শিল্পী কাজী আবুল কাশেম প্রয়াত হয়েছেন ২০০৪ সালে। তার লেখা ‘পূবের জানালা’ নামে একটি বই সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে বাঙালিসমগ্র জাদুঘরের উদ্যোগে। সম্পাদনা করেছেন সোহরাব হাসান। বইতে শিল্পীর আঁকা কয়েকটি ছবি আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে জাজ্বল্যমান যেটি সেটি আমাদের প্রজšে§র অনেকেরই পরিচিত। এটি একটি কার্টুন, শিল্পী চাঞ্চল্যকর কয়েকটি কার্টুনও এঁকেছিলেন, দোপেয়াজা ছদ্মনামে। এটি ছাপা হয়েছিল বায়ান্ন সালে, সাপ্তাহিক সৈনিকে। চিত্রটিতে দেখা যাচ্ছে একদল পাকিস্তানি, পোশাকে চেহারায় ভাব-ভঙ্গিতে তাদের দেখামাত্র চেনা যায়, তারা তলোয়ার, ছুরি, দা ইত্যাদি নিয়ে বাংলা ভাষার হরফগুলোকে ধাওয়া করেছে এবং ভীতসন্ত্রস্ত হরফেরা বই থেকে উঠে প্রাণ রক্ষার জন্য দৌড়ে পলায়ন করছে। পাকিস্তানি ওপরওয়ালারা নানাভাবে আমাদের সংস্কৃতিকে বিপদগ্রস্ত করেছে, বর্ণমালার ওপর আক্রমণ ছিল তারই একটি। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও যে বাংলা বর্ণমালা নিরাপদে আছে এমনটা বলা যাবে না। প্রমিতকরণের নাম করে যত্রতত্র ‘ ী’ কারের শিরচ্ছেদ ঘটছে; পারলে চীনকেও ‘চিন’ বানাতে চাচ্ছে। বেচারা ‘ ী’ কার কী অপরাধ করল বুঝলাম না। প্রমিতকরণের কাজটা বাংলা একাডেমির উদ্যোগে করা হয়েছে এবং বলা বাহুল্য ওই একাডেমি একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, যে জন্য তার হস্তক্ষেপ মান্য না করে উপায় থাকেনি।
সংস্কৃতি, বিশেষ করে ভাষা ও সাহিত্যের ওপর আক্রমণ ব্রিটিশ আমলেও বিস্তর ঘটেছে। রাষ্ট্রের ভয়ে বঙ্কিমচন্দ তার ‘আনন্দমঠ’-এ ক্ষতিকর পরিবর্তন এনেছেন, নবীন সেনকে তার ‘পলাশীর যুদ্ধ’ থেকে অংশবিশেষ বাদ দিতে হয়েছে, আর নজরুলের অনেক বই তো প্রকাশমাত্র নিষিদ্ধ হয়েছে, এমন কি তিনি নিজেও কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। পাকিস্তান আমলের উৎকট আক্রমণগুলোর কথা আমরা জানি। সবচেয়ে নিষ্ঠুর ছিল বাংলা ভাষাকে দাবিয়ে রেখে তার ওপর উর্দুকে চাপানোর মারাত্মক অপচেষ্টা। ব্রিটিশ আমলে একটা আইন ছিল, নাটকের অভিনয় নিয়ন্ত্রণের। সে আইন পাকিস্তানের সময়জুড়েই বহাল ছিল; বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও সে কিন্তু জায়গা ছাড়েনি, অনড় হয়ে বসে থেকে উৎপাত সৃষ্টি করছিল, আন্দোলন করে তবে তার হাত থেকে অব্যাহতি লাভ সম্ভব হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ কোথায় কখন ঘটবে, কিভাবে তার প্রকাশ দেখা যাবে তা নিশ্চিত করে বলাটা একেবারেই অসম্ভব। যেমন ধরা যাক, স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে খোদ ঢাকাতেই, পাবলিক লাইব্রেরি হলের মিলনায়তনে মুক্তধারা সংস্কতি চর্চা কেন্দ দু’দিনের একটি আবৃত্তি উৎসবের আয়োজন করেছিল। প্রত্যাশিত ছিল যে, রাষ্ট্রীয়ভাবে এ ধরনের কাজকে উৎসাহিত করা হবে। কিন্তু উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে সম্পূর্ণ উল্টো খবর শুনতে হলো। প্রশাসনিক শীতলতার দরুন অনুষ্ঠানের অনুমতি পাওয়া যাবে কি-না সে বিষয়েই নাকি সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। তদবির-তোষামোদ করে তবেই অনুমতি লাভ করা গেছে।
এর চেয়েও চাঞ্চল্যকর ঘটনা তো ঘটেছে দৃক গ্যালারিতে ‘ক্রসফায়ারিং’-এর ওপর আয়োজিত একটি স্থিরচিত্র প্রদর্শনীকে ঘিরে। প্রদর্শনীটি হতে দেওয়া হয়নি। পুলিশ বাধা দিয়েছে। অজুহাত কি? না, অনুমতি নেয়া হয়নি। একটি চিত্রপ্রদর্শনী করতে গেলে পুলিশের অনুমতি দরকার হবে এমন কথা স্বাধীন বাংলাদেশে নিশ্চয়ই প্রত্যাশিত ছিল না। এর আগে তেমনটা ঘটেছে বলেও শুনিনি। পুলিশ অবশ্য আসল কারণটি বলেনি। সেটা নিশ্চয়ই ওপরওয়ালাদের নির্দেশ, নইলে পুলিশের কী দায় পড়েছে প্রদর্শনীর দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে মানুষের বিরাগভাজন হওয়ার?
ওপরওয়ালারা যা ইচ্ছা করতে পারেন। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও হস্তক্ষেপ করা তাদের পক্ষে অসুবিধার কিছু না। অথচ বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দেশের কিছু অত্যন্ত মূল্যবান প্রত্নসম্পদ যখন প্যারিসে প্রদর্শনীর নাম করে পাচার হয়ে যাচ্ছিল তখন দেশের সম্পদ রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে কোনো প্রকার উদ্বেগ লক্ষ্য করা যায়নি, উল্টো যারা বাধা দিচ্ছিলেন তারাই নানা প্রকার নিগ্রহের শিকার হচ্ছিলেন। শোনা গেছে, এবং পরে প্রমাণিতও হয়েছে যে, পাচারের ওই কুৎসিত প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমলাতন্ত্রের কোনো কোনো সদস্যের যোগসাজশ ছিল।
শিল্পী আবুল কাসেম পরিণত বয়সেই চলে গেছেন। কথাশিল্পী কায়েস আহমদ কিন্তু তুলনায় অল্পবয়সেই আত্মহত্যা করেছেন। অত্যন্ত উঁচুমাপের এই লেখক বেঁচে থাকতে পারলেন না, কেননা ওই যে রাষ্ট্রীয় ওপরওয়ালা, তারা তাঁর পেছনে লেগেছিল। সরাসরি আক্রমণ করেনি ঠিকই। কিন্তু তাঁকে উৎপাটিত করে নিয়ে এসেছিল তার জন্মভূমি পশ্চিমবঙ্গ থেকে। ব্রিটিশের পুঁজিবাদী-আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র দেশভাগ করল ১৯৪৭ সালে, বলল স্বাধীনতা দিচ্ছি, সেই স্বাধীনতার মারাত্মক আক্রমণে অল্প বয়সেই কায়েস আহমদকে শরণার্থী হয়ে ঢাকায় চলে আসতে হয়েছে।
এখানে তিনি নিজের জীবনকে গড়ে তুলেছিলেন। শিক্ষকতা করেছিলেন স্কুলে এবং লেখক হিসেবে সুন্দর প্রতিষ্ঠাও পেয়েছিলেন। কিন্ত বাবা-মা আত্মীয়স্বজন সবাই ছিলেন ওপাড়ে। এখানে তিনি একা। বিয়ে করেছিলেন কিন্তু তার স্ত্রীও অসুস্থ থাকতেন। একাত্তরে দেশ স্বাধীন হলো কিন্তু তাতে তার নিঃসঙ্গতা ঘুচল না। বাবা মারা গেছেন, মা’র চলে যাওয়ার খবরও পেলেন, তাদের কারো সঙ্গেই আর তার দেখা হয়নি। নাকি তার পাসপোর্টই ছিল না। শেষ পর্যন্ত তিনি আত্মঘাতী হলেন। ঘটনা আজ থেকে অনেক বছর আগের।
আরেকজন বড় মাপের লেখক মাহমুদুল হকও চলে গেছেন, ক’বছর আগে। তিনি অবশ্য দৈহিক অর্থে আত্মহত্যা করেননি। কিন্তু শিল্পগত দিক থেকে তার ক্ষোভ ও আত্মহননের ঘটনা ঘটেছে। ৪০ বছর বয়সে, মাহমুদুল হক যখন খ্যাতির শীর্ষে তখনই হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই সে লেখা বন্ধ করে দিল। তারপর ২১-২২ বছর কেটে গেল, তেমন কিছুই আর লিখল না। তার মৃত্যুর পরে তার বন্ধুরা মিলে একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করেছে। সেটি পড়লে মন খারাপ হয়ে যায়। আশ্চর্য জাদু ছিল তার গদ্য রীতিতে। নিজের জন্য যেটা সে তৈরি করে নিয়েছিল। তাকে তুমি বলছি, কারণ সে বয়সে আমার চেয়ে চার-পাঁচ বছরের ছোট ছিল। আমাদের কৈশোরে আমরা এক পাড়াতেই, আজিমপুর কলোনিতেই থাকতাম। সে পড়ত স্কুলে, আমি কলেজে; জানা শোনা ছিল, সবচেয়ে ঘনিষ্ঠতা ছিল তার আমার সহপাঠী ও বন্ধু মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহর সঙ্গে, স্মারকগ্রন্থে লিখিত তার লেখায় তিনি স্মরণ করেছেন যে স্কুলের ছাত্র মাহমুদুল হকের প্রথম লেখা আমিই প্রকাশের ব্যবস্থা করি, সাপ্তাহিক সৈনিকের ছোটদের পাতায়। মাহমুদরাও সাতচল্লিশের সেই মর্মান্তিক স্বাধীনতার শিকার। তাদের পরিবারও পশ্চিমবঙ্গের ঘরবাড়ি ফেলে ঢাকায় চলে এসেছিল। তবে কায়েস আহমদের মতো একাকী আসেনি। মাহমুদরা প্রায় গোটা পরিবারই চলে এসেছিল। পরিবারটি বৃহৎই ছিল। আজিমপুর থেকে তারা চলে যায় গেণ্ডারিয়াতে, যেখানে তার পিতা একটি বাড়ি কিনেছিলেন। একাত্তরের পরে মাহমুদ একবার পশ্চিমবঙ্গের বারাসাতে নিজেদের পুরনো বাড়ি দেখেও এসেছিল। কিন্তু ওপরওয়ালা রাষ্ট্রেরও যে ওপরওয়ালা, যার নাম পুঁজিবাদ, সেই দুর্বৃত্ত শিল্পী মাহমুদুল হককে নিষ্কৃৃতি দেয়নি। জীবিকার প্রয়োজনে বায়তুল মোকাররমে মাহমুদ একটি স্বর্ণালঙ্কারের দোকান খোলে, তাতে অর্থনৈতিক সাফল্য যে আসেনি তা বোধহয় নয়, কিন্তু সোনার দোকানে গ্রাহকসেবা দানকে একজন কথাশিল্পীর জন্য যথোপযুক্ত কাজ বলা কঠিন। মাহমুদ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। ওর দোকানের খবর আমি জানতাম, পাশে কখনো কখনো গেছিও, কিন্তু ভেতরে ঢোকা হয়নি, হয়তো মনে হয়েছে যে পরিবেশটি অনুকূল নয়।
কিন্তু মাহমুদ লেখার কাজ ছেড়ে দিল কেন? হয়তো লিখে কী হবে এই ধরনের জিজ্ঞাসা তার মনে দেখা দিয়েছিল। হতে পারে জনবিচ্ছিন্নতার কারণে লেখার উপাদানে ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। এমনও হওয়া সম্ভব যে, অনভ্যাসের দরুন আগের মানের লেখা পাঠককে উপহার দিতে পারবে না বলে একটা ভয় তার মনের ভেতর চেপে বসেছিল। যাই ঘটুক পেছনে যে পুঁজিবাদ ছিল তা অস্বীকার করা যাবে না। পুুঁজিবাদই তাকে বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ করছিল এবং বিচ্ছিন্নতা দূর করার আগ্রহই হয়তো তাকে ঠেলে দিয়েছিল নরসিংদীর এক আধ্যাত্মিক ‘বাবা’র আখড়ায়। সেখানে নাকি তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। পুরাতন বন্ধুবান্ধব ও অনুরাগীরা দেখা করলে সে গল্প করত, কিন্তু শিল্পকলার বিষয়ে আলাপচারিতা পছন্দ করত না। তিয়াত্তরে তার পিতা, ঊননব্বইতে মাতা প্রয়াত হন। পরে স্ত্রীও কিছুদিনের জন্য কানাডায় প্রবাসী হয়েছিল এবং মাহমুদের মৃত্যুর কয়েক মাস আগে তার মৃত্যু ঘটে। এসব তথ্য স্মারকগ্রন্থ থেকেই পাওয়া গেল।
আমি দেখলাম পুঁজিবাদ কেমন নৃশংস হতে পারে। আজিমপুরে মাহমুদুল হকের প্রতিবেশী ছিলেন কথাশিল্পী শহীদ সাবের। পুঁজিবাদী পাকিস্তানি রাষ্ট্র তাকেও ছাড় দেয়নি। অল্প বয়সে তিনি কারারুদ্ধ হয়েছিলেন বামপন্থি ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত থাকার দায়ে। জেল থেকে বেরিয়ে জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। কেবল নিজের নয়, সরকারি চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত পিতার পরিবারের দায়িত্বও এসে পড়েছিল কাঁধে, যেমনটা সাধারণত এসে থাকে। কিন্তু কোথাও তিনি দাঁড়াবার জায়গাটা পাননি। শেষ দিকে মানসিক ভারসাম্যই হারিয়ে ফেলেছিলেন। যে রাষ্ট্র কিশোর শহীদ সাবেরকে একদিন কারাগারে আটক করেছিল সেই রাষ্ট্রই আনুষ্ঠানিকভাবে পরাভূত হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে একাত্তর সালে তাকে হত্যা করল, রাতের অন্ধকারে দৈনিক সংবাদ অফিসে আগুন লাগিয়ে দিয়ে, যে অফিসে তিনি শরণার্থী ছিলেন।
একাত্তরে শিল্পীরা ওই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পথে নেমে এসেছিলেন। ট্রাকে চেপে তারা গান গাইতেন। উদ্বুদ্ধ করতেন মানুষকে। তাদেরই একজন, নিজে যিনি অল্প বয়সেই অতিবিশিষ্ট রবীন্দ সংগীত শিল্পী হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিলেন, তিনি ছিলেন ওই গানের স্কোয়াডের মূল সংগঠক। হানাদারেরা তাকে ভোলেনি, পঁচিশে মার্চের পর তাকে খুঁজে বের করে ধরে নিয়ে গেছে, প্রাণে মারেনি, তবে নির্যাতন করতে কোনো কসুর করেনি। স্বাধীনতার পর স্বাভাবিক প্রত্যাশা ছিল যে, শিল্পী নিজেকে বড় একটা কর্মক্ষেত্রে প্রসারিত করবেন, অনেককে টেনে আনবেন গানের জগতে। দেখা গেল তা তিনি করতে পারছেন না। একদা যিনি যুদ্ধে ছিলেন, ওপরওয়ালা পুঁজিবাদ তাঁকে যেভাবে জব্দ করেছিল তেমনভাবে জব্দ পুঁজিবাদেরই সেবক পাকিস্তানি রাষ্ট্রও করতে পারেনি। বিচ্ছিন্ন ও উৎপাটিত করে পুঁজিবাদ তাকে নিয়ে গেল নিউইয়র্কে। সেখানে তিনি গান গাইবেন কোথায়, কার জন্য, কিভাবে? ওদিকে জীবিকার দায় তাকে স্বভাবতই তাড়া করেছে। আবারও তাকে পথেই নেমে আসতে হয়েছে, তবে মুক্তির গান নিয়ে নয়, ট্যাক্সি ক্যাব চালিয়ে যাত্রী পারাপারের গ্লানিকর কাজে। যে শিল্পীর ভেতর প্রতিশ্রুতি ছিল বড় কাজের তিনি বন্দি হয়ে গেলেন। যেন স্বেচ্ছায়। আসলে তো স্বেচ্ছায় নয়, স্বেচ্ছাচারী পুঁজিবাদের হেঁচকা টানে।
একজন ফটোগ্রাফারের কথা জানি, ফটোগ্রাফিকে তিনি শিল্পের স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষের সময় তার কয়েকটি ছবি কেবল বাংলাদেশে নয়, আন্তর্জাতিকভাবেই চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। একদিন শুনি তিনিও নেই, চলে গেছেন ওই নিউইয়র্কেই। কিন্তু সেখানে তো শিল্পচর্চার কোনো সুযোগ থাকার কথা নয়, তিনিও জীবিকা খুঁজেছেন হয়তো, কিন্তু সন্ধান পাননি। শেষ পর্যন্ত যাকে বলে ‘অড জব’ তাই করেছেন। ওই সব কাজে তাঁর পোষায়নি। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। দেশে ফিরেছিলেন, কিন্তু অসুখ সারেনি। হঠাৎ একদিন শুনলাম তিনি আর নেই। মারা গেছেন। এসব ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয় মোটেই। আমাদের কত মেধাবী ছাত্র ও চিকিৎসক চলে গেছেন পুঁজিবাদী দেশে। ফিরবেন ভেবেছিলেন। ফেরা হয়নি। সবই ওই ওপরওয়ালার হুকুম বটে! তার কাজ তিনিই করেন লোকে বলে আমরা করি। পুঁজিবাদ কোনো কিছুকেই অব্যাহতি দেয় না, সব কিছুকেই পণ্যে পরিণত করে। সংস্কৃতিকেও। কিভাবে করে তা নিয়ে বিশেষ তদন্তের আবশ্যকতা নেই। টেলিভিশনের পর্দার ওপর চোখ বুলালেই সম্যক জ্ঞান লাভ করা যায়। সেখানে নাটক, আলোচনা, গানবাজনা ইত্যাদি তো বটেই, সংবাদও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে। সব অনুষ্ঠানকেই তো মনে হয় এক প্রকারের অজুহাত, বিজ্ঞাপন প্রচারের। কিন্তু কেবল টেলিভিশন কেন, খোলা মঞ্চে যেসব অনুষ্ঠান হয়, নাটকের গানের, উৎসব হয় একুশে ফেব্রুয়ারি, পহেলা বৈশাখ, বিজয় দিবস ইত্যাদির তাদের সবটার পেছনেই তো দেখা যায় কোনো না কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। চাঁদা আমরাও তুলতাম, বাসায় বাসায় বা দোকানে দোকানে, কিন্তু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন বহনকারীতে পরিণত হওয়ার কথা আমরা কখনো ভাবতেই পারিনি, দুঃস্বপ্নেও নয়।
আমাদের সময়ে সিনেমা হলে নতুন ছবি এলে তার প্রচারণার একটা পদ্ধতির কথা মনে পড়ে। বাজনা বাজিয়ে কয়েকজন রাস্তায় বের হতো, সঙ্গে থাকত খাঁচার মতো করে তৈরি একটা হাল্কা বিলবোর্ড (এখনকার ভাষায়) যেটিকে একজন ভাড়া করা বাহকের দায়িত্ব ছিল বহন করার। লোকটির মাথাটি দেখা যেত, কিন্তু উজ্জ্বল হয়ে থাকত সিনেমা হলে নতুন আকর্ষণের নায়ক-নায়িকাদের ছবি, যেগুলো সাঁটা থাকত ওই বিলবোর্ডে। এখন তো দেখছি কোনো দিনমজুর নয়, নামিদামি বড় বড় শিল্পীই ওই বিজ্ঞাপন বহন করেন তাদের উৎসবে ও শিল্পানুষ্ঠানে। অগ্রগতি বৈকি। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো দাতব্য প্রতিষ্ঠান নয়, তারা যে অর্থের জোগান দেয় সেটা তথাকথিত সামাজিক দায়িত্ববোধের তাড়নায় নয়, পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচারের নির্জলা অভিপ্রায়ে বৈকি। উদ্ধারের উপায় কি? এককথায়, ওপরওয়ালাকে প্রত্যাখ্যান করা, তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়া, চেষ্টা করা তাকে পর্যুদস্ত করে শিল্পচর্চার মুক্তি ঘটানো। শিল্পচর্চার মুক্তি এবং মানুষের মুক্তি একত্রে গ্রথিত বৈকি। একটির মুক্তি সম্ভব নয় অপরটিকে বাদ দিয়ে।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক
( মানব কণ্ঠ )
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন