আগস্ট মাসে শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে ‘মৃত্যুবার্ষিকী’ হিসেবেই পালন করা হতো। আজকাল ‘শাহাদাত বার্ষিকী’ হিসেবে উদযাপন করা হচ্ছে। এটা নতুন। এবারের নতুন আরেকটি দিক হল ‘শাহাদাত বার্ষিকী’ উদযাপনের জন্য শিল্পকলা একাডেমি ‘সাধুসঙ্গ’ আয়োজন করেছে।
এতকাল আওয়ামী লীগ আগস্ট মাসকে শোকের মাস হিসেবেই পালন করে এসেছে। ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবার হত্যা নানা স্তরে বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহের নির্ণায়ক হয়ে ওঠে। এতে ক্ষমতা থেকে ব্যক্তি হিসেবে তাকে অপসারণ করা সম্ভব হয়েছে; কিন্তু ইতিহাসের শেখ মুজিবকে মুজিবোত্তর বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যায়নি। সেটা সম্ভবও নয়। অন্যদিকে ইতিহাসে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকার নির্মোহ পর্যালোচনা এখনও সম্ভব নয়। কারণ রাজনীতিকে আমরা আবেগের আতিশয্য থেকে মুক্তি দিতে পারি না, অন্যদিকে জাতীয় ব্যক্তিত্বকে দলীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করার ক্ষেত্রেও আমাদের জুড়ি নাই। আওয়ামী লীগ মেনে নেবে না; কিন্তু জিয়াউর রহমান সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে দলীয় প্রচার-প্রপাগান্ডার বাইরে যত তাড়াতাড়ি আমরা তাদের নির্মোহ বিচারের অধীন করতে পারব, ততই তাদের জাতীয় তাৎপর্য স্পষ্ট হয়ে উঠবে। সেটা খুব সহজ কাজ নয়।
জিয়াউর রহমানও নিহত হয়েছিলেন। তাকে বিএনপি ‘শহীদ’ মনে করে, ফলে তার নামের আগে শহীদ জিয়াউর রহমান বলতে তাদের অসুবিধা হয়নি। তবে নিহতদের নামের আগে ‘শহীদ’ জুড়ে দেয়ার চল সেক্যুলারদের হাতেই ঘটেছে। একুশের শহীদ সালাম-বরকত যেমন। তাদের স্মৃতিতে বানানো ‘শহীদ মিনার’ ইত্যাদি। বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষওয়ালাদের কেন ধর্মীয় প্রতীকের প্রয়োজন হয়- সেটা রাজনীতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণার খুবই উর্বর জায়গা।
একুশের শহীদদের উদাহরণ আছে বলে বিএনপি সেক্যুলার দল হয়েও জিয়াউর রহমানকে ‘শহীদ’ বলতে অসুবিধা বোধ করেনি। জিয়াউর রহমানকে তাই ‘শহীদ জিয়াউর রহমান’ বলার চল হয়েছে। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর এ ধর্মীয় খেতাব আরোপ কঠিন ছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি মিশ্রণের প্রবল বিরোধিতা করে, ফলে তাদের পক্ষে শেখ মুজিবকে শহীদ মুজিব বলা আসলেই কঠিন। তবে গত কয়েক বছর ধরে দেখছি ১৫ আগস্টকে শেখ মুজিবুর রহমানের ‘শাহাদাত বার্ষিকী’ বলার চল বেড়েছে। তাকে ‘শহীদ’ বলার ক্ষেত্রে একমাত্র বাধা হচ্ছে তার নামের আগে ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবটি। এতেই তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছেন। তবে এ বছরই মনে হচ্ছে ১৫ আগস্টকে শাহাদাত বার্ষিকী হিসেবে উদযাপন করার সচেতন আওয়ামী প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে। সংবাদপত্রে আগস্টের শুরু থেকে যেসব খবর পড়ছি, তাতে প্রায়ই ১৫ আগস্টকে মৃত্যুবার্ষিকী না বলে ‘শাহাদাত বার্ষিকী’ বলা হচ্ছে। এটা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ রূপান্তর। শুধু আওয়ামী লীগের নয়, বাংলাদেশের রাজনীতিরও বটে। মূলত ২০১৩ সালের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির যে গুণগত রূপান্তর শুরু হয়েছে, এটা তারই ধারাবাহিকতা মাত্র। এটা সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির ইসলামীকরণ কিনা সেটা পুরোপুরি বলার সময় আসেনি। তবে আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক বদলাচ্ছে, এটা পরিষ্কার।
এটা অভিযোগ আকারে অবশ্য ইসলামবিদ্বেষী ব্লগার ও শাহবাগের সমর্থকরা অনেক আগেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে আসছিল। আওয়ামী লীগ ব্লগার হত্যার কোনো কূলকিনারা আজও করতে পারেনি, উল্টো তারা ধর্মপন্থীদের তোষণ করার নীতি গ্রহণ করেছে। তাদের এ অভিযোগ খুব মিথ্যা নয়; কিন্তু তাদের ঐতিহাসিক অজ্ঞতা হল আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে জন্ম নেয়া আওয়ামী লীগ ধর্ম তোষণ আজ করছে, ব্যাপারটা এমন নয়। সত্তর দশকে শেখ মুজিবুর রহমানকে বারবার বলতে হয়েছে, আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে; কিন্তু তারা ধর্মবিদ্বেষী, কিংবা ইসলামবিদ্বেষী নয়। সত্তরের নির্বাচনে এ ইস্যুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু ছিল। কোরআন সুন্নাহর বিরোধী কোনো আইন আওয়ামী লীগ সমর্থন করবে না, এ প্রতিশ্র“তি শেখ মুজিবকে যেমন দিতে হয়েছে, শেখ হাসিনাও নানা সময়ে বলেছেন।
আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষ নিয়ে রাজনীতি করে, ফলে মুখে যতই লম্বাচওড়া কথা তারা বলুক, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের ক্ষেত্রে আওয়ামী রাজনীতি সবসময়ই কুশলতার পরিচয় দিয়েছে। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, নৌকার মালিক তুই আল্লাহ’- এটা জনপ্রিয় আওয়ামী স্লোগান।
শাহবাগের সমর্থকরা ঠাণ্ডা মাথায় তাদের কৃতকর্মের বিচার করতে সক্ষম কিনা সেই সন্দেহ আমি করি। শাহবাগ শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীকেন্দ্রিক আন্দোলন ছিল, তাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে শাহবাগের বিপুল ইতিবাচক সম্ভাবনা ছিল। যেমন, অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে বিপুল জনসমাগম সংগঠিত করতে পারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল। এ সমাবেশের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক শক্তির নজির স্থাপন, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করে ন্যায়বিচারের ঐতিহ্য কায়েম করা ইত্যাদির আরও বড় রূপান্তরের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেটা ঘটেনি। বোঝা গেল শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণী ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আরও নিখুঁত করে তুলতে পারে, কিন্তু রূপান্তরের কোনো পথ দেখাতে পারে না। এটা নতুন কোনো কথা নয়। শ্রমিক, কৃষক বা সাধারণ মানুষ যে আন্দোলনে জড়িত থাকে না, তার পরিণতি ভিন্ন কিছু হয় না।
২০১৩ সাল থেকে আওয়ামী লীগ নিজেকে আগের চেয়েও আরও অধিক তৎপরতার সঙ্গে ইসলামবিদ্বেষীদের কাছ থেকে দূরত্ব তৈরির চেষ্টা করছে। এর একটা কারণ ৫ মে শাপলা চত্বরে আলেম-ওলামাদের বিরুদ্ধে সরকারের আচরণে আওয়ামী লীগের যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে, দলটি তা কাটিয়ে উঠতে চায়। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ কিছুটা সফল হয়েছে বলতে হবে। এই তৎপরতার আরেকটি নিদর্শন হচ্ছে ১৫ অগাস্টকে শেখ মুজিবুর রহমানের ‘মৃত্যুবার্ষিকী’ হিসেবে পালন না করে একে ‘শাহাদাত বার্ষিকী’ হিসেবে পালন করা।
দুই
এই পরিপ্রেক্ষিতে কোনো একটি সংবাদে পড়লাম, শেখ মুজিবুর রহমানের ‘শাহাদাত বার্ষিকী’ উদযাপনের জন্য শিল্পকলা একাডেমি ‘সাধুসঙ্গ’ আয়োজন করেছে। খবরে এটা জেনে একটু হকচকিয়ে গেলাম। লালনপন্থী ফকিরদের জন্য ‘সাধুসঙ্গ’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান। একজন খেলাফতধারী লালনপন্থী ফকিরই শুধু তার আখড়ায় সাধুসঙ্গের আহ্বান জানাতে পারেন। তিনি তিরোধান করলে তার শিষ্যশাবকরা তার আখড়ায় একই তারিখে সেই অনুষ্ঠান সাধারণত চালিয়ে যান। যেমন গৌরপূর্ণিমায় (বা দোলপূর্ণিমায়) ছেঁউড়িয়ায় লালন প্রবর্তিত বিখ্যাত সাধুসঙ্গ। সাধু নিজে সাধুসঙ্গের দিন-তারিখ নির্ধারণ করার অধিকারী নন। সেটা করেন তার গুরু। অর্থাৎ গুরুর নির্দেশে বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে গুরুর হাতে খেলাফত নেয়া ভক্ত গুরুর নির্দেশে নিজের আখড়ায় সাধুদের নিয়ে যে সঙ্গ করেন তাকেই শুধু ‘সাধুসঙ্গ’ বলা হয়। সেখানে গুরু স্বয়ং হাজির থাকেন। শিষ্য তার সেবার ‘পারস’ ভক্তির থালা গুরুকেই নিবেদন করেন। মনে আছে, এর আগে লালন প্রেমিক তরুণরা চারুকলায় কয়েকটি সাধুসঙ্গ করেছিলেন। তারা বাউল ফকিরদের গান ভালোবাসেন, অনেকে আমার স্নেহভাজন এবং লালনপন্থী ফকিরদের সঙ্গে তারা আন্তরিকভাবে নিয়মিত ওঠাবসা করেন। এর ফলে অনেকের ধারণ হয়েছিল, বাউল ফকিরদের নিয়ে একসঙ্গে গান করলেই সেটা বুঝি সাধুসঙ্গ হয়। এটা ভুল ধারণা।
সাধু বাউল ফকিরদের নিয়ে একসঙ্গে গানবাজনা করাকেই ‘সাধুসঙ্গ’ বলা হয় না, এটা বোঝা জরুরি। সাধুসঙ্গে লালন ও অন্যান্য সাধকের গান গাওয়া হয় বটে, তবে সাধুসঙ্গের মূল উদ্দেশ্য সঙ্গীত অনুষ্ঠান মোটেও নয়। তাই বাউলদের গানের অনুষ্ঠানকে ‘সাধুসঙ্গ’ বলা হলে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। সাধু, বিশেষত নদিয়ার লালনপন্থী ফকিরদের জীবনচর্চার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান হচ্ছে ‘সাধুসঙ্গ’। কে সাধুসঙ্গ আহ্বানের অধিকারী, সাধুসঙ্গের বিধিবিধান ও সেবা পদ্ধতি কী এবং তা পালনের শর্তগুলো পালিত হচ্ছে কিনা সেটা পর্যবেক্ষণের কারা অধিকারী ইত্যাদি নানান বিষয় রয়েছে, যা লালনপন্থী ফকিরদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণে ‘সাধুসঙ্গ’ ধারণাটির নির্বিচার যত্রতত্র ব্যবহার বাঞ্ছনীয় নয়। অজ্ঞতা উপেক্ষার শামিল এবং সেটা অবস্থা অনুসারে অপরাধের মধ্যেই পড়ে। শিল্পকলা একাডেমি এসব বিষয়ে সতর্ক থাকবে এটাই আমরা আশা করি। সংবাদপত্রের কর্মীদের কাছেও আশা যে, তারা বাউল গানের আসরকে বাউল গানের আসরই বলবেন, ‘সাধুসঙ্গ’ বলবেন না। দরকার কী? এতে তো গানের মহিমা ম্লান হবে না।
এটা আশা করি বোঝাতে পেরেছি, শিল্পকলা একাডেমি কোনো সাধুর আখড়া নয়, যেখানে একজন আসনধারী ফকির আছেন যিনি গুরুর নির্দেশে বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে সাধুসঙ্গ আহ্বান করেন। শিল্পকলা একাডেমির কর্তৃপক্ষ কোনো সাধুসঙ্গ আহ্বান করতে পারে না, কারণ তারা এর অধিকারী নয়। ফলে খবরের কাগজওয়ালারা যদি ভুল বুঝে থাকেন সেটা তাদের সমস্যা, আশা করি শিল্পকলা একাডেমি এই ভুল করবে না। তারা শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে লালনের গানের আসর বসিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে একটি খবরে দেখছি বলা হয়েছে :
‘‘সবলোকে কয় লালন কী জাত সংসারে’, ‘তিন গর্ভে আছে রে এক ছেলে’, ‘তোমার মতো দয়াল রাসূল আর পাব না’, ‘জাত গেল জাত গেল বলে, ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে’, ‘আমি অপার হয়ে বসে আছি’, ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’, ‘বাড়ির কাছে আরশিনগর’- লালনের ইত্যাদি অমিয় বাণীর সুধা কণ্ঠে তুলে নিয়ে শিল্পীরা শুধু সুরের আবেশই ছড়ালেন না, সাঁই ভক্তদের অবগাহন করালেন ভাবের জগতে। এমন চিত্রই ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ৪১তম শাহাদাত বার্ষিকীর মাসব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবে তিন দিনব্যাপী বাউল গানের আসরের প্রথম দিনে। গতকাল সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে শুরু হয় তিন দিনব্যাপী এই আয়োজন।” (দেখুন, বাংলাদেশ ‘লালন বন্দনায় মুখরিত শিল্পকলা’, প্রতিদিন, ১২ আগস্ট ২০১৬)।
‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ৪১তম শাহাদাত বার্ষিকীর মাসব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবে তিন দিনের বাউল গানের আসর’, বাংলাদেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন বোঝার জন্য এই বাক্যটি বেশ ভালো একটি ইঙ্গিত। আমরা এখন শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাত বার্ষিকীই শুধু উদযাপন করছি না, শিল্পকলা একাডেমিতে তিন দিন ধরে বাউল গানের আসরও বসাচ্ছি। সাংস্কৃতিক জগতের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ কীভাবে ইসলামী ভাবধারা আত্মস্থ করে নিতে চাইছে সেটা অনেকের কাছে ক্যারিকেচার মনে হলেও বাংলাদেশের রাজনীতি বোঝার জন্য খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার।
তবে শিল্পকলা একাডেমি আশা করি জানে যে, ‘তিন গর্ভে আছে রে এক ছেলে’ কিংবা ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে’ ইত্যাদি লালন ফকিরের গান নয়। তবে অনেক বাউল একে লালনের গান বলে গেয়ে থাকেন। তারা গাইতেই পারেন। শিল্পকলা একাডেমির দায়িত্ব হচ্ছে সঠিকভাবে এসব বিষয়ে গবেষণা করা।
আজকাল নতুন একটি পরিভাষাও শুনছি। সেটা হচ্ছে ‘ভাবশিষ্য’। অনেক বাউল কিংবা লালনের গান গেয়ে থাকেন এমন অনেকে নিজেকে লালনের ‘ভাবশিষ্য’ বলে পরিচয় প্রকাশ করেন। তবে এটা স্পষ্ট থাকা দরকার যে, গুরু-শিষ্য পরম্পরা মেনে সাধন ভজনের যে ধারা, সেখানে ‘ভাবশিষ্য’ নামক কোনো বর্গ, ক্যাটাগরি বা পরিভাষা নাই। যারা লালনকে ভালোবাসেন, লালনের গান গেয়ে থাকেন কিংবা আনন্দের সঙ্গে শোনেন, তাদের জন্য কিছু কথা বলে রাখা দরকার।
কোনো গুরু-গোঁসাইয়ের অধীন না হয়েও নিজেকে ‘ভাবশিষ্য’ বলা অর্থহীন। জানা দরকার লালনপন্থা বা নদিয়ার ভাবচর্চায় লালনের ‘ভাবশিষ্য’ বলে কিছু নাই। শিষ্য হতে হয় জীবন্ত গুরুর, তথাকথিত ‘ভাব’ নামক কোনো কিছুর নয়। গুরুশিষ্য সম্পর্ক জীবন্ত মানুষের সঙ্গে জীবন্ত মানুষের সম্পর্ক। এটা সম্পর্ক চর্চার বিষয়, ভাবের চর্চা নয়। এমনকি লালনের শিষ্য বলেও এখন কেউ নাই। কেউই এখন নিজেকে লালনের শিষ্য বলে দাবি করতে পারেন না। কারণ লালন যেমন গত হয়েছেন বা তিরোধান করেছেন, তেমনি যারা লালনের সরাসরি শিষ্য ছিলেন, তারাও সবাই তিরোধান করেছেন। এখন আমি বা আপনি চাইলেও আর লালনের শিষ্য হতে পারব না।
লালনপন্থায় শিষ্য মানেই হচ্ছে আপনি আপনার সময়কালে গুরু-পরম্পরার বিধিবিধান মেনে কোনো না কোনো লালনপন্থী সাধককে গুরু বলে মেনে নিয়েছেন। আপনি সেই জীবিত গুরুর শিষ্য, মৃত লালনের নন। কোনো না কোনো জীবিত মানুষকেই গুরু বলে মেনে নিতে হবে এবং লালনের ঘরের চর্চা অনুযায়ী জীবিত গুরুর ভজনা করতে হবে। লালনের ভাবচর্চার দাবি যদি আপনি করেন তাহলে আপনাকে এই পথেই যেতে হবে। বাঁকা পথে হেঁটে লাভ নাই বা ফাঁকিবাজি করাও ঠিক নয়। আমাদের সিধা সরল থাকা দরকার।
শিষ্য হওয়ার দরকার বোধ না করলে শিষ্য হবেন না। গুরু নাই, অথচ নিজেকে ‘ভাবশিষ্য’ বলার কী দরকার! গুরু ভজনা করা সম্ভব না হলে শিষ্য হবেন না। অসুবিধা কী? আপনি জীবিত কোনো মানুষের কাছে মাথা নোয়াবেন না, অথচ নিজেকে লালনের ‘ভাবশিষ্য’ বলবেন, সেটা হবে না। গায়ের জোরে বা গোয়ার্তুমি করে অবশ্য অনেক কিছু দাবি করতে পারেন, সেটা ভিন্ন তর্ক।
শিল্পকলা একাডেমি লালনের গানের আসর বসাতে পারে; কিন্তু ‘সাধুসঙ্গ’ আহ্বানের অধিকারী তারা নয়, তাতে শিল্পকলা একাডেমির ক্ষতিবৃদ্ধি নাই। কিন্তু যদি আমরা বিভ্রান্তি তৈরি করি, তাহলে এতে ক্ষতি ছাড়া লাভ নাই। গুরুশিষ্য পরম্পরায় বাহিত হয়ে নদিয়ার ভাবচর্চার যে ধারা অব্যাহত রয়েছে তাকে আমরা খামাখা অপমান ও অস্বীকার করব কেন? আমরা যা না, সেটা হয়েছি বলে দাবি করার মধ্যে কোনো যুক্তি নাই।
প্রশ্ন হচ্ছে, নদিয়ার ভাবচর্চার জন্য গুরু পরম্পরার বিধান মেনে গুরু ভজনা জরুরি কেন? এর প্রধান কারণ হচ্ছে, ভাষার প্রতি নদিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি। নদিয়া মনে করে না ভাষার কোনো সুনির্দিষ্ট বা অবস্থা নির্বিশেষে আগে থাকতেই তৈরি কোনো স্থির অর্থ আছে। লালনের গানের আক্ষরিক অর্থ আছে, কিন্তু দেশ-কাল-পাত্র ভেদে সেই অর্থের হেরফের হতে পারে। তার মানে দু’জন শিষ্যের মধ্যেও অর্থের ভিন্নতা ঘটতে পারে, কিংবা একই গুরু তার দুই শিষ্যকে তাদের বোঝাবুঝির ক্ষমতা বুঝে দু’ভাবে অর্থ করতে পারেন।
ভাষার এই অর্থোৎপত্তির সম্ভাবনা সাধকের কাছে বাধা হিসেবে নয় বরং নতুন পরিস্থিতিতে লালনের গান বা কালামকে নতুনভাবে বিবেচনা ও বিচারের সম্ভাবনাকেই জারি রাখে। কিন্তু এতে কি একই গানের নানান অর্থ তৈরির বিপদ সৃষ্টি হয় না? হ্যাঁ, হতে পারে। এই বিপদ ভাষার স্বভাবের মধ্যে নিহিত। ঠিক। কিন্তু অর্থ নির্ণয়ের অধিকারী শিষ্য নন, গুরু। শিষ্য চাইলেই গানের যে কোনো অর্থ করতে পারে না। অর্থের একটা ঐতিহ্য আছে, গুরুশিষ্য পরম্পরার মধ্য দিয়ে যা বিকশিত হয়। ফলে একদিকে ভাষার সম্ভাবনা জিইয়ে রাখা- বিশেষত আক্ষরিক অর্থের সীমা অতিক্রম করে যাওয়ার সম্ভাবনা জারি রাখা- অন্যদিকে গুরুশিষ্য পরম্পরার মধ্য দিয়ে যেমন ইচ্ছা অর্থ তৈরির স্বেচ্ছাচারিতা রোধ, এই দুইয়ের মধ্য দিয়ে নদিয়ার ভাবচর্চা বিকশিত হয়। এ কারণেই নদিয়ার ভাবচর্চা গুরু-শিষ্য সম্পর্ক ছাড়া চর্চা অসম্ভব। এটা লালন নিয়ে গবেষণা, কিংবা লালনের গান ভালোভাবে গাইবার ব্যাপার নয়।
ভাষার চরিত্রের কথা মনে রাখলে, লালন পন্থায় ‘গুরু’ কথাটার অর্থ বোঝা যাবে না। তিনি প্রথাগত গুরু নন, বরং তিনি ভাষা ও ভাবের সম্বন্ধ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং তা নিয়মিত ও নিত্য আখড়ায় ও সাধুসঙ্গে চর্চা করেন। গুরু-শিষ্য সম্পর্ককে দেহ বা দেহবাদ দিয়ে বুঝতে চাইলে কিছুই বোঝা যাবে না। এই সম্পর্ক ভাষার সঙ্গে সম্পর্ক এবং জীবন্ত মানুষের মধ্যে ভাষাচর্চার সম্পর্কের সঙ্গে জড়িত। যা মৃত বই, শাস্ত্র, বা তত্ত্ব পড়ে বোঝা যায় না। বই নিজের ব্যাখ্যা নিজে করতে পারে না, তা কোনো না কোনো জীবন্ত মানুষকেই করতে হয়। একই সঙ্গে শিষ্যের ধারণক্ষমতা সম্পর্কেও গুরুর সজ্ঞান থাকার প্রশ্ন এ ক্ষেত্রে জড়িত রয়েছে।
ভাষার প্রসঙ্গে এলাম কারণ ভাষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‘মৃত্যুবার্ষিকী’ থেকে ‘শাহাদাত বার্ষিকী’- এই পরিবর্তনকে তাই হালকাভাবে নেয়ার উপায় নাই। ভাষার এই রূপান্তর একই সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতিরও গুণগত রূপান্তরের চিহ্ন নির্দেশ করে।
এই কথাটুকুই আপাতত আগামী দিনের রাজনীতি অনুধাবনের জন্য বলে রাখলাম।
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন