ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার আসার খবর পেয়ে তরুণ ছাত্রছাত্রীরা তৎক্ষণাৎ একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়। সেটা হোল শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ প্রদর্শন। সেই তাৎক্ষণিক ও স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভের একটি ভিডিও তাঁরা ইন্টারনেটে প্রচার করেন। বলাবাহুল্য, এই ভিডিওটি বিপুলভাবে ছড়িয়ে পড়ে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ চলছে এই স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ এক দিকে তারই অংশ, কিন্তু অন্য দিকে তার নিজস্ব তাৎপর্য রয়েছে। প্রথমত এই বিক্ষোভ সুনির্দিষ্টভাবে দিল্লির আগ্রাসী ও ঔপনিবেশিক নীতির বিরুদ্ধে। বিক্ষোভের ভিডিওটি জনপ্রিয় হবার প্রধান কারণ হচ্ছে দুটো স্বতঃস্ফূর্ত স্লোগান : ‘গো ব্যাক ইন্ডিয়া’ এবং ‘গো ব্যাক এনটিপিসি’। রামপাল চুক্তি বিরোধিতার এটাই হচ্ছে সারকথা। একই সঙ্গে তারা ‘স্টপ বর্ডার কিলিং’ স্লোগান দিয়েছিলেন। যথার্থ। সীমান্তে দিল্লি আর কত বাংলাদেশী হত্যা করবে?
গত ১৬ আগস্ট ভারতীয় দূতাবাসের উদ্যোগে এবং চারুকলা অনুষদের সহযোগিতায় আয়োজিত একটি চিত্রাংকন প্রতিযোগিতার উদ্বোধন উপলক্ষে বেলা ২টার পর থেকে চারুকলায় শিক্ষার্থীদের ওপর নজরদারি বেড়ে যায়। নিরাপত্তার নামে চারুকলায় ঢুকবার মূল প্রবেশপথ ও দেয়ালের ওপরের অংশ কালো কাপড় দিয়ে মুড়ে দেয়া হয়! ছবি আঁকার প্রতিযোগিতার নাম ছিল বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় উসকানিমূলক : India@Bangladesh। কালো কাপড় দিয়ে চারুকলা ঢেকে রাখার ভেতরে ‘বাংলাদেশে ভারত’ আয়োজকদের ভাষায় ‘ইন্ডিয়া অ্যাট বাংলাদেশ’ নামের ছবি আঁকার প্রতিযোগিতা! দারুণ বটে!
এনটিপিসি লিমিটেড ১৯৭৫ সালে গঠিত ভারতের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি। ভারতীয় ভাষায় পিএসইউ (Public Sector Undertakings)। আগে এর নাম ছিল National Thermal Power Corporation Limited। তবে এখন সংক্ষেপে এনটিপিসি নামেই পরিচিত। এনটিপিসির ঘোষিত নীতি হচ্ছে : ‘To be the world’s largest and best power producer, powering India’s growth’। অর্থাৎ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানি হয়ে ওঠা। কিভাবে সেটা তারা হতে চায় তার বড় একটি নজির হচ্ছে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প। সুন্দরবন ধ্বংস করা তার বাইরে দিক, যেটা সাধারণ মানুষ মোটামুটি বুঝতে পারে। এ নিয়ে যথেষ্ট লেখালেখি হয়েছে। বাকি সত্তর শতাংশ ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত এক্সিম ব্যাংক চড়া সুদে ধার দেবে। যার অর্থায়নের পেছনে রয়েছে ভারত হেভি ইলেকট্রিক কম্পানি। এটি একটি অসম চুক্তি। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের যোগসাজশে দিল্লির নির্লজ্জ বিনিয়োগ ও অন্যায়ভাবে মুনাফা কামানোর ফিকির মাত্র। অন্য দিকে এর পঞ্চাশ ভাগ মালিকানা দিল্লির। এই প্রকল্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার নামে দিল্লি কার্যত পুরা সুন্দরবনের ওপর এক প্রকার অলিখিত নজরদারি ও দখলদারি কায়েম করতে চাইছে। নদীপথ ও সমুদ্রপথে কয়লা পরিবহনের ফলে পরিবেশের বিপর্যয় নিয়ে যথেষ্ট লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু যে বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত হয়েছে সেটা হচ্ছে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন। বঙ্গোপসাগরকে কেন্দ্র করে চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মথ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে। নদীপথে ও সমুদ্রপথে শুধু কয়লা আনা-নেয়া হবে সেটা বঙ্গোপসাগরের ভূরাজনৈতিক ও সামরিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বাস করা কঠিন। বিশেষত এই প্রকল্পের মালিকানা কাগজে কলমে দিল্লির। দিল্লি তার সম্পত্তি রক্ষার জন্য এই প্রকল্প কেন্দ্র করে যেকোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। দুর্বল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের কিছুই করার থাকবে না।
এ কারণে ‘গো ব্যাক ইন্ডিয়া’ স্লোগান বা রণধ্বনি সারা বাংলাদেশেই ধ্বনিত হয়েছে। দিল্লি সমর্থিত শাহবাগী রাজনীতির পরে এটাই প্রথম শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তরুণদের রাজনীতির তাৎপর্যপূর্ণ রূপান্তরের ইঙ্গিত। দিল্লি সমর্থিত শাহবাগের আন্দোলন আর রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বা ভারতীয় আগ্রাসনবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে এখানেই গুরুতর পার্থক্য। এই আন্দোলন সম্পর্কে শেষ কথা বলার সময় আসেনি। কিন্তু বেশ কয়েকটি কারণে আমি এই বিক্ষোভকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। সে সম্পর্কে দুই একটি কথা বলে রাখতে চাইছি।
দুই
যারা রামপালে দিল্লির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছেন তারা নিজেরা এ ধরনের বিক্ষোভের তাৎপর্য নিয়ে আগেই ভেবেচিন্তে আন্দোলন শুরু করেছেন সেটা আমার দাবি নয়। বিক্ষোভটি ঘটে যেতে পেরেছে বলে আমরা তার তাৎপর্য নিয়ে এখন আলোচনা করতে পারছি। ইতিহাস বেইলি রোডের মঞ্চে অভিনয় করবার জন্য আগেই লিখে রাখা কোন নাটকের স্ক্রিপ্ট নয়। সমাজের দ্বন্দ্ব, সংঘাত, স্ববিরোধিতা ও নানাবিধ টানাপড়েনের মধ্য দিয়েই ইতিহাস তার চেহারা দেখায়। তত্ত্ব বা মতাদর্শের গুরুত্ব আছে, কিন্তু তত্ত্ববাগীশ বা মত প্রচারক হওয়ার মধ্যে একালে বিশেষ গৌরব নেই। আগাম তৈরি কোনো তত্ত্বের খাপের মধ্যে ফেলে বর্তমানের বিচার কিম্বা কোনো মতাদর্শের মানদণ্ড দিয়ে চলমান আন্দোলন সংগ্রামকে স্বীকৃতি বা নাকচ করা একালে মূর্খতার চর্চা মাত্র। বরং বর্তমানকে আমলে নিয়ে নিজের অনুমান ও সিদ্ধান্তকে ক্রমাগত প্রশ্ন ও পর্যালোচনা করাই একালে জরুরি কাজ। আমি বারবার বলেছি সুন্দরবন কেন্দ্র করে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন আমি তাকে নিঃশর্ত সমর্থন করি। এর কারণ হচ্ছে কার্ল মার্কসের কাছ থেকে বর্তমানকে বিচার করবার পদ্ধতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। সেটা হোল, তত্ত্ববাগীশতার চেয়ে সঠিক কর্মসূচিগত পদক্ষেপ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেটাই ইতিহাস তৈরি করে। রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলন সে কারণে এই সময়ের রাজনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই আন্দোলন সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন অতিক্রম করে এখন ‘গো ব্যাক ইন্ডিয়া’র রূপ নিচ্ছে। এটা ছিল এই আন্দোলনের স্বাভাবিক ও অনিবার্য পরিণতি। এই মুহূর্তে এটাই বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের মনের কথা। তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে তরুণদের মুখ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে, এটাই বাংলাদেশের রাজনীতির দিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত। বাংলাদেশের মানুষের মনে গো ব্যাক ইন্ডিয়া বিপুল আশার সঞ্চার করবে।
প্রথমত এটা কোনো পরিকল্পিত বিক্ষোভ নয়, ফলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মনের কথাই গো ব্যাক ইন্ডিয়া স্লোগানের মধ্য দিয়ে ধ্বনিত হয়েছে। এটা ভারতীয় হাইকমিশনারকে শোনানো জরুরি কাজ ছিল।
দ্বিতীয়ত তরুণেরা হাইকমিশনার যে কর্মসূচিতে এসেছিলেন সেখানে যেতে কেউ তাকে কোনো বাধা দেয়নি। তিনি শুধু দিল্লির কর্মচারী নন, একই সঙ্গে ভারতীয় জনগণের প্রতিনিধি, এই আন্দোলন ভারতের জনগণের বিরুদ্ধে নয়। বরং ভারতের জনগণকে বুঝতে দেয়া কিভাবে দিল্লির আগ্রাসী নীতি পুরা দক্ষিণ এশিয়াকে অস্থিতিশীল করে দিচ্ছে। বাংলাদেশকে কাশ্মির বানানোই দিল্লির পরিকল্পনা। এটা রুখে দেয়াই বাংলাদেশের এখনকার প্রধান ও একমাত্র রাজনীতি।
তৃতীয়ত পুলিশি হামলা হলে হতে পারত, কিন্তু এই বিক্ষোভে কোন ধস্তাধস্তি নেই। তাহলে পুলিশকেও বুঝতে হবে যে তারাই আসলে বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা বহাল রাখার ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা। তাদের সহিংস ভূমিকাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তৈরি করে। হয়তো বিক্ষোভের সিদ্ধান্ত জানাজানি না হওয়ার কারণে বিক্ষোভকারীদের পুলিশি সহিংসতার মুখোমুখি হতে হয়নি। কিন্তু তারা প্ল্যাকার্ড নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে তাদের স্লোগান দিয়ে গেছেন। এটা গুরুত্বপূর্ণ। হাসানুল হক ইনুর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল একসময় ভারতীয় হাইকমিশনারকে অপহরণ করার মতো ‘জঙ্গি’ তৎপরতায় নিয়োজিত হয়েছিল। তার উপসংহার হয়েছে মৃত্যু, রক্তপাত, জেল ও জুলুমে। হাসানুল হক ইনু এখন দিল্লি সমর্থিত শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। পুরানা ইতিহাসগুলো মনে রাখতে হবে, নইলে এখন আমি এই শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকে কেন তাৎপর্যপূর্ণ বলছি সেটা বোঝা যাবে না।
চতুর্থ দিক হচ্ছে, সুন্দরবন রক্ষা কিম্বা সাধারণভাবে প্রাণ ও প্রকৃতির সুরক্ষার রাজনীতি আর রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরোধিতার মধ্যে বিরাট পার্থক্য আছে। বিক্ষোভকারীরা সুন্দরবন ধ্বংস করে বিদ্যুৎকেন্দ্র চান না সেই স্লোগান দিয়েছেন। তাহলে তাঁরা কি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চান? শুধু শর্ত হচ্ছে সেটা সুন্দরবন ধ্বংস করে কিম্বা ক্ষতি করে নয়। তাহলে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে প্রাণ ও প্রকৃতির ক্ষতি হলেও তাঁরা কি তা মেনে নেবেন? সেই কথাই জ্ঞানে কিম্বা অজ্ঞানে তারা তাদের স্লোগানের মধ্য দিয়ে বলছেন। তার মানে সুন্দরবন ছাড়া বাংলাদেশের অন্য কোন অঞ্চলের প্রকৃতি বা পরিবেশের প্রাণ ও প্রাণের বৈচিত্র্য ধ্বংস করা যাবে, কিন্তু সুন্দরবন ‘মহাপ্রাণ’। এই তথাকথিত ‘মহাপ্রাণ’ ধ্বংস করা যাবে না। ‘সুন্দরবন ধ্বংস করে রামপাল চাই না’- এই স্লোগানের উহ্য কথাটা হচ্ছে রামপাল অন্য কোথাও হোক, আপত্তি নেই, তবে সুন্দরবনের ধারে কাছে নয়। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন অন্য কোনো অঞ্চলের প্রাণ ও প্রকৃতি ধ্বংস করে হোক। আমরা বিদ্যুৎ চাই, কিন্তু কিন্তু সুন্দরবন রক্ষা করে করা হোক। অন্যত্র। ‘সুন্দরবন ধ্বংস করে রামপাল চাই না’ স্লোগানের এটাই মর্মার্থ।
সকলে প্রাণ ও প্রকৃতি সুরক্ষার রাজনীতি করবেন, এটা আমার দাবি কিম্বা আবদার নয়। এটাই বলতে চাইছি যে সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সেটা এখনো প্রাণ ও প্রকৃতি সুরক্ষার আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়নি। এই গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনের সারকথা হচ্ছে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প দিল্লির আগ্রাসী ও ঔপনিবেশিক নীতির নির্লজ্জ অভিপ্রকাশ। এই আগ্রাসনের বিরোধিতাই এই আন্দোলনের মৌলিক তাৎপর্য। সে কারণে ভারতীয় হাইকমিশনারকে ‘গো ব্যাক ইন্ডিয়া’ প্ল্যাকার্ড দেখানো, কিম্বা সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনে যারা দিল্লিবিরোধী স্লোগান দিচ্ছেন তাদের রাজনৈতিক সচেতনতা ও সজ্ঞান অবস্থানটাই এই আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। একে প্রাণ ও প্রকৃতি সুরক্ষার রাজনীতি বলে বাহবা দিলে ক্ষতি নেই, যদি আসলে সেই রাজনীতিটা কী এবং কিভাবে তার বিকাশ ঘটানো সম্ভব তা নিয়ে আমরা ভাবনাচিন্তা শুরু করি। আন্দোলন সেই ভাবনাচিন্তার সুযোগ করে দিচ্ছে। চিন্তাশীল তরুণেরা নতুন করে ভাবতে পারছে।
সুন্দরবনের প্রতি দরদ প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির রোমান্টিক আকুতি মাত্র। এতেও আমি কোনো অন্যায় দেখি না। প্রাণ ও প্রকৃতি সুরক্ষার রাজনীতির আরম্ভ এভাবে অবশ্য হতেই পারে। এভাবেই হয়। ফলে একে নিন্দা করার কিছু নেই। কিন্তু রোমান্টিক ‘মহাপ্রাণ’ ধারণার সীমাবদ্ধতা এবং প্রাণের স্তরবিভাগ তৈরি অর্থাৎ প্রাণ ও মহাপ্রাণের মধ্যে হায়ারার্কি বানানোর বিপদ সম্পর্কে সচেতন থাকা সম্পর্কে শুরু থেকেই সাবধান ও সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষত যারা প্রাণ ও প্রকৃতি সুরক্ষার রাজনীতির গুরুত্ব ও তাৎপর্য টের পেয়ে গেছেন এবং সেই রাজনীতি বিকশিত করতে বদ্ধপরিকর, তাদের এই ক্ষেত্রে সজ্ঞান ও সতর্কতা জরুরি। সুন্দরবন সম্পর্কে রোমান্টিক মৃত মিউজিয়ম মার্কা চিন্তা প্রাণ ও প্রকৃতির রাজনীতির সঙ্গে মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। প্রাণ ও প্রকৃতি বিধ্বংসী বিদ্যুৎ প্রকল্প চাই, কিন্তু সুন্দরবনে বা সুন্দরবনের কাছে হোক সেটা চাই না তাই কি? তাহলে কি সেটা আমাদের বাড়ির কাছে নেবো আমরা? আমাদের নিজ গ্রামে বাস্তবায়ন করবো? এটা আগামীর বিপ্লবী তারুণ্যের রাজনীতি হতে পারে না। বরং জীবাশ্মভিত্তিক সভ্যতা অর্থাৎ প্রাণ ও পরিবেশবিধ্বংসী বিশ্বব্যবস্থা সম্পর্কে আগে প্রশ্ন করতে শিখতে হবে আমাদের। জানতে হবে পরিবেশবিধ্বংসী জীবাশ্ম জ্বালানি (fossil fuel) ভিত্তিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিভিলাইজেশান নিরন্তর প্রাণ ও প্রকৃতির খোদ ভিত্তির বিনাশ ঘটিয়ে চলেছে। আমরা আজকাল জলবায়ুর বিপর্যয়ের কথা শুনছি। প্রতিদিন কোনো না কোনো প্রাণের প্রজাতি বা পরিবার বিলুপ্ত হচ্ছে, প্রজাতি হিসেবে মানুষ শেষাবধি টিকে থাকবে কি না সেটাই এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে। প্রশ্ন হচ্ছে জীবাশ্মভিত্তিক সভ্যতার রূপান্তর ঘটানো কি সম্ভব? কিভাবে কোথায় সেই রূপান্তরের কাজ আমরা শুরু করব? সেটা কি এখনই শুরু করতে পারি? নিজেদের জীবনযাপন বদলানোর কাজ তো এখন থেকেই শুরু করতে হবে। শুধু রাস্তার আন্দোলন যথেষ্ট নয়। কিভাবে থাকি, কী খাই, কিভাবে চলি- এসব কিছুই আমাদের নিত্য জীবনযাপনের প্রতিটি মুহূর্তের মধ্যেই প্রতিরোধের চরিত্র থাকতে হবে।
সুন্দরবনের বিনাশ এই প্রকল্প শুরুর মধ্য দিয়ে শুরু হচ্ছে না। সেই বিনাশ শুরু হয়েছে বহু আগে থেকেই। সুন্দরবনে বসতি নির্মাণ ও আধুনিক জীবনযাপনের ফল হিসেবে চকরিয়া সুন্দরবন ধ্বংস হয়েছে অনেক আগে। সেখানে কোনো ভারতীয় কম্পানি ছিল না। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের রফতানিমুখী উন্নয়ন নীতির কারণে আমরা চিংড়ি চাষের প্রকল্প নিয়েছি। চকরিয়া সুন্দরবন সেই উন্নয়নের তোড়ে দশ বছরের মধ্যেই বিরান হয়ে গেছে। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট এলাকা চিংড়ির ঘেরের কারণে নোনা পানি ঢুকেছে সুন্দরবনে। সুন্দরবন ধ্বংসের দিকেই যাচ্ছে। যদি আমরা তা দ্রুত প্রতিহত করতে না পারি। রফতানিমুখী উন্নয়ননীতি এবং এখনকার নয়াবাজারবাদী কাছাখোলা অর্থনীতিই তার কারণ। এখন যারা সুন্দরবনের প্রতি রোমান্টিক মমতায় কাতর তারা সুন্দরবন রক্ষার জন্য চিংড়িঘেরের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণের লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস সম্পর্কে আদৌ কিছু জানে কি না আমার সন্দেহ আছে। শুধু আন্দোলন নয়, স্থানীয় জনগণ নতুন করে সুন্দরবনের গাছ ও প্রজাতি পুনরায় ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করছে দীর্ঘদিন ধরে। ফলে স্থানীয় জনগণের লড়াই-সংগ্রামের সঙ্গে শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংগ্রামকে যুক্ত করবার নীতি ও কৌশল নিয়ে ভাবা দরকার। বন ধ্বংস হয়ে গেলে তাকে আগের অবস্থায় পাওয়া যায় না ঠিক, কিন্তু তাকে নতুন করে গড়া যায়। সেই বিজ্ঞান ও কর্মদক্ষতা স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে শেখার দরকার আছে।
তিন
মধ্যবিত্ত শ্রেণী সবে প্রাণ ও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠছে। সুন্দরবন সম্পর্কে তাদের বই পড়ার জ্ঞান বা ভ্রমণবিলাসী রোমান্টিক ধারণা থাকতেই পারে। থাকুক। এটা খারাপ কিছু নয়। কিন্তু প্রাণ ও প্রকৃতির রাজনীতি জীবাশ্মভিত্তিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিভিলাইজেশানের পর্যালোচনা ও তার সম্ভাব্য বিকল্প ও রূপান্তর নিয়ে ভাবনা। আমাদের সেই দিকে কয়েক কদম এগিয়ে যেতে হবে। ছেঁড়া সুতাগুলো জোড়া দেয়াও এখন বড় কাজ। আন্দোলনকারীদের কাছে এখনো সেটা স্পষ্ট কি না জানি না। তবে সেই দিকগুলো নিয়ে ভাবতে হবে।
দিল্লি নির্লজ্জভাবে বাংলাদেশকে উপনিবেশে পরিণত করেছে। সেটা বাংলাদেশ ঘিরে কাঁটাতারের বেড়া দেয়া, নিত্য সীমান্তে আইনবহির্ভূতভাবে বাংলাদেশীদের হত্যা, কানেক্টিভিটির নামে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে রাস্তা বা করিডোর বানানো, বিপুলসংখ্যক ভারতীয়ের বাংলাদেশে চাকরি পাওয়া ও অর্থ পাচারের ব্যবস্থা করা, বাংলাদেশের ব্যবসাবাণিজ্য বিনিয়োগ ও কুক্ষিগত করা, আমদানি রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভাগে ঘাটতি বাড়াতে থাকা ইত্যাদি। তাই গো ব্যাক ইন্ডিয়া স্রেফ ঢাকা শহরের স্লোগান থাকেনি। সারা বাংলাদেশেই ধ্বনিত হয়েছে। সুন্দরবন রক্ষা আন্দোলনের সাফল্য এখানেই।
তবে আন্দোলনের শ্রেণির প্রশ্ন মনে রাখলে আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আমরা হুঁশিয়ার থাকতে পারি এবং তা অতিক্রম করে যাবার নীতি ও কৌশল নিয়ে ভাবতে পারি। সাধারণত মধ্যবিত্ত শ্রেণি যখন পরিবেশ ও প্রকৃতির কথা বলে তখন সে নদী, জমি, পাহাড়, সুন্দরবন, বাঘ, ভাল্লুক, পাখি ইত্যাদি নিয়ে খুব কাতর হয়ে যায়। ব্যাপারগুলো খুবই রোমান্টিক ও রাবীন্দ্রিক ব্যাপার ধারণ করে। তারা ‘প্রাণবৈচিত্র্য’ বলে না, বলে ‘জীববৈচিত্র্য’ ... অথচ প্রাণবৈচিত্র্য মানে শুধু জীবজন্তুর বৈচিত্র্য না ... বরং বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, জীবনব্যবস্থা, খাদ্যব্যবস্থা, প্রকৃতির সঙ্গে তাদের দৈনন্দিনের সম্পর্ক ইত্যাদি সুরক্ষার ব্যাপারও বটে।
খেয়াল করা দরকার মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক হয়ে গেছে বাঘ- রয়েল বেঙ্গল টাইগার। অথচ গরান বনের (Mangrove Forest) প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা খুবই জটিল ব্যাপার। দুই এক প্রজাতির পশু বা পাখি রক্ষা করা না। এই খবরটুকুও অনেকের কানে আসেনি যে ধরিত্রি সম্মেলনে (Earth Summit 1992) বায়োডাইর্ভাসিটি সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে ইন্ডিজেনাস অ্যান্ড লোকাল কমিউনিটির কথা বারবার জোর দিয়ে বলতে হয়েছে। মানুষের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে ‘জীববৈচিত্র্য’ সংক্রান্ত ধারণা পাতি বুর্জোয়া ও করপোরেট ধারণা। ‘জীববৈচিত্র্য’ আর ‘প্রাণবৈচিত্র্য’ ইংরাজি বায়োডাইভার্সিটিত শব্দটি অনুবাদের সমস্যা নয় পরিবেশ আন্দোলন বিশেষত প্রাণ ও প্রকৃতি সুরক্ষার রাজনৈতিক মর্ম বুঝবার অভাব ও পার্থক্য। যে কারণে বাঘ রক্ষার আন্দোলন যত গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় সেই তুলনায় মধ্যবিত্ত শ্রেণি কৃষকের বীজ রক্ষার আন্দোলনকে অত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না। বীজ ও খাদ্যব্যবস্থা চোখের সামনে দুই এক দশকের মধ্যেই বহুজাতিক বীজ কম্পানির অধীনে চলে যাওয়ার পরেও তাদের হুঁশ নেই। রাজনীতিতে চিন্তার এই অভাব বা খামতিগুলো বোঝার দরকার আছে।
শেখ হাসিনা যখন ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতে গিয়েছিলেন তখন দিল্লির সঙ্গে যে যৌথ ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছেন রামপাল প্রকল্প তারই অন্তর্গত। এটা নিছকই বিদ্যুৎ উৎপাদন বা উন্নয়ন প্রকল্প নয়, দিল্লির আগ্রাসী রাজনৈতিক প্রকল্পেরই অংশ। যারা এখন রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন তাদের মধ্যে অনেকে আছেন, যারা ক্ষমতাসীন সরকারের নীতির সমর্থক কিম্বা ক্ষমতাসীনদের ইসলামবিদ্বেষী রাজনৈতিক বলয়ের অন্তর্গত, বাইরের কেউ নয়। তারা দিল্লিবান্ধব রাজনীতি করেন। তাই না? ফলে তাদের পক্ষপাতদুষ্ট অস্বচ্ছ রাজনৈতিক অবস্থান এই আন্দোলনের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মর্ম বিকাশের ক্ষেত্রে বড় একটা প্রতিবন্ধকতা হয়ে আছে। দিল্লির প্রশ্নে তাদের কণ্ঠ নিচু খাদে নেমে গিয়ে প্রায় নিঃশব্দ হয়ে যায়। আর প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন সরকারের বিরোধী যে গণরাজনীতি তারও বিরোধী। এটাই বাস্তবতা। ঠিক কি না? রাজনীতির কথা বললে শ্রেণির প্রশ্ন ছাড়াও এসব বিবেচনাও মাথায় রাখতে হয়। জাতীয় সম্পদ রক্ষার ক্ষেত্রে এত বছর ধরে গড়ে তোলা অতি গুরুত্বপূর্ণ এ আন্দোলনের পেছনে এ কারণেই পুরা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা যায়নি। কারণ শেষতক মধ্যবিত্ত শ্রেণি একে একটি বিশেষ ধারার রাজনীতি বহন করবার কাজেই খাটাচ্ছে গণমানুষের সামষ্টিক স্বার্থ এতে গৌণ হয়ে যাবার বিপদ থেকে যায়। এই দিকগুলো মনে রাখলে কেন আমি গো ব্যাক ইন্ডিয়া, গো ব্যাক এনটিপিসি, স্টপ বর্ডার কিলিং ... এই স্লোগানগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি সেটা বোঝা যাবে।
আমাদের সীমাবদ্ধতা আরো আছে। এটা আমাদের ট্র্যাজেডি যে সেকুলার ও ধর্মপন্থার বাইনারি অতিক্রম করে আমরা গণমানুষের স্বার্থের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত রামপাল জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ হতে পারছি না। ইসলামপন্থীরা পরকালের বেহেশতের স্বপ্নে বিভোর, ফলে আল্লাহর দুনিয়ায় আল্লাহ নিজে মানুষের জন্য যেসব অপূর্ব সৃষ্টির নজির রেখেছেন তাকে রক্ষার কোন ঈমানি দায়িত্ব তাঁরা বোধ করেন না। সুন্দরবন রক্ষা কিম্বা প্রাণ ও প্রকৃতির সুরক্ষা নিশ্চিত করা তাদের ঈমানি পরীক্ষার ক্ষেত্র হতে পারত, কিন্তু এই কঠিন পরীক্ষা তারা দিতে নারাজ। অন্য দিকে বঙ্গীয় সেকুলারদের ইসলামবিদ্বেষ এবং গণমানুষের আধ্যাত্মিক জীবন এবং অমীমাংসিত নানাবিধ প্রশ্নের প্রতি উপেক্ষা আন্দোলনকে শেখ হাসিনার ঘরের লড়াইয়ে পরিণত করে রেখেছে। এই সীমাবদ্ধতা যত তাড়াতাড়ি তরুণরা ভাঙতে পারবে ততই আগামীতে জাতীয় নেতৃত্বের ফাঁকা জায়গাগুলো তাদের নিজের হাতে তুলে নিতে সক্ষম হবে।
বিএনপিও ক্ষমতায় যাবার জন্য ভারত তোষণনীতি গ্রহণ করেছে এবং রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে কিছু বলছে না এটা তাদেরকে জনগণের কাছ থেকে শুধু দূরে সরিয়ে দিচ্ছে না, রাজনৈতিকভাবে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলছে। বাংলাদেশের জনগণকে যারা সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে তৈরি হয়ে উঠছে তারা কোনো দলের প্রতি মুখাপেক্ষী থাকবে না। এটা আমরা আশা করতে পারি।
আন্দোলনে ক্ষমতাসীনদের সাময়িক সুবিধা হতে পারে। তারা দিল্লিকে দেখাতে পারছে এত বিরোধিতার পরেও রামপাল প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশের সেকুলার ও কমিউনিস্টরা বিএনপির নেতৃত্বে বিশদলীয় জোটকে দমন করার জন্যে শেখ হাসিনাকে চায়, আবার ক্ষমতাসীনরা রামপাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে তাকেও মেনে নিতে পারছে না। খুবই ট্রাজিক অবস্থা। এই দ্বৈত নীতি নিয়ে রামপালের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ এই আন্দোলন সফল হবে না, এটা ঠিক। কিন্তু এই সীমাগুলোই তো তরুণরা ভাঙছে।
অতএব গো ব্যাক ইন্ডিয়া, গো ব্যাক এনটিপিসি। স্টপ বর্ডার কিলিং। যথেষ্ট হয়েছে। আর নয়।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন