অন্যের আয়নায় দেখি নিজেকে
24 August 2016, Wednesday
জীব প্রকৃতি লৌকিক, কিন্তু যাকে আমরা মানুষের প্রকৃতি বা মানুষের স্বভাব বলে বোঝার চেষ্টা করি, তাকে লৌকিকতার সীমার মধ্যে নির্দিষ্ট করা, শনাক্ত করা ও বিচার করা কঠিন। রহস্য মনে হলে এ কারণে বলা যায়, মানুষ অলৌকিক, কিন্তু সেটা শর্ত সাপেক্ষে। অর্থাৎ লৌকিকতা ও অলৌকিকতার সম্বন্ধ বিচারের মধ্য দিয়েই মানুষের গল্প খানিকটা বলা যায়। মানুষকে কিছুটা চেনাও হয়তো যায়। আর, মানুষ তার গল্প মানুষের ইতিহাস হিসেবে পৃথিবীতে লিখে যেতে পারে। মানুষ তার কল্পনা ও ইচ্ছা অনুযায়ী ইতিহাস হতে পারে।
তাহলে বিশ্বাস ও মতের পার্থক্য একটি সমাজ কিভাবে মীমাংসা করে তার ওপর মূলত একটি সমাজের শক্তি নির্ভর করে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ঐতিহাসিক বাস্তবতার কারণে ভাষা ও জাতিবোধের মধ্যে আমরা নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্যের ক্ষেত্র খুঁজে পেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বিশ্বাস, দৃষ্টি ও চিন্তার পার্থক্যের নিরাকরণ ঘটিয়ে দিতে পেরেছে এই অনুমান তখন যেমন মারাত্মক ও বিপজ্জনক ভুল ছিল, সেটা এখন আরও ভয়াবহ ভুল হিসেবে হাজির হয়েছে। জাতিবোধ বা জাতীয়তাবাদকে শ্বাশ্বত গণ্য করার মধ্যেই ভুল ছিল।
অথচ একাত্তর ছিল একটা বড়সড় ঐতিহাসিক অর্জন। যার সম্ভাবনা ছিল অপরিসীম। কিন্তু রাজনৈতিক ঐক্যের উপলব্ধিতে অন্ধ হয়ে বিশ্বাস, দৃষ্টি এবং চিন্তার পার্থক্য ও বৈচিত্র্যকে আমরা অস্বীকার করে ভুল করেছিলাম। দরকার ছিল আরও গভীর পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে বিশ্বাস, দৃষ্টি ও চিন্তার পার্থক্য নিরসনের ক্ষেত্রগুলো অন্বেষণ করা। কিন্তু সেই কঠিন কাজ আমরা করিনি। করা দরকার সেই উপলব্ধিও আমাদের ছিল বলে মনে হয় না। এখন কতটা আছে সেটাও প্রশ্নের সম্মুখীন।
দ্বিতীয় ট্র্যাজেডি হচ্ছে ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতিবোধের ঐক্যের জায়গা থেকে আমরা ইসলাম প্রশ্নের মোকাবিলা করিনি। কিন্তু এখন ভুলের মাশুল শোধরানোর বিপজ্জনক ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আমাদের ইসলাম প্রশ্ন মোকাবিলা করতে হচ্ছে। মোকাবিলা করবার সেই সামর্থ ও সক্ষমতা আমাদের আদৌ আছে কিনা এখন আমার ঘোরতর সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এখন ‘বঙ্গে জিহাদের পুনর্জাগরণ’-এর পরিপ্রেক্ষিতে ও আইসিসের হুমকির মুখে আমাদের ইসলাম প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। খুব দেরি হয়ে গেল, তাই নয় কি?
একটা সময় ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর ইসলাম নিয়ে আলোচনা বাংলাদেশে একদমই অপ্রাসঙ্গিক মনে করা হতো। দাবি করা হতো, ইসলাম প্রশ্ন আমরা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে মীমাংসা করে ফেলেছি। আমরা বাঙালি। আমাদের জাতিসত্তা ও আত্মপরিচয়ের মধ্যে ইসলামের কোনো ভূমিকা নেই। ইসলাম আমাদের ধর্ম হতে পারে, কিন্তু ধর্ম একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। ইসলামকে অতএব সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক ক্ষেত্র থেকে বিদায় নিতে হবে। ইসলাম থাকতে পারে, তবে সেটা থাকবে একান্তই ব্যক্তিগত ধর্মচর্চার ক্ষেত্র হিসেবে। ব্যস। এটাই আমাদের ধর্ম নিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বাঙালি হবার একমাত্র তরিকা।
কিন্তু ধর্ম নিছকই ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার নয়। ধর্মের ইতিহাস আছে, তার সমাজতত্ত্ব আছে। ধর্ম সাড়ে ষোল আনা ইহলৌকিক ব্যাপার। ধর্ম মানুষের সমাজ ও ইতিহাসের বাইরে আসমানি কিছু নয়। ধর্মের মধ্য দিয়ে মানুষ চিন্তা করেছে, অতএব ধর্মতত্ত্বের মধ্য দিয়ে মানুষের চিন্তারই বিবর্তন ও বিকাশ ঘটেছে। যেকোনো ধর্মেরই কিছু মৌলিক দার্শনিক প্রস্তাবনা আছে। বিশ্বাসের নিশ্চিত নিশ্চয়বোধ থেকে ভিন্নভাবে সেই সকল প্রস্তাবনা নিয়ে দার্শনিক পর্যালোচনা সম্ভব। পাশ্চাত্যে ধর্ম আর দর্শনের ফারাক সাম্প্রতিক ব্যাপার। বুদ্ধি ও যুক্তির জায়গা থেকে নীতিবিদ্যার ভিত্তি হিসেবেও ধর্ম ভূমিকা রাখে। তাহলে নীতি-নৈতিকতার জায়গা থেকে ধর্মের বিচার দরকার। নানান দিক থেকে ধর্মের বিচার জরুরি। কিন্তু একাত্তরের পর আমরা ধরে নিয়েছি, এসবের দরকার নেই। এর মূল্য খুবই কঠিনভাবে সুদে আসলে এখন আমরা দিতে শুরু করেছি।
কিন্তু মাশুল দিতে গিয়ে আধুনিকতা ও আত্মপরিচয়ের রাজনীতির মধ্যে খাবি খেতে খেতে আমরা যেন নিশ্চিহ্ন হয়ে না যাই।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন