচনার অধীন হতে পারে, তেমনি আবার বিদ্যমান কোনো আগাম তৈরি বিষয় নিয়ে দর্শন নাও মাথা ঘামাতে পারে। সেসব আদৌ দর্শনের বিষয় নাও হতে পারে। দর্শন এমন সব বিষয়ের অবতারণা করে, যা আমাদের অপরিচিত, অজানা, অধরা। বিদ্যমান শাস্ত্র, বিজ্ঞান বা বিষয়কে দর্শন এমনভাবে অতিক্রম করে যায় বা যেতে সক্ষম যে সক্রিয় ও সপ্রাণ চিন্তাকে কোনো বিদ্যমান বিষয়ের খাপে ফেলা কঠিন, এটাই দর্শন বারবার প্রমাণ করে। হয়তো দর্শনের বিষয়কে আগাম তৈরি খাপে কখনোই ফেলা যায় না।
দুই
বিজ্ঞান তার উন্মেষের যুগে মানুষের জ্ঞানের অনুসন্ধিৎসার দায় মিটিয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞানের রমরমার যুগে তাই প্রশ্ন উঠেছিল, আলাদা করে দর্শনের কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে কি? আধুনিক বিজ্ঞানই তো আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছে। আধুনিক বিজ্ঞানের রমরমার যুগে এটা বেশ রমরমা তর্ক ছিল। কিন্তু সেটা বেশিদিন টেকেনি। বিজ্ঞানের উন্মেষের পাশাপাশি দার্শনিকরা বলতে শুরু করলেন, এমন অনেক বিষয় আছে যার উত্তর আধুনিক বিজ্ঞানের পক্ষে সম্ভব নয়। বিজ্ঞান দেশকালের অধীন সত্তাকে ‘বস্তু’ গণ্য করে তাকে মানুষের বুদ্ধির সীমার মধ্যে শর্তসাপেক্ষে নির্ণয় করতে পারে বটে; কিন্তু সেটা বুদ্ধির সত্য মাত্র, সেই সত্য নির্ণয়ে বুদ্ধি নিজের উপাদানও যোগ করেছে। কিন্তু যা দেশকালের অধীন নয় সেটা বিজ্ঞানেরও বিষয় নয়। যেমন, ‘আল্লাহ’, ‘আত্মা’, ‘পরকাল’ ইত্যাদি। সেসব বিষয় পর্যালোচনার পদ্ধতি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সম্ভব নয়। তার বিচার আলাদা। এই লড়াই লম্বা দিন ধরে চলেছে। শেষাবধি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে তার সীমা স্বীকার করে নিতে হয়েছে। কিংবা গোঁয়ারের মতো বলতে হয়েছে, যা প্রত্যক্ষ নয় তা অবাস্তব, অসত্য। কিন্তু তাতেও গোঁয়ার মেনে নিচ্ছে প্রত্যক্ষের বাইরের বিষয় তার জন্য অনধিকার চর্চা মাত্র। ফলে দর্শনের ভূমিকাও আগের চেয়ে স্পষ্ট হয়েছে। সাধারণভাবে বুদ্ধিসহ মানুষের সব বৃত্তির পর্যালোচনা যেমন দর্শনের দায় হিসেবে এখন মান্য, একইভাবে বুদ্ধির হিম্মতের বাইরে যে অধরা জগৎ তার সঙ্গে সম্বন্ধ রচনার বিবিধ দিকদর্শনের অনুসন্ধিৎসার- অর্থাৎ সজ্ঞান, সচেতন, সপ্রাণ ও সক্রিয় চিন্তার জিজ্ঞাসার ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। অধরার আকর্ষণে এমন সব বিষয় দর্শন অবতারণা করে যার কোনো সরাসরি উপযোগিতা নাই, কিংবা আগামীতে আদৌ সেই চিন্তা মানুষের কাজে লাগবে কিনা সেটাও হলফ করে বলা কঠিন। এখানে সাহিত্যের সঙ্গে দর্শনের আশেকানি বা মহব্বতের জায়গা। সাহিত্য বা দর্শনের উপযোগিতা থাকতে পারে; কিন্তু বিজ্ঞানচর্চার মতো উপযোগিতা দিয়ে সাহিত্য বা দর্শনের ভালোমন্দ নির্ণয় করা অসম্ভব।
উপযোগিতা নাই বলে মানুষ কি তাহলে দর্শন চর্চা বাদ দেবে? কিংবা সাহিত্য? দর্শনকে এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। সত্য নির্ণয়ের পদ্ধতি এবং বুদ্ধির ভূমিকাসহ মানুষের বিভিন্ন বৃত্তির সীমা ও সম্ভাবনা নিয়ে বিজ্ঞানের সঙ্গে দর্শনের তর্ক নানান ডালপালায় নানান দিকে যেমন বিস্তৃত, সাহিত্যকে সেই পরিশ্রম করতে হয়নি। সাহিত্য আগাম মেনে নেয় তার কাজ দৃশ্যমান জগতের সত্যমিথ্যা নির্ণয় নয়, বরং মানুষের কল্পনা, ইচ্ছা ও বাসনার সঙ্গে সম্বন্ধ স্থাপন। সাহিত্যের উপযোগিতা নাই, এতে সাহিত্যের বিশেষ ক্ষতিবৃদ্ধি নাই।
কিন্তু দর্শনের জন্য এই তর্কের উত্তর অবশ্য সোজা। আসলে প্রশ্ন করা হচ্ছে, উপযোগিতা না থাকলে মানুষ কি তাহলে চিন্তা চর্চা করার কাজও বাদ দেবে? মানুষ কি চিন্তা করবে না? নিজের চিন্তার পর্যালোচনাও কি মানুষকে বাদ দিতে হবে? চিন্তা মানুষের স্বভাব। চিন্তাহীনতা তাহলে কীভাবে মানুষের পক্ষে সম্ভব? প্রত্যেক জীবন্ত মানুষ কোনো না কোনোভাবে চিন্তা করে, ফলে দর্শন চর্চা কোনো হাওয়াই কারবার নয়, চিন্তার স্বাভাবিক তাগিদ থেকেই তার উদগিরণ বা উজ্জীবন ঘটে থাকে। বারবারই। তাছাড়া দৈনন্দিন নানান বিষয়ে মানুষকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, অনেক কিছুই তাকে নতুন করে ভাবতে হয়। তাহলে ভাবনা, ভাবুকতা, দার্শনিকতা ছাড়া ‘মানুষ’ নামক জীবেরও বা অর্থ কী? চিন্তা মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি। এ কারণে অনেক দার্শনিকের দাবি, মানুষের চিন্তার বিকাশ দৈনন্দিন ভাষা চর্চার মধ্য দিয়ে ঘটে, যার কোনো বিকল্প নাই। শাস্ত্র বা বিজ্ঞান সেক্ষেত্রে চিন্তার বিকাশে প্রতিবন্ধক হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশের সাধুসন্তরা যখন নিজেদের শাস্ত্রবিরোধী বলে থাকেন তখন ভাব বা দর্শন চর্চাকে সাধারণ মানুষের ভাষাচর্চার জগতে জীবন্ত রাখার স্বার্থে সে কথা বলেন। বাংলা ভাষায় দর্শন চর্চার সমৃদ্ধি সে কারণে ফকির-দরবেশ-বয়াতি-বাউলদের মধ্য দিয়েই ঘটেছে। শিক্ষিত শ্রেণীর অবদান ইউরোপের চর্বিত চর্বণ ছাড়া সেক্ষেত্রে নগণ্য।
এই অতি সাধারণ সত্যটুকু বুঝলে আমরা বুঝব, বিজ্ঞান বলতে আমরা এখন যে চর্চা বুঝি সেটা চিন্তার এক বিশেষ ধরনের চর্চা মাত্র। সার্বজনীন কিছু নয়। কিন্তু চিন্তার এই বিশেষ ধরন মানুষের একমাত্র বা শেষ ধরন নয়। বিজ্ঞানও একরকম নয়। সার্বজনীন তো নয়ই। বিজ্ঞান মাত্রই ‘উচ্চমার্গের চিন্তা’র কোনো ধরন নয়, বিভিন্ন বিজ্ঞানের ভূমিকা বিভিন্ন রকম। তাদের ভূমিকার ক্ষেত্রেও হেরফের আছে। যেমন, আধুনিক বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক ভূমিকা অনস্বীকার্য; কিন্তু সেখানে অবদান যেমন আছে তার ভয়ংকরবিনাশী রূপও আছে। পারমাণবিক বোমা, ইন্ডাস্ট্রিয়াল কায়দায় বিপুলসংখ্যক মানুষকে একসঙ্গে হত্যার কারিগরি আবিষ্কার, বোমা, ড্রোন বিমান দিয়ে নিরীহ নারী-পুরুষ-শিশু হত্যা, প্রাণের সংকেতসূত্রে বিকৃতি ঘটিয়ে প্রকৃতিবিনাশী জিএমও আবিষ্কার- এসব ভয়ানক চর্চা আধুনিক বিজ্ঞানের হাত দিয়েই ঘটেছে। ফলে নির্বিচারে আধুনিক বিজ্ঞানকে একাট্টা ভালো বলার কোনো যুক্তি নাই। প্রতিটি বৈজ্ঞানিক চিন্তা, চর্চা ও আবিষ্কারের পরিপ্রেক্ষিত আছে, দেশ, কাল, পাত্র ভেদ আছে। প্রতিটি আবিষ্কারের নির্মোহ পর্যালোচনা দরকার। সারকথা হল, বিজ্ঞান মানেই সার্বজনীন চিন্তা নয়। বিজ্ঞান সবার জন্য ভালো, সবসময়ই ভালো ভাবার কোনো কারণ নাই। ‘বিজ্ঞান’ নামক শব্দচিহ্ন দিয়ে চিন্তা চর্চার বিভিন্ন রূপের সাধারণীকরণ সে কারণে বিপজ্জনক। ‘বিজ্ঞান’ নামক সাধারণ ও সার্বজনীন ধারণাকে এ কারণে দর্শন- অর্থাৎ সজ্ঞান ও সক্রিয় চিন্তা মেনে নেয় না। এ রকম কোনো হাতির ডিম নাই। হাতির ডিম খেলে কী দুর্দশা হতে পারে সেটা গণবিদ্বেষী ও ধর্মবিদ্বেষী মুক্তচিন্তাবাদী, বিজ্ঞানবাদী বা মুক্তবুদ্ধিওয়ালা ব্লগারদের কাণ্ড দেখলে সহজেই বোঝা যায়। তাদের ধারণা বিজ্ঞান চর্চা মানেই ধর্মবিদ্বেষী, বিশেষত ইসলামবিদ্বেষী হওয়া। শাহবাগ আন্দোলনের মধ্যে গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা বিকাশের যে অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, ধর্মবিদ্বেষী ব্লগাররা তার গোড়ায় ডিনামাইট পুঁতে দিয়েছিল। যার পরিণতি আমরা জানি।
শুধু উপযোগিতার তর্ক নয়, দর্শনের স্বাতন্ত্র্য কোথায় সেটা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। দর্শন কোথায় অন্যসব চর্চা ও জিজ্ঞাসার ক্ষেত্র থেকে আলাদা সেটা একটি দার্শনিক প্রশ্নও বটে। একসময় বৈজ্ঞানিক চর্চাও দর্শন চর্চা হিসেবেই অভিহিত হতো, কারণ তখন বৈজ্ঞানিক প্রেরণার গোড়ায় ছিল জ্ঞানের অনুসন্ধিৎসা এবং তার উদ্দেশ্যের মূলে ছিল সেই জিজ্ঞাসার পিপাসা মেটানো। বিজ্ঞানের সেই চরিত্র এখন প্রশ্নবিদ্ধ। বৃহৎ পুঁজি ও কর্পোরেশনের ভাড়া খাটা এখন বিজ্ঞানের প্রধান পেশা, বিজ্ঞানীর জীবিকা নির্বাহের প্রধান দায়। মানুষের স্বাভাবিক অনুসন্ধিৎসা বা জিজ্ঞাসা বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানী উভয়ের প্রেরণা থেকে ক্ষয়ে গিয়েছে অনেক।
বিদ্যমান ধারণা চিন্তার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করলে নতুন শব্দ বা ধারণা প্রবর্তনও দর্শনের কাজ। সেক্ষেত্রে সাহিত্য যখন সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহার্য শব্দকে সাহিত্যে প্রচলিত করে তোলে, দর্শন সেই প্রচলন থেকে পর্যালোচনার জগতে অভিযোজনের জন্য জরুরি শব্দটি তুলে আনে। সাহিত্য ভাষাকে ভাঙ্গে, বিদ্যমান ভাষা ব্যবস্থার অন্তর্গত শৃংখলা ভেঙে ফেলার মধ্য দিয়ে নতুন চিন্তার সম্ভাবনা তৈরি করে। সাহিত্য এখানে সজীব ও সক্রিয় চিন্তা চর্চার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়। ষাট দশকে সাহিত্য, বিশেষত কবিতার সঙ্গে দর্শনের সম্পর্কের জায়গাটা আমাদের কাছে অনেক স্পষ্ট ছিল। সেই সময়ের কাব্য আন্দোলনের প্রধান স্লোগান ছিল, ‘প্রথম বিপ্লবের খুন বেরুবে ভাষা থেকে’। পরবর্তীকালে কাব্যের সঙ্গে চিন্তার সম্পর্ক অপরিচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছে। এতটাই অপরিচ্ছন্ন যে, এটা কবিতার জন্য ভালো কী মন্দ হয়েছে সেটা নিয়ে কেউ তর্ক করার প্রয়োজনও বোধ করে না। সাহিত্য আমার আলোচনার জন্য প্রাসঙ্গিক, কিন্তু এখন মুখ্য নয়। তাই সাহিত্যের সঙ্গে দর্শনের এবং দর্শনের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক নিয়ে দুই-একটি কথা বলে শেষ করব।
তিন
উপরে এত বড় ভূমিকা বা ভণিতা খুব পরিকল্পিতভাবে কিছু লিখব বলে লিখেছি তা নয়। আসলে বাংলাদেশে এখন লেখালিখি করা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। রাষ্ট্র বা সরকারের দিক থেকে ঝুঁকি আছে, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বুঝতে পারি সরকার খুবই ভীত ও সন্ত্রস্ত। কেন ভীত সেটা বুঝি, কিন্তু লিখে কতটা বলা যাবে জানি না বলে লিখতে পারছি না। না লিখতে পারা লেখকের জন্য বেদনার। ঝুঁকিও বটে। কারণ পাঠকের প্রত্যাশা মেটানো হয় না। কিন্তু রাষ্ট্র বা সরকারের তরফে ঝুঁকির চেয়েও বাংলাদেশে আরও বড় ঝুঁকি তৈরি হয়ে রয়েছে। সে বিষয়েই বলতে গিয়ে অনেক কথা, দরকারি হলেও, বলেছি। একটি বিষয় উল্লেখ করে শেষ করি।
বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিভাষার সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক সরাসরি। যেমন ‘গণতন্ত্র’, ‘সংবিধান’, ‘ক্ষমতা’ ইত্যাদি। এই প্রাথমিক সত্য বোঝা কঠিন নয়। কিন্তু তথাকথিত আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের রাজনীতিতে আমরা যেসব পরিভাষা ব্যবহার করি তার অধিকাংশই অপরিচ্ছন্ন ও অস্পষ্ট। ‘গণতন্ত্র’, ‘সংবিধান’, ‘ক্ষমতা’ ইত্যাদি সম্পর্কেও সে কথা খাটে।
বাংলাদেশে বেশ কিছু শব্দ বা ধারণা সাধারণের মধ্যে যে অর্থ তৈরি করে সেটা চিন্তাশীল লেখকের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পুরো দেশের জন্যও বটে। বিদ্যমান ধারণাগুলোকে নিরন্তর পর্যালোচনার অধীনে আনা দর্শনের কাজ। যেমন ‘গণতন্ত্র’। এটা বাংলা ভাষার অন্তর্গত কোনো ধারণা নয়, পরিভাষা। ইংরেজি ডেমোক্রেসি শব্দটির অনুবাদ। কিন্তু এর উৎপত্তি ইংরেজি ভাষায় নয়। মূলে এটি গ্রিক শব্দ। শব্দের ব্যুৎপত্তি নিয়ে যেসব লেখালেখি আমরা দেখি, এখানে বলা হয় যে গ্রিক ‘ডেমোস’ (demos) এবং ‘ক্রাটোস’ (kratos) এই দুটি শব্দ থেকে ‘ডেমোক্রেসি’। ‘ডেমস’ মানে সাধারণ মানুষ, আর ‘ক্রাটোস’ মানে শাসন। দুটো মিলে ডেমোক্রেসির অর্থ হল ‘সাধারণ মানুষের শাসন’। এটাই পাঠ্যপুস্তকে পড়ানো হয়। এটাই স্কুল-কলেজে আমরা শিখেছি।
কিন্তু ব্যাপারটা এত সহজ বা সরল নয়। প্রথমে জানা দরকার সাধারণ মানুষ বলতে শুধু পুরুষদের বোঝানো হতো, মেয়েদের কিংবা দাসদের নয়। দ্বিতীয়ত, ‘ডেমোস’ মানে যে এলাকায় গ্রিক নগররাষ্ট্রের নাগরিকরা বাস করত। ‘পলিস’ (polis) অর্থাৎ ‘রাজনৈতিক পরিসরে অংশগ্রহণ করতে চাইলে ‘ডেমোস’-এ বসবাসরত নাগরিকদের রেজিস্ট্রেশন করতে হতো। কারণ ‘ডেমোস’ দিয়েই তার পরিচয়। ইংরেজিতে ডেমগ্রাফি শব্দটির মধ্যে ‘ডেমোস’-এর মানেটা কিছুটা ধরা আছে।
দেখা যাচ্ছে ‘ডেমোস’-এর ধারণা ‘পলিস’ বা রাজনৈতিক পরিসরের ধারণার সঙ্গে যুক্ত। বিষয়টি শুধু শাসক নির্বাচন করার ব্যাপার ছিল না। রাজনৈতিক বিষয়াদিতে নাগরিকদের অংশগ্রহণের বিষয়টিই ছিল আসল এবং গণতন্ত্রের মূল কথা বা মর্ম। গণতন্ত্র একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা মাত্র নয়। কারণ রাজনৈতিক পরিসরের উপস্থিতি এবং সেখানে অংশগ্রহণ ছাড়া ‘গণতন্ত্র’ কথাটির কোনো মানে দাস ব্যবস্থার ওপর দাঁড়ানো গ্রিসেও ছিল না। আধুনিককালে ‘গণতন্ত্র’ নামক ধারণাটি ফরাসি বিপ্লবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিস্তর রূপান্তরিত হয়েছে। সেটা ভিন্ন বিতর্ক। স্থানাভাবে সেটা এখানে আলোচনা করছি না, আপাতত প্রয়োজনও নাই। এটাই শুধু আমি আপাতত বলতে চাইছি যে, নারী ও দাসদের প্রসঙ্গ বাদ দিলে গ্রিক আমলেও গণতন্ত্রের ধারণা ও চর্চার সঙ্গে রাজনৈতিক পরিসরের উপস্থিতি অঙ্গাঙ্গি যুক্ত ছিল। অথচ আমরা যখন শব্দটির অনুবাদ ও ব্যবহার করছি তখন এর ছিটেফোঁটাও তার মধ্যে আর হাজির থাকেনি। তখন গণতন্ত্রকে স্রেফ একটি সরকার নির্বাচনের ধারণা হিসেবে গ্রহণ করেছি। এর রাজনৈতিক কুফল হয়েছে মারাÍক। যা আমরা এখন ভোগ করছি।
বাংলাদেশে ‘রাজনৈতিক পরিসরের’, অর্থাৎ যেখানে জনগণ রাজনৈতিক বিষয়াদি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নিজের বক্তব্য জানাতে পারে এবং অংশগ্রহণ করতে পারে, এই অবিশ্বাস্য অনুপস্থিতির পরও আমরা ‘গণতন্ত্র’ কথাটি যত সহজে ব্যবহার করে যাচ্ছি সেটাই আশ্চর্যের। কিন্তু আমরা হাতির ডিম খেতে অভ্যস্ত। গণতন্ত্রের নামে বগল বাজিয়ে যাচ্ছি।
যে কোনো ধারণাকে পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে পরিচ্ছন্ন করে তোলা দর্শনের কাজ, সাহিত্য সহায়ক। এটুকুই বোঝাতে চেয়েছি।
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন